শীতকালেই সাধারণত জারবেরা ফুলের চাষ করা হয়। তবে সারা বছরই গ্রিন/পলি হাউসে জারবেরা উৎপাদন করা সম্ভব। সমস্তরকম ব্যবস্থাপনা ও পরিচর্যা সত্ত্বেও বিভিন্ন রকম রোগের কারণে চাষিরা ব্যাপক লোকসানের সম্মুখীন হন। লোকসান এড়াতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ করা জরুরি। লিখেছেন বিধানচন্দ্র কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদ রোগতত্ত্ব বিভাগের গবেষক গোপাল চৌধুরী।
ফুল আমাদের সকলেরই প্রিয়। ফুলের সৌন্দর্য, বর্ণ, গন্ধ সকলকে মুগ্ধ করে। ধর্মীয় ও সামাজিক অনুষ্ঠান ছাড়াও ঘর সাজানো, বিয়ের গাড়ি সাজানো, রিসেপশনের ডেস্ক সাজানো, অঙ্গসজ্জা এমনকী প্রেম নিবেদন, সবেতেই ফুলের ব্যবহার বিস্তর। ফুলের বাড়ন্ত চাহিদার জন্য বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে বাণিজ্যিক চাষ প্রসারিত হচ্ছে। পশ্চিমবঙ্গে বাণিজ্যিক ভাবে চাষ হওয়া ফুলের মধ্যে জারবেরা অন্যতম প্রধান ফুল। ফুলদানিতে দীর্ঘদিন সতেজ থাকে বলে দেশী ও আন্তর্জাতিক কাট ফ্লাওয়ার (ডাঁটি যুক্ত ফুল)-এর বাজারে চাহিদা সব সময় থাকে।
স্থানীয় বাজারে অফ সিজনে একটি ফুল ৩০-৬০ টাকা ও শীতের মরশুমে ১০-২০ টাকা দরে বিক্রি হয়। বিপুল চাহিদা ও লাভের সম্ভাবনা দেখে ফুলচাষিরা জারবেরা চাষে আগ্রহ দেখাচ্ছেন। শীতকালেই সাধারণত এই ফুলের চাষ করা হয়। তবে সারা বছরই গ্রিন/পলি হাউসে জারবেরা উৎপাদন করা সম্ভব। সমস্ত রকম ব্যবস্থাপনা ও পরিচর্যা সত্ত্বেও বিভিন্ন রকম রোগের কারণে জারবেরা চাষ বিঘ্নিত হয়। ফলে চাষীরা ব্যাপক লোকসানের সম্মুখীন হন। তাই লোকসান এড়াতে জারবেরার রোগ বালাই ও তাদের ব্যবস্থাপনা সম্বন্ধে অগ্রিম ধারণা ও পরিকল্পনা রাখা অত্যন্ত জরুরি। এই প্রবন্ধে জারবেরার গুরুত্বপূর্ণ কিছু রোগ ও তাদের ব্যবস্থাপনা নিয়ে আলোচনা করা হল।
কোয়ানিফোরা নেক রট:
কোয়ানিফোরা নামক ছত্রাকের সংক্রমণের ফলে এই রোগ হয়। ফুলের ডাঁটি বের হওয়ার পরই এই রোগের সূচনা ঘটে। পরিচর্যা করার সময় কিংবা পোকামাকড় দ্বারা ডাঁটি ক্ষত হলে ছত্রাক সহজেই আক্রমণ করতে পারে। ফুলের নীচে ডাঁটিতে প্রথমে বাদামী রঙের জলে ভেজা দাগ লক্ষ্য করা যায়। পরে ওই অংশ পচে যায় এবং ফুলটি নুইয়ে পড়ে। পচে যাওয়া স্থানে কালো ছাতার মতো ছত্রাকের বৃদ্ধি দেখতে পাওয়া যায়। গরম ও আর্দ্র আবহাওয়া এই রোগের প্রাদুর্ভাব বাড়ায়।
ব্যবস্থাপনা:
(ক) গাছ ও সারির সঠিক দূরত্ব বজায় রাখতে হবে।
(খ) খেত পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে ও আগাছা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।
(গ) পরিচর্যা করার সময় যাতে ডাঁটি ক্ষত না হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।
(ঘ) পোকার হাত থেকে গাছকে রক্ষা করতে কীটনাশক যেমন ক্লোরপাইরিফস অথবা সাইপারমেথ্রিন ২ এমএল প্রতি লিটার জলে গুলে স্প্রে করতে হবে।
(ঙ) লক্ষণ দেখা দিলে কিংবা বৃষ্টি হলে প্রতিরোধ মূলকভাবে কপার অক্সিক্লোরাইড ৫০% ডাব্লুপি ৪ গ্রাম প্রতি লিটার জলে গুলে স্প্রে করতে হবে।
বট্রাইটিস ব্লাইট:
বট্রাইটিস সিনেরিয়া নামক ছত্রাক এই রোগের কারণ। অতিরিক্ত আর্দ্রতা ও গরম এই রোগের জন্য অনুকূল। ডাঁটিতে লম্বা বাদামী রঙের দাগ দেখা যায়।। পাপড়িগুলো তামাটে রঙের হয়ে যায়। মাটি সংলগ্ন কাণ্ড পচে যায় ও পাতা হলদে হয়ে আসে। সংক্রমিত জায়গা গুলি পচে যায় ও ধূসর বর্ণের ছত্রাকের আস্তরণ লক্ষ্য করা যায়।
ব্যবস্থাপনা:
(ক) গাছের সঠিক দূরত্ব বজায় রাখতে হবে ও যাতে পর্যাপ্ত বাতাস চলাচল করে সেদিকে নজর দিতে হবে।
(খ) কোনও ভাবেই জল জমতে দেওয়া যাবে না। মাটির আর্দ্রতা যাতে না বেড়ে যায় তার জন্য সেচ সকালের দিকে দিতে হবে।
(গ) নিয়মিত ক্ষেত পরিদর্শন করে মরে যাওয়া গাছ ও পাতা পরিষ্কার করতে হবে ও আগাছা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।
(ঘ) বৃষ্টি হলে প্রতিরোধ মূলক ভাবে কপার অক্সিক্লোরাইড ৫০% ডাব্লুপি ৪ গ্রাম প্রতি লিটার জলে গুলে বা ম্যানকোজেব ৭৫% ডাব্লুপি ২ গ্রাম প্রতি লিটার জলে গুলে স্প্রে করতে হবে।
(ঙ) লক্ষণ দেখা দিলে ছত্রাকনাশক যেমন ক্যাপটান ৫০% ডাব্লুপি (৩-৪ গ্রাম প্রতি লিটার জলে) বা ম্যানকোজেব ৭৫% ডাব্লুপি (২ গ্রাম প্রতি লিটার জলে) বা কার্বেন্ডাজিম ৫০% ডাব্লুপি (১.৫ গ্রাম প্রতি লিটার জলে) ১০-১৪ দিন অন্তর স্প্রে করতে হবে।
[আরও পড়ুন: কৃষিজমির অভাব? বাড়িতে থাকা বস্তায় আদা চাষেই বিপুল লক্ষ্মীলাভের সম্ভাবনা]
পাউডারি মিলডিউ:
এরিসিফি চিকোরেসিয়ারাম নামক ছত্রাকের সংক্রমণের ফলে এই রোগের সৃষ্টি হয়। পূর্ণ বিকশিত গাছে এই রোগের প্রাদুর্ভাব বেশি দেখা যায়। প্রথমে ধূসর বর্ণের ছোপ ছোপ দাগ দেখা যায় ও পরে সেগুলি সাদাটে ছাতার মতো হয়ে যায়। ধীরে ধীরে সমস্ত পাতা, গাছ, ডাঁটি ও ফুলে পাউডারের মতো সাদা রেণুর আবরণ পড়ে যায়। সালোকসংশ্লেষ বাধা প্রাপ্ত হয়। তাই গাছের বৃদ্ধি ও ফুলের বিকাশ ব্যাহত হয়। যার ফলে লাভজনক ফলন পাওয়া যায় না।
ব্যবস্থাপনা:
(ক) খেত পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে ও আগাছা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।
(খ) প্রতিরোধী ও সহনশীল জাত রোপণ করতে হবে।
(গ) রোগের লক্ষণ দেখা দিলে ছত্রাকনাশক যেমন ওয়েটেবল সালফার (২ গ্রাম প্রতি লিটার জলে) বা ডাইনোক্যাপ ৪৮% ইসি (১ মিলি, প্রতি লিটার জলে) বা ডাইফেনোকোনাজোল ২৫% ইসি (০.৫-১.০ মিলি, প্রতি লিটার জলে) বা ফেনারিমল ১০% ইসি (০.৪ মিলি, প্রতি লিটার জলে) বা কার্বেন্ডাজিম ৫০% ডাব্লুপি (২ গ্রাম প্রতি লিটার জলে) ১০ থেকে ১৫ অন্তর স্প্রে করতে হবে।
ফাইটোফথোরা ক্রাউন রট:
ক্রাউন রট অর্থাৎ গোড়া পচা। ফাইটোফথোরা ক্রিপ্টোজিয়া নামক ছত্রাকের সংক্রমণের ফলে এই রোগের সৃষ্টি হয়। পাতা বাদামী রঙের হয়ে যায়। গাছের গোড়া, যেখান থেকে পাতা ও ডাঁটি বের হয়, পচে যায়। সম্পূর্ণ গাছ ও ফুল দ্রুত ঢলে পড়ে। ভেজা আবহাওয়ায় এই রোগ দ্রুত ছড়ায়।
ব্যবস্থাপনা:
(ক) নিয়মিত ক্ষেত পরিদর্শন করতে হবে। পচা ও রোগাক্রান্ত গাছ উপড়ে ফেলে ক্ষেতের বাইরে পুড়িয়ে কিংবা পুঁতে ফেলতে হবে।
(খ) রোগমুক্ত চারা রোপণ করতে হবে ও জমিতে জল জমতে দেওয়া যাবে না।
(গ) সুপারিশ মাত্রায় নাইট্রোজেন প্রয়োগ করতে হবে।
(ঘ) রোপণ করার আগে চারার শিকড় ম্যানকোজেব দ্রবণে (৪ গ্রাম প্রতি লিটার জলে) ১৫-২০ মিনিট ভিজিয়ে নিতে হবে।
(ঙ) লক্ষণ দেখা দিলে কপার অক্সিক্লোরাইড ৫০% ডাব্লুপি (৪ গ্রাম) কিংবা মেটাল্যাক্সিল + ম্যানকোজেব ২ গ্রাম প্রতি লিটার জলে গুলে গাছের গোড়া ভিজিয়ে স্প্রে করতে হবে।
রাইজোক্টোনিয়া ক্রাউন রট:
রাইজোক্টোনিয়া সোলানিনামক ছত্রাক এই রোগের জন্য দায়ী। গাছের গোড়ায় বাদামী ক্ষত লক্ষ্য করা যায়। পরে ওই অংশ পচে যায়। পাতাগুলি হলুদ হয়ে শুকিয়ে যায়। ফুলের ডাঁটির গোড়া পচে গিয়ে ঢলে পড়ে। গাছের গোড়ায় সাদা তুলোর মতো কিংবা কালো সরষের দানার মতো ছত্রাক-এর গঠন দেখতে পাওয়া যায়।
ব্যবস্থাপনা:
(ক) নিয়মিত ক্ষেত পরিদর্শন করতে হবে। পচা ও রোগাক্রান্ত গাছ উপড়ে ফেলে ক্ষেতের বাইরে পুড়িয়ে কিংবা পুঁতে ফেলতে হবে
(খ) রোগমুক্ত চারা রোপণ করতে হবে।
(গ) রোপণ করার আগে চারার শিকড় ম্যানকোজেব দ্রবণে (৪ গ্রাম প্রতি লিটার জলে) ১৫-২০ মিনিট ভিজিয়ে নিতে হবে।
(ঘ) লক্ষণ দেখা দিলে জৈব প্রতিরোধক যেমন সিউডোমনাস ফ্লুওরেসেন্স ২ গ্রাম প্রতি লিটার জলে কিংবা ম্যানকোজেব + কার্বেন্ডাজিম ২.৫ গ্রাম পরিমাণ প্রতি লিটার জলে গুলে গাছের গোড়া ভিজিয়ে স্প্রে করতে হবে।
শিকড় পচা:
পিথিয়াম নামক ছত্রাক আক্রমণ করলে জারবেরার শিকড় পচে যায়। অল্পবয়সী গাছে সাধারণত এই রোগ বেশি দেখা যায়। আক্রান্ত গাছ ঢলে পড়ে। শিকড় পচে যায় ও খুব সহজেই উপড়ে ফেলা যায়। জমিতে অতিরিক্ত আর্দ্রতা এই রোগের আশঙ্কা বাড়ায়।
ব্যবস্থাপনা:
(ক) নিয়মিত ক্ষেত পরিদর্শন করতে হবে। রোগাক্রান্ত গাছ উপড়ে ফেলে ক্ষেতের বাইরে পুড়িয়ে কিংবা পুঁতে ফেলতে হবে।
(খ) রোগমুক্ত চারা রোপণ করতে হবে।
(গ) সুপারিশ মাত্রায় নাইট্রোজেন প্রয়োগ করতে হবে।
(ঘ) রোপণ করার আগে চারার শিকড় ম্যানকোজেব দ্রবণে (৪ গ্রাম প্রতি লিটার জলে) ১৫-২০ মিনিট ভিজিয়ে নিতে হবে।
(ঙ) লক্ষণ দেখা দিলে কপার অক্সিক্লোরাইড ৫০% ডাব্লুপি (৪ গ্রাম) কিংবা মেটাল্যাক্সিল + ম্যানকোজেব ২ গ্রাম প্রতি লিটার জলে গুলে গাছের গোড়া ভিজিয়ে স্প্রে করতে হবে।
ব্যাকটেরিয়াজনিত পাতার দাগ:
সিউডোমনাস চিকোরি নামক ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ হলে এই রোগের সৃষ্টি হয়। প্রথমে ছোট থেকে বড় গোল গোল জলে ভেজা দাগ দেখা যায়। পরে সেগুলি বড় হয়ে একসঙ্গে মিশে যায়। দাগগুলি পরে গাঢ় বাদামী রঙের হয়ে যায়। বৃষ্টিপাত, অতিরিক্ত আর্দ্রতা ও স্প্রিংকলার সেচ, ব্যাকটিরিয়াজনিত এই রোগের প্রবণতা বাড়ায়।
ব্যবস্থাপনা:
(ক) রোগমুক্ত এবং প্রতিরোধী ও সহনশীল চারা রোপণ করতে হবে।
(খ) পরিচর্যা করার সময় লক্ষ্য রাখতে হবে যাতে গাছে কোনও ক্ষত না হয়। কারণ এই ক্ষতের মাধ্যমে ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ ঘটে।
(গ) যদি লক্ষণ দেখা যায়, স্প্রিংকলার সেচ ব্যবস্থা বন্ধ রাখতে হবে।
(ঘ) এই রোগের লক্ষণ দেখা দিলে কপার অক্সিক্লোরাইড ৫০% ডাব্লুপি (৪ গ্রাম প্রতি লিটার) কিংবা স্ট্রেপ্টোসাইক্লিন (১-১.৫ গ্রাম প্রতি ১০ লিটার) জলে গুলে স্প্রে করতে হবে।
রুট নট বা শিকড়ে গিঁট রোগ:
মেলয়ডিগায়েন ইনকগনিশিয়া নামক এক ধরনের কৃমির আক্রমণের ফলে এই সমস্যা দেখা দেয়। আক্রান্ত গাছের শিকড় ছোট ছোট টিউমারের মতো গিঁটের আকৃতি ধারণ করে। শিকড় আক্রান্ত হওয়ায় জল ও খনিজ সরবরাহ ব্যাহত হয়। ফলে গাছের বৃদ্ধি হয় না। পাতা হলুদ হয়ে ঢলে পড়ে। আক্রান্ত গাছে ফুল আসে না। আর এলেও তা বাজার যোগ্য হয় না।
ব্যবস্থাপনা:
(ক) কৃমির আক্রমণের ইতিহাস আছে এমন জমিতে জারবেরা চাষ করা থেকে বিরত থাকতে হবে।।
(খ) কৃমি বা কৃমির ডিম নষ্ট করার জন্য গ্রীষ্মের সময়ে (এপ্রিল-জুন) জমি ভাল করে চাষ দিয়ে ফেলে রাখতে হবে।
(গ) জমি তৈরি করার সময় প্রতি বর্গ মিটারে ১ কেজি করে নিম খোলের সঙ্গে পেসিলোমাইসিস লিলাসিনাস (Paecilomyces lilacinus) নামক জৈব কৃমিনাশক ছত্রাক প্রয়োগ করতে হবে।
(ঘ) রাসায়নিক কৃমিনাশক যেমন ফ্লুওপাইরাম ০.৭ মিলি প্রতি লিটার জলে গুলে স্প্রে করতে হবে কিংবা ফ্লুএনসালফন একর প্রতি ২.৫ কেজি হারে চারা রোপণ করার অন্তত ৭-১০ দিন আগে প্রয়োগ করতে হবে।