চারুবাক: 'যা নেই ভারতে, তা নেই ভারতে' অর্থাৎ মহাভারতে যা নেই পুরো ভারতবর্ষেও তা নেই। এই তথা স্মরণে রেখেই 'উবাচ' নাট্যসংস্থা কুঁড়ি থেকে ফুল হয়ে ফুটে ওঠার প্রয়াসে রত। গত কয়েক বছর ধরেই এই গোষ্ঠী নাট্য অঙ্গনে নতুন ভাবনার পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাচ্ছে। নেতৃত্বে সঞ্জয় ঘোষ নামের এক মাঝবয়সী 'তরুণ'! তাঁর সামাজিক, পৌরাণিক চিন্তাভাবনা এবং উপস্থাপনার প্রকৌশলী আঙ্গিকে অতীত ও বর্তমান মিলেমিশে এক ধরনের নতুন নাট্য আঙ্গিকের স্বাদ এনে দেয়। কেউ কেউ তার মধ্যে বাদল সরকারের অঙ্গনমঞ্চ বা প্রবীর গুহের মেঠো থিয়েটারের আভাস পেতে পারেন।
'উবাচ'র নতুন নাটক 'যোজনগন্ধা' মহাভারতের ধীবরকন্যা সত্যবতীর ধীরে ধীরে ক্ষমতায় অলিন্দে আসা ও রাজরানির আসনে সমাসীন হওয়ার কাহিনি বিভিন্ন ঘটনার অনুষঙ্গে তুলে এনেছে মঞ্চে। এই নাট্য মঞ্চে কোনও দেয়াল নেই। নেই কোনও আলোক বিচ্ছুরণের কারিকুরি, গান বা শব্দের জগঝম্প অথবা পৌরাণিক পোশাকের কোনও আড়ম্বর। ছিল শুধু জনা বারো-তেরো ছেলে-মেয়ে। নারী-পুরুষের শরীরী বিভঙ্গের সঙ্গে কথা ও সুর মিলিয়ে সত্যবতী-পরাশর মুনির প্রেম, শান্তনুকে বিবাহ করে সত্যবতীর রাজরানি হওয়া, ধৃতরাষ্ট্র ও পাণ্ডু দুই পুত্রের জননী হওয়া, তার পর বুদ্ধি ও কূটনীতির আশ্রয় নিয়ে রাজ্যের শাসনভারে সক্রিয় ভূমিকা নেওয়া। সমস্ত ঘটনার এক 'স্কেচি চিত্র' 'যোজনগন্ধা'।
[আরও পড়ুন: ‘কড়া শাস্তি চাই’, আর জি কর ঘটনায় সরব সৃজিত-শ্রীলেখা, কমলেশ্বর, মোমবাতি মিছিল কিঞ্জলের]
অত্যন্ত মুন্সিয়ানার সঙ্গে সঞ্জয় এই কাজটি এই অধিকাংশ নতুন মুখদের দিয়ে করিয়ে নিয়েছেন। কোথাও ছন্দপতন ঘটেনি। সমগ্র প্রযোজনায় প্রপস বলতে ছিল কিছু রঙিন ওড়না, যেগুলি কখনও কোমরবন্ধ, কখনও মাথার ফেট্টি হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। আর ছিল একটি নৌকা বাইবার দাঁড়, যেটিকে পরে রাজদণ্ড হিসেবেও ব্যবহার করেছেন সত্যবতী। বেদব্যাসের লেখায় সত্যবতী 'যোজনগন্ধা' হয়েছিলেন, যেহেতু তাঁর শরীরের তীব্র আঁশটে গন্ধ যোজন দূরত্ব থেকে পাওয়া যেত। অথচ তাঁর শরীরী আকর্ষণ মুনিঋষি থেকে রাজপুরুষ কেউই এড়াতে পারেননি! তাই 'যোজনগন্ধা' শব্দটির অন্য একটি গূঢ় অর্থও রয়েছে বৈকি। আজকের সময়ে নারী স্বাধীনতা, নারীর ক্ষমতায়নের যে কথা বলা হয়, সেই কাজটি মহাভারতেই করে গিয়েছেন রচয়িতারা।
নাট্যকার এবং পরিচালক সঞ্জয় ঘোষের কৃতিত্ব সেই ইতিহাসকে আজকের সঙ্গে এক সমান্তরালে নিয়ে আসায়। সেখানে তিনি সুকান্ত ভট্টাচার্যের 'ছাড়পত্র' কবিতার লাইন ব্যবহার করেছেন। যেমন - "জীর্ণ পৃথিবীতে ব্যর্থ, মৃত আর ধ্বংসস্তুপ-পিঠে / চ’লে যেতে হবে আমাদের / চ’লে যাবে—তবু আজ যতক্ষণ দেহে আছে প্রাণ / প্রাণপণে পৃথিবীর সরাবো জঞ্জাল / এ বিশ্বকে এ-শিশুর বাসযোগ্য করে যাব আমি / নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার।"
এই সংলাপের পাশেই সঞ্জয় আজকের সত্যবতীদের উদ্দেশ্য করে বলেছেন - "তুই সৎসাহসের দেশে যা / তুই মহাকালের গর্ভে যা... ইতিহাস কি আমাদের মনে রাখবে! আসছে আতঙ্ক / যাচ্ছে মহাকাল / বইবে প্রলয় / আসন্ন মহাকাল...আপন মনে তফাৎ যা / তুই ঢেউয়ের চূড়োয় ভেসে যা / তুই যোজন যোজন দূরে যা / তুই সত্যের খোঁজে যা..." কথাগুলো যখন সেদিন ICCR-এর অবনীন্দ্র সভাঘরে আমন্ত্রিত কিছু দর্শকের সামনে দলের শিল্পীদের কণ্ঠে শোনা যাচ্ছিল তখন মনে হচ্ছিল প্রচলিত মঞ্চের বাইরে গিয়ে ননপ্রোসেনিয়ামের ওই পরিসরটি একটি যেন প্রতিবাদ-প্রতিরোধের মঞ্চ হয়ে উঠেছে। উপস্থিত প্রায় সকলেই স্বীকার করলেন, এমন প্রযোজনা এখনকার বাংলা নাট্য পরিসরে এক অভিনব অভিজ্ঞতা।
সঞ্জয় ঘোষের সাবলীল পরিচালনার সঙ্গে যোগ্য সহযোগিতা করেছেন দলের প্রতিটি শিল্পী। সঞ্জয় নিজে ছিলেন অনেকটাই নান্দীকারের ভূমিকায়, সঙ্গে পেয়েছিলেন ডলি বসুকে। তিনিও মাঝে মাঝে 'নাটক' ভাঙার কাজটি সুন্দর করেছেন। যদিও সঞ্জয় বলেছেন 'সবাই মুখ্য এই নাটকের নকশায়', তবুও সত্যবতীর চরিত্রে সুদীপ্তা ঘোষাল একজন গৃহবধূ হয়েও চরিত্রটির শান্ত, বিনয়, নম্রভাবের সঙ্গে ঠিক ঠিক সময়ে সত্যবতীর তেজদীপ্ত ভাবটি প্রকাশেও সাবলীল ছিলেন। উবাচ দলের এই 'যোজনগন্ধা' নাটক বা নকশা যাই বলা হোক না কেন, এই প্রযোজনার বহুল প্রদর্শনী দাবি করে। কিন্তু, এখনকার 'নাটকীয়' কলকাতা কি সেই দাবি পূরণে সাহায্য করবে?