বিশ্বদীপ দে: সংবাদপাঠিকা গীতাঞ্জলি আইয়ারের (Gitanjali Aiyar) মৃত্যু ভারতীয় টেলিভিশন জগতের এক যুগের অবসান। বুধবারের বিকেল থেকে তাঁর প্রয়াণসংবাদ সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়তেই বহু মানুষ মুহূর্তে স্মৃতিকাতর হয়ে পড়তে থাকেন। বান্ধবীর মৃত্যুতে শোকস্তব্ধ কাবেরী মুখোপাধ্যায়ও। একসময়ের সহকর্মী কেবল নয়, গীতাঞ্জলি ছিলেন তাঁর দিদির মতো। সেই মানুষটির প্রয়াণ মেনে নিতে পারছেন না তিনি। সংবাদ প্রতিদিন ডিজিটালের তরফে তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে সুদূর প্যারিস থেকে তিনি বলেন, ”ঠিক কী অনুভূতি হচ্ছে বলে বোঝাতে পারব না।” তিনি বলতে না পারলেও পরবর্তী বেশ কিছুটা সময়ের জন্য তাঁর নৈঃশব্দ্যই যেন বুঝিয়ে দেয় সবটা।
১৯৮৩ সালে দূরদর্শনে (Doordarshan) যোগ দিয়েছিলেন কাবেরী। গীতাঞ্জলি ছিলেন তাঁর সিনিয়র। শুরু থেকে তিনি কীভাবে গাইড করেছিলেন নবাগতা সংবাদপাঠিকা সহকর্মীকে, আজও ভুলতে পারেননি কাবেরী। লন্ডনে থেকে পড়াশোনা করার দরুন কাবেরীর উচ্চারণে ইংরেজির একটা প্রভাব ছিল। তাই যত্ন করে ‘ত্রিবান্দ্রাম’কে কেমন করে ‘তিরুঅনন্তপুরম’ বলতে হবে শিখিয়েছিলেন গীতাঞ্জলিই। এমন বহু কিছুই বুঝিয়ে দিয়েছিলেন। বলা যায়, নিজের অভিজ্ঞতার নির্যাসে তৈরি করে নিয়েছিলেন নতুন সহকর্মীকে। সেই কৃতজ্ঞতা আজও ঝরে পড়ে কাবেরীর কণ্ঠে, ”উনি ছিলেন আশ্চর্য অভিজাত এক মহিলা। ওঁর গরিমা ছিল দেখার মতো।”
[আরও পড়ুন: Panchayat Election 2023: ৮ জুলাই একদফায় রাজ্যে পঞ্চায়েত ভোট, দিনক্ষণ জানালেন নির্বাচন কমিশনার]
তাঁর সঙ্গে কথা বলার সময় বুকের ভিতরে সেই হারিয়ে যাওয়া সময়ের গন্ধ যেন ভেসে উঠতে থাকে। অসংখ্য নিউজ চ্যানেলের দাপাদাপির ভিতরে সেই সময়টাকে কার্যত অলীক বলে মনে হতে থাকে। কাবেরী জানাচ্ছেন, ”স্যাটেলাইট চ্যানেল শুরু হওয়ার আগে আমরাই ছিলাম দেশের সংবাদপাঠের একমাত্র মুখ। কোথাও গেলেই ভিড় হয়ে যেত। অটোগ্রাফ দিতে হত। কিন্তু আমাদের সকলেরই পা ছিল মাটিতে। গীতাঞ্জলিও ব্যতিক্রম ছিল না।”
নিছক সহকর্মী নয়, তাঁরা সত্য়িই হয়ে উঠেছিলেন পরস্পরের আত্মীয়। ১৯৯৫ সালে প্রসার ভারতী সিদ্ধান্ত নেয় কয়েকজন সংবাদপাঠিকাকে আর খবর পড়তে না দেওয়ার। তাঁদের মধ্যে ছিলেন গীতাঞ্জলিও। কাবেরী এই সিদ্ধান্ত মানতে পারেননি। প্রতিবাদে ফেটে পড়ে জানিয়েছিলেন, তাহলে পুরুষ সংবাদপাঠকদেরও কয়েকজনকে সরিয়ে দেওয়া হোক। কেবল প্রতিবাদ নয়, বিষয় গড়ায় আদালত পর্যন্ত। কিংবদন্তি রাম জেঠমালানির কন্যা রানি জেঠমালানি লড়েছিলেন সেই মামলা। যা পৌঁছেছিল সুপ্রিম কোর্টে। এবং শেষপর্যন্ত জয়ী হয়েছিলেন কাবেরীই। শুনতে শুনতে অবাক লাগছিল। সহকর্মীদের ভিতরে সম্পর্কটা কোন পর্যায়ে গেলে এতদূর পর্যন্ত যাওয়া যায়।
[আরও পড়ুন: কালিয়াগঞ্জে নাবালিকার মৃত্যু: সিটকে অসহযোগিতা! CBI তদন্ত দেব? রাজ্যকে প্রশ্ন হাই কোর্টের]
আজকের সময়টা তাই কাবেরীর কাছে অলীক বলেই মনে হয়। জানালেন, এখন যেভাবে খবর পড়া হয়, তা তাঁর একেবারেই পছন্দ হয় না। আর সেকথা বলতে বলতেও গীতাঞ্জলির মৃত্যু নতুন করে কাঁদিয়ে দিয়ে যায় তাঁকে। তিনি ভুলতে পারছেন না গীতাঞ্জলির শেষ দিনটি। প্রয়াত সংবাদপাঠিকার পুত্র শেখর ও কন্যা পল্লবী থাকেন আমেরিকায়। বিবাহবিচ্ছিন্না গীতাঞ্জলি মৃত্যুর মুহূর্তে ছিলেন একেবারে একা! সেই মুহূর্তের কথা বলতে বলতেই কাবেরী বলে ওঠেন, ”আমি চাই গীতাঞ্জলি স্বর্গে একটা জায়গা তৈরি করে রাখুক। একে একে সবারই তো ডাক পড়বে। সেখানে গিয়ে আবার সবাই খবর পড়ব আমরা।” এই আকুতিই বলে দেয়, এমন এক সময়ের প্রতিনিধি তাঁরা, যে সময়টাই বোধহয় হারিয়ে গিয়েছে। কিন্তু হারিয়ে যেতে যেতেও তা রয়ে গিয়েছে।