কাঁঠাল (Jackfruit) একটি বহুমুখী প্রজাতির খাদ্য, কাঠ, জ্বালানি, পশুখাদ্য, ঔষধি ও শিল্পজাত পণ্য। এই ফলের আঠা বার্ড লাইম হিসাবে, গাছের ছাল দড়ি ও কাপড় তৈরিতে, কাষ্ঠল অংশ দিয়ে আসবাবপত্র ও সংগীতের সরঞ্জাম প্রস্তুত হয়। কাঁচা ফল (এঁচোড়) রান্না করে ও আচার প্রস্তুতিতে ব্যবহৃত হয়। পাকা অবস্থায় সরাসরি ফল হিসাবে খাওয়া যায়। পাকা ফলের শাঁস থেকে জ্যাম, জেলি, ক্যান্ডি, মার্মালেড এবং আইসক্রিম তৈরি হয়। বীজ শুকিয়ে ভেজে বা রান্নায় সবজি হিসাবেও খাওয়া যায়। ফল, পাতা এবং বাকল-সহ গাছের বিভিন্ন অংশ ওষুধে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়। লিখেছেন বিধানচন্দ্র কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (Bidhan Chandra Agriculture University) ফল বিজ্ঞান বিভাগের গবেষক তন্ময় মণ্ডল ও অধ্যাপক ড. ফটিককুমার বাউরি।
সার ব্যবস্থাপনা
রোপণের সময় প্রতি গর্তে গোবর ৩৫ কেজি, টিএসপি সার ২১০ গ্রাম, এমওপি সার ২১০ গ্রাম সার প্রয়োগ করতে হয়। তবে বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রতি গাছের জন্য সারের পরিমাণ বৃদ্ধি করা দরকার।সার প্রয়োগ সচরাচর বর্ষার আগে ও পরে করতে হয়। ৩০ থেকে ৪০ কেজি এফওয়াইএম প্রতিবছর প্রতি গাছে দিতে হবে। সারের মাত্রা নির্ভর করে সেই অঞ্চলের মাটি ও জলবায়ুর উপর। গাছ প্রতি ১৫ গ্রাম বোরন (Boron) ও ক্যালসিয়াম ফলের বিকৃতি নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে। সাধারণভাবে, বোরন ও ক্যালসিয়ামের ঘাটতি এবং নাইট্রোজেনের আধিক্য ফল ফেটে যাওয়ার জন্য দায়ী। গাছের বয়স অনুসারে এনপিকে (নাইট্রোজেন, ফসফরাস ও পটাশিয়াম) মাত্রা: বছরে গাছ পিছু এনপিকে দিতে হবে ৬০০: ৮০০: ৮০০ গ্রাম হারে। মৃত্তিকা সংশোধন করতে হবে প্রয়োজন অনুসারে। খামার সার গাছ প্রতি দিতে হবে ৫০-১০০ কেজি হারে। বছরে গাছ প্রতি সলফার দিতে হবে ১০-২০ গ্রাম হারে। অণুখাদ্যও দেওয়া প্রয়োজন। জিঙ্ক সালফেট, বোরাক্স, কপার সালফেট ও অ্যামোনিয়াম মলিবডেট দিতে হবে ৫:১:০.১:০.০১ হারে। একর প্রতি জিঙ্ক সালফেট ১০ কেজি, বোরাক্স ৪ কেজি ও অ্যামোনিয়াম মলিবডেট ৪০০ গ্রাম হারে দিতে হবে। খামার সার, এনপিকে, দুই ভাগে ভাগ করে বর্ষার আগে ও পরে প্রয়োগ করতে হবে। অতিরিক্ত সালফার প্রয়োগের প্রয়োজন নেই যদি ফসফরাসের উৎস হিসেবে সিঙ্গেল সুপার ফসফেট প্রয়োগ করা হয়। প্রয়োজনে অণুখাদ্য প্রতি ২-৩ বছর অন্তর প্রয়োগ করতে হবে।
গাছের কয়াদান ও ডালপালা ছাঁটা (Training & Pruning)
গাছের ৩ ফুট উচ্চতা পর্যন্ত কোনও ডাল রাখা চলবে না। গাছের উচ্চতা কম থাকলে ফল তোলার সুবিধা হয়। পরবর্তী পরিচর্যা ও যান্ত্রিকীকরণে সুবিধা হয়। এর ফলে ফলের আকার আকৃতি ও গুণগত মান বৃদ্ধি পায়। এছাড়াও প্রতিবছর শুকনো, রোগ লাগা এবং অনিয়ন্ত্রিত ডালপালা ছেঁটে ফেলতে হবে।
ফুল ও কচি ফল পাতলা করা
প্রতি বোঁটায় এক থেকে দুটি ফল থাকবে। ফুলের সংখ্যা প্রতি গাছে ৫০ থেকে ২০০টি করতে হবে।
পাতলা করার উপকারিতা
ফলের আকার ও গুণগতমান বজায়। পাতলা করে দেওয়া কচি ফল বাজারে মূল্য বেশি। সবজি হিসেবে ব্যবহার করা যাবে। পাতলা করার জায়গায় নিম তেল ব্যবহার করলে ফল ছিদ্রকারী পোকা এবং ফল পচা রোগ হবে না।
[আরও পড়ুন: ‘আমার বিরুদ্ধে একটাও কথা বললে…’, কেজরিওয়ালের অসম সফরের আগে হুঁশিয়ারি হিমন্তর]
সাথী ফসল
প্রথম কয়েক বছর গাছের মধ্যে ফাঁকা জায়গাতে বাড়তি লাভের জন্য বিভিন্ন সাথী ফসলের চাষ করা যেতে পারে। সাথী ফসল নির্বাচন এমন হবে, যাদের জল এবং খাদ্যের চাহিদা তুলনামূলক ভাবে কম, যেমন-কুমড়ো, শাক, টম্যাটো, বেগুন, লঙ্কা, পেঁয়াজ, রসুন ইত্যাদি। শিম্ব জাতীয় ফসল যেমন-কলাই, বিনস, বরবটি, মুগ, সোয়াবিন ছোলা ইত্যাদির চাষ আয়ের সঙ্গে জমির উর্বরতা শক্তিও বৃদ্ধি পায়। মাটির আর্দ্রতা বেশি হলে বা ভূ-পৃষ্ঠের স্থায়ী জলস্তর কাছাকাছি হলে অর্থকরী ফসল হিসাবে আনারসের চাষ করা যায়।
ফুল ও ফল ধারণ
কাঁঠাল একটি সহবাসী জাতের গাছ। সাধারণত জলদি জাতে নভেম্বর-ডিসেম্বর, নাবি জাতে জানুয়ারী-মার্চ এবং দো-ফলার ক্ষেত্রে ডিসেম্বর-ফেব্রুয়ারি এবং জুলাই-আগস্ট মাসে ফুল আসে। এতে স্ত্রী ও পুরুষ মঞ্জরী একই গাছে থাকে, কিন্তু আলাদা ভাবে বেরোয়। সাধারণত স্ত্রী মঞ্জুরীর বৃত্ত মোটা, উপরের অংশ দানাদানা বা গুটিকাকার এবং গাছের গুঁড়ি, মোটা কান্ড ও ডাল হতে জন্মায়। পুরুষ মঞ্জরীর উপরিভাগ বেশ নরম, মসৃণ ও ছোট হয়। পরাগরেণু বেরিয়ে যাওয়ার পর ১-২ সপ্তাহের মধ্যে ছত্রাক আক্রমণের ফলে কালো রং ধারণ করে এবং গাছ থেকে ঝরে পড়ে একে সাধারণত মুচি ঝরা বলে।কাঁঠাল ইতর পরাগী গাছ। এখানে কীট পতঙ্গ এবং বায়ু দ্বারা পরাগ মিলন ঘটে। স্ত্রী মঞ্জরীর সমস্ত উপরিপৃষ্ঠে পরাগ মিলন না হলে ফলের গঠন, বৃদ্ধি ও আকারের সমতা থাকে না। কিছু জাতে স্ব-অসঙ্গতি দেখা যায়। সেক্ষেত্রে বিচ্ছিন্ন অবস্থায় গাছ থাকলে প্রথম দিকে গাছে ছোট ফল থাকলেও পরের দিকে সব ফল ঝরে যায়। স্ত্রী মঞ্জরীতে পরাগ মিলনের পর সমগ্র পুষ্পমঞ্জরী (মঞ্জরী দণ্ড, ডিম্বাশয়, পুষ্পপুট) এক সাথে বিকশিত হয়ে যৌগিক (সংযুক্ত) ফল তৈরি করে। উদ্ভিদবিদের ভাষায় এই জাতীয় ফলকে সোরোসিস বলে। ফলে প্রচুর কোষ বা কোয়া থাকে। এগুলোই প্রকৃতপক্ষে ফল।ফল ধারনের পর এক মাস অন্তর দু-বার সেচ দিলে ফলন বাড়ে। ফল কাটার পর ভাদ্র মাসে মূল কান্ডের সমস্ত ডাল পালা, শাখা ও ফলের ডাঁটি গাছের গা ঘেঁসে ছেঁটে দিতে হবে। গাছের গুড়ি ও প্রধান শাখাতে বিভন্ন জায়গায় দা-এর আঘাতে ৪৫ কোণ করে ১-২ সেমি গভীর ক্ষত সৃষ্টি করে দিলে পরের বছর বেশি মাত্রায় ফুল ও ফল আসে।
ফল পরিপক্কতা এবং ফল কাটা
সবজি হিসাবে এঁচোড় কাটা হয় বাজারের চাহিদার উপর নির্ভর করে। যদিও ফলের ডাঁটি সবুজ এবং বীজ শক্ত হওয়ার আগে বাজারের চাহিদা থাকে সব থেকে বেশি।ফল পাকতে ১২০-১৫০ দিন সময় লাগে। সাধারণত জ্যৈষ্ঠ-আষাঢ় মাসে কাঁঠাল সংগ্রহ করা হয়। পরিপক্ক হলে ফলের কাঁটা ভোতা ও চেপ্টা এবং ছড়ানো হয়, ছাল হালকা সবুজ বা বাদামি রঙ ধারণ করে, বোঁটার আঠা সাদা এবং গাঢ় হয়। লাঠি দিয়ে আঘাত করলে পাকাফলে ড্যাবড্যাব শব্দ হয়। বয়স ও জাত অনুযায়ী গাছে ফলের সংখ্যা নির্ভর করে। বড় আকারের ফল হলে সংখ্যায় কম হয়, অন্যদিকে হাজারী জাতের গাছে (প্রতি ফলের ওজন ১.৪ কেজি। ফলের সংখ্যা ৫০০-১০০০ পর্যন্ত হয়। পরিপক্ক ফল কাটার পর ৩-১০দিন সংরক্ষণ করা যায়।
[আরও পড়ুন: এবার জন্ম তারিখ নিয়ে বিতর্কে শতরূপ ঘোষ, শুভেচ্ছা কুড়োতে ব্যবহার করেন লেনিনের জন্মদিন!]
রোগ-পোকার প্রতিকার (Disease-paste management)
কাঁঠালের কীটশত্রু:
কাঁঠালের প্রধান কীটশত্রুগুলি হল কাণ্ড ছিদ্রকারী পোকা, ফল ছিদ্রকারী পোকা, দয়ে পোকা, ছাল ক্ষত সৃষ্টিকারী শুককীট এবং জাব পোকা।
ক) কাণ্ড ছিদ্রকারী পোকা:
চেনার উপায়
পূর্ণাঙ্গ: ছোট মোটা ফাকাসে বাদামী মথ ঢেউখেলানো ধূসর ডানা। শুঁয়োপোকা হালকা বাদামী রঙের হয়।
ক্ষতির লক্ষণ: এই পোকার কীড়া গাছের কাণ্ড এবং শাখা প্রশাখায় ছিদ্র করে ভিতরে প্রবেশ করে এবং কুরে কুরে খেয়ে নালির সৃষ্টি করে। ফলে গোটা গাছ ফাঁপা হয়ে যায় ও পাতা ঝরে যায়। আক্রমণ তীব্র হলে, আক্রান্ত অংশের উপরের দিকে ধীর ধীরে শুকিয়ে যায় এমনকী গাছটি মারাও যেতে পারে। আক্রান্ত স্থানের বাইরের দিকে কাঠের বিষ্ঠা ঝুলে থাকতে দেখা যায়।
খ) ফল ছিদ্রকারী পোকা
ক্ষতির লক্ষণ: এরা ফলের মধ্যে প্রবেশ করে ফলের ভিতরের শাঁসও খেয়ে ফেলে। এই পোকা কচি অবস্থায় এমনকী মঞ্জরী দশায় ফলে আক্রমণ করে। সাধারণত ফলের বোঁটার দিকে ডিম পাড়ে এবং ডিম ফুটে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কীড়া ফলের ভিতরে প্রবেশ করে। বাড়ন্ত ফলের ভিতরের অংশ খেতে থাকে এবং বাইরের দিকে বাদামী রংয়ের বিষ্ঠা ফলের গায়ে লেগে থাকতে দেখা যায়। ক্ষতস্থানে পরবর্তীতে সহজেই ছত্রাকের আক্রমণ হয় এবং ফলে পচন ধরে আংশিক বা সম্পূর্ণরূপে নষ্ট হয়ে যায়।