চারুবাক: যে 'ছোটলোক'-এর কলমে একসময় 'ঠান্ডা গোস্ত', 'কালি সালোয়ার', 'টোবা টেক সিং'-এর জন্ম, যাঁর লেখা শব্দে গরীব মানুষের যন্ত্রণা প্রতিফলন ঘটে, শোনা যায় বঞ্চিতের আর্তনাদ, তাঁকে কি অস্বীকার করা যায়? সাদত হাসান মান্টো। এই মানুষটাই বলেছিলেন, "আমার গল্প যদি আপনার খারাপ লাগে, তাহলে বুঝতে হবে আপনি যে সমাজের মধ্যে রয়েছেন সেটা আসলে আরও খারাপ।" তাইতো আজও রঙ্গমঞ্চে প্রতিফলিত হয় তাঁর জীবন, তাঁর দর্শন। তৈরি হয় 'বেপরোয়া মান্টো'র (Beoparowah Manto) মতো নাটক।
লুধিয়ানায় জন্মা মান্টোর। মানুষটি লেখাপড়া তেমন করেননি ঠিকই, কিন্তু জীবনযাপনকে পড়েছেন একজন সত্যনিষ্ঠ মানুষ হিসেবে। তাঁর প্রিয়জন ছিল শহর, আধা শহরের প্রান্তে পড়ে থাকা দলিত, নিচুতলার মানুষরা, শরীর বেচে খাওয়া মেয়েরা ছিল তাঁর কাছের মানুষ। মান্টো এদের সঙ্গেই সঙ্গত করতে বেশি পছন্দ করতেন। সমাজের 'আন্ডারবেলি' ছিল তাঁর গল্প ও কাহিনির কেন্দ্রবিন্দু। এমনকী, যখন তিনি বম্বে টকিজ বা কোনো ফিল্ম সংস্থায় চিত্রনাট্য লেখার কাজ করেছেন, সেখানেও নায়ক-নায়িকাদের সঙ্গে যতটা ভাব হয়েছে, তার চাইতে বেশি বন্ধুত্ব হয়েছে সাধারণ কর্মীদের সঙ্গে। হ্যাঁ, সতীর্থ গল্পকার ইসমত চুগতাইয়ের সঙ্গে তাঁর 'বিশেষ বন্ধুত্ব' ছিল, কিন্তু মান্টো সম্ভবত নিজেই নিজেকে ইনফেরিওরিটি কমপ্লেক্স থেকে সরিয়ে নিয়েছেন। আরেক গল্পকার কৃষাণ চন্দরের সঙ্গেও সখ্যতা ছিল তাঁর।
জীবনের শেষ পর্যায়ে, মাতৃভূমি ছেড়ে মান্টোকে চলে যেতে হয় সীমান্তের ওপারে লাহোরে। সেখানেই রিক্ত, নিঃস্ব অবস্থায় প্রায় চিকিৎসাহীন হয়ে জীবনাবসান ঘটে লেখকের। এই মানুষটির মাথায় তখনও 'অশ্লীলতার' দায়ে একাধিক মামলা চলছিল পাকিস্তানের আদালতে। প্রায় শেষ শয্যা থেকেও ইসমতকে চিঠি লিখেছিলেন তিনি। উত্তর পাননি! এমন একজন অসম সাহ্সী সমাজ সংস্কারি লেখকের জীবনকে মঞ্চে তুলে আনা খুব সহজ কাজ নয়। তাঁর জীবন রঙিন হলেও, সেই রঙে বাণিজ্যিক উজ্জ্বলতা নেই। রয়েছে কাঁচা জীবনের আরও কাঁচা আলেখ্য।
[আরও পড়ুন: কালীঘাটে আহানা কুমরা, কারণ অমিতাভ বচ্চন!]
সিনেমায় মান্টোর জীবন তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন নন্দিতা দাস। মঞ্চে রঙ্গকর্মী-র ঊষা গঙ্গোপাধ্যায় মান্টোর গল্প নিয়ে ছোট ছোট প্রযোজনা করেছিলেন। কিন্তু তাঁর জীবনচর্চা নিয়ে বাংলার এই নাট্য রাজধানীতে তেমন কোনও সৃজন চোখে পড়েনি। অত্যন্ত আনন্দের সংবাদ, সেই গুরুদায়িত্ব পালন করতে এগিয়ে এসেছে 'পদাতিক'। কলকাতার অন্যতম নাট্যসংস্থা। এখন, এই মুহূর্তে 'পদাতিক' নাট্যদলের সামনের সারিতে থাকা অনুভা ফতেপুরিয়া, অশোক সিংয়ের সঙ্গে হাত মিলিয়েছে এক ঝাঁক উদ্যমী তরুণ-তরুণী আর প্রবীণ দুই কুশিলব। আলোয় দীনেশ পোদ্দার, শব্দে দীনেশ হালদার। এঁদের সামগ্রিক প্রচেষ্টা, আন্তরিক ভালোবাসা এবং অনসম্বল কাস্টিংয়ের পেশাদারিত্ব 'বেপরোয়া মান্টো'কে ভাষার (উর্দু) বেড়া ডিঙিয়েও মঞ্চে সাবলীল করে তুলেছে।
অশোক সিং অভিনয় করেছেন বয়স্ক মান্টোর ভূমিকায়, মাঝে মাঝে সূত্রধর হয়েও লেখার টেবিল ছেড়ে মঞ্চে নেমেছেন। নাটকটি নির্দেশনা করা ছাড়াও, অনুভাকে লিখতে হয়েছে চিত্রনাট্য। তিনি অনেকটা কোলাজের ভঙ্গিতে মান্টোর জীবনের উল্লেখযোগ্য কিছু ঘটনা, কিছু চরিত্রের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ, বাক্যালাপ ( যেমন, নায়ক অশোক কুমার, শ্যামসুন্দর, গল্পকার কৃষাণ চন্দর, প্রযোজক বিলি মোরিয়া, নায়িকা পদ্মাদেবী, সাংবাদিক বাবুরাও প্যাটেল, সৌগন্ধী নামের বারবনিতা) নিয়েও ছেঁড়া ছেঁড়া দৃশ্যের উপস্থাপন করে মান্টোর একটি 'বিদ্রোহী' আদল দেবার চেষ্টা করেছেন।
'পদাতিক' লিটল থিয়েটারের স্বল্প পরিসরে অনুভবের কাজটা ছিল বেশ চ্যালেঞ্জিং। কিন্তু তিনি সেই চ্যালেঞ্জকে সামলেছেন একঝাঁক তারুণ্যের ভরসায়। শুধু অভিনয়ে নয়, মঞ্চকে চোখের পলকে বদলে দেওয়া এবং সেই সঙ্গে দীনেশ পোদ্দারের আলো অণুভাকে অতীব সাহায্য করেছে। অবশ্যই অনুভার প্রায়োগিক ভাবনার প্রশংসা করতেই হবে, বিশেষ করে শিল্পীদের সামগ্রিক কোরিওগ্রাফি। অভিনয়ে প্রথম নাম অশোক সিং হলেও, যে দুই তরুণ অল্পবয়সি মান্টো সেজেছেন, কিংবা যে ছেলেটি শ্যামসুন্দর হয়েছেন, তাঁরা অনবদ্য। প্রায় প্রত্যেকেই একই সুরে তালে ছন্দে পুরো নাটকটিকে নিজেদের কাঁধে বয়ে নিয়েছেন। এটা যতটা অনুভার কৃতিত্ব, ততটাই সামগ্রিক প্রযোজনার।