shono
Advertisement

আখ চাষে প্রধান বাধা পোকা, রোগ ঠেকালেই বিপুল আয়ের সম্ভাবনা

বিশেষত বর্ষাকালে বা বর্ষা পরবর্তী আবহে এই রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটে।
Posted: 03:17 PM May 04, 2022Updated: 03:17 PM May 04, 2022

আনুমানিকভাবে পোকামাকড়ের আক্রমণে ২০% এবং রোগবালাই দ্বারা ১৯% আখের উৎপাদন হ্রাস পাচ্ছে। আখের উৎপাদন বাড়িয়ে তুলতে, রোগ ও পোকার আক্রমণ থেকে ফসল বাঁচানোই হল একমাত্র তাৎপর্যপূর্ণ উপায়। লিখেছেন বিধানচন্দ্র কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদ রোগতত্ত্ব বিভাগের গবেষক নাজনিন খাতুন।

Advertisement

গ্রীষ্মকাল হল আখের ভরা মরসুম। এই গরমে ডিহাইড্রেশন থেকে বাঁচতে ‘সামার ড্রিংকস’ হিসেবে আখের রস অত্যন্ত উপকারী পানীয়। এছাড়াও দৈনন্দিন জীবনে ইমিউনিটির দৌড়েও অনেকাংশেই এগিয়ে আখ, কারণ এতে রয়েছে প্রচুর পরিমাণ অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট, যা শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়িয়ে তোলে। ব্রাজিলের পরে ভারতবর্ষ বিশ্বের বৃহত্তম আখ উৎপাদনকারী দেশ। সারা দেশে সর্বত্রই খুব কম দামে সহজেই পাওয়া যায়। রস ছাড়াও চিনি, গুড়, রাম, জৈব জ্বালানি এবং ইথানলের মতো অন্তত এক ডজন অন্যান্য উপজাতের মূল উপাদান হলো আখ। বিশ্বের ৮০% চিনির চাহিদা মেটে আখ থেকে।

ভারতের প্রথম চিনিকল ১৯০৩ সালে বিহারের প্রতাপপুরে এবং প্রথম আধুনিক চিনি মিল ১৯৩৩ সালে কর্ণাটকে প্রতিষ্ঠিত হয়। এছাড়াও কৃষি শিল্পের অন্যতম উপজাত পদার্থ আখের ছিবড়া। এটি একাধিক পুষ্টিগুণ সম্পন্ন যা পালিত পশুর খাবার হিসেবে ব্যবহৃত হয়। উৎপাদন থেকে চিনি নিষ্কাশন পদ্ধতির মধ্যে আখ চাষ বেশ কয়েক রকম সমস্যার সম্মুখীন হয়। রোগ পোকার আক্রমণ তার মধ্যে অন্যতম ভূমিকা পালন করে। আনুমানিক ভাবে পোকা মাকড়ের আক্রমণে ২০% এবং রোগ বালাই দ্বারা ১৯% আখের উৎপাদন হ্রাস পাচ্ছে। আখের উৎপাদন বাড়িয়ে তুলতে, রোগ ও পোকার আক্রমণ থেকে ফসল বাঁচানোই হল একমাত্র তাৎপর্যপূর্ণ উপায়। কৃষি পরিবেশগত অবস্থার বৈচিত্র্য অনুযায়ী এই রোগ নিয়ন্ত্রণের কৌশল গ্রহণ করা প্রয়োজন।
আখ চাষের কিছু ক্ষতিকর রোগ বালাই ও তার প্রতিকার:
লাল পচা রোগ:
আখ চাষের অন্যতম প্রধান শত্রু হল লাল পচা রোগ। এই রোগে আক্রান্ত আখের ওজন স্বাভাবিকের তুলনায় প্রায় ২৯-৮৩% কমে যায়। সঙ্গে রসের পরিমাণও ২৪-৯০% হ্রাস পায়। যা অর্থনৈতিক দিক থেকে অত্যন্ত ক্ষতি সাপেক্ষ। তাই লাল পচা রোগটি ‘আখের ক্যানসার’ নামেও আখ্যায়িত হয়েছে। কোলেটোট্রিকাম নামক ছত্রাক এই রোগের জন্যে দায়ী।
লক্ষণ:
১) রোগাক্রান্ত আখ লম্বালম্বি চিড়লে কাণ্ডের ভিতরে লম্বালম্বি লাল দাগ দেখা যায় এবং দাগের মাঝে মাঝেআড়াআড়িভাবে সাদা দাগ দৃশ্যমান হয়। এই দাগই এই রোগের মূল বৈশিষ্ট্য সূচক চিহ্ন।
২) আক্রান্ত গাছ থেকে পচা বা খানিকটা অ্যালকোহলের ন্যায় গন্ধ বেরোয়।
৩) পরবর্তীতে আক্রান্ত আখ ভিতরে ফাঁপা হয়ে যায়।
৪) বাইরে থেকে পাতার মধ্যশিরা দেখেও রোগ লক্ষণ বোঝা যায়। কারণ রোগ সংক্রমিত গাছের পাতার মধ্য শিরা অঞ্চল লাল বর্ণ ধারণ করে।
৫) পরবর্তীতে অন্যান্য পাতাও হলদে হয়ে শুকিয়ে যায়।
৬) রোগাক্রান্ত আখ কিছু দিনের মধ্যে শুকিয়ে মারা যায়।
৭) এই রোগটি প্রকৃত মাটি বাহিত না হলেও ফসলের অবশিষ্টাংশ থেকে মাটিতে ঝরে পড়া ছত্রাকের স্পোর বা বীজগুলো সদ্য রোপণ করা আখের চারায় সংক্রমণ ঘটায়। এছাড়াও বাতাসের মাধ্যমে বা বৃষ্টি, ভারী শিশির ও সেচের জল দ্বারাও সংক্রমণ ছড়ায়।

[আরও পড়ুন: পুরনো চাল ভাতে বাড়ে! নোনা মাটিতে হারিয়ে যাওয়া ধানের ফলন বাড়াতে জোর কৃষিদপ্তরের]

নিয়ন্ত্রণ কৌশল:
১) মুড়ি আখ চাষের ক্ষেত্রে এই রোগের প্রাদুর্ভাব অত্যন্ত বেশি তাই রোগ মুক্ত চারা বা বীজ চাষের কাজে ব্যবহার করতে হবে।
২) নিয়মিত মাঠ পর্যবেক্ষণ করতে হবে এবং প্রাথমিক অবস্থায় রোগের লক্ষণ দেখা দিলেই আক্রান্ত গাছ জমি থেকে উপড়ে ফেলতে হবে।
৩) ফসল তোলার পর জমিতে একাধিকবার লাঙ্গল দিয়ে চাষ দিতে হবে যাতে রোগাক্রান্ত ফসলের অবশিষ্টাংশ সূর্যালোকে উন্মুক্ত হয়।
৪) ২-৩ বছর অন্তর শস্য আবর্তন অত্যাবশ্যকীয়।
৫) ৩ মি.লি. পরিমাণ মানকোজেব ৭৫ ডব্লিউপি প্রতি লিটার জলে গুলে অথবা ১ মিলি পরিমাণ আজোক্সিস্ট্রবিন ১৮.২ এসসি এবং ডাইফেনকনাজোল ১১.৪ এস.সি. প্রতি লিটার জলে গুলে স্প্রে করতে হবে।
আখের ঢলে পড়া রোগলক্ষণ:
১) মাটির নিকটবর্তী আখের গিঁট অংশের লম্বচ্ছেদ করলে ভিতরে গাঢ় লালচে বেগুনী থেকে বাদামী বর্ণের ছোপ ছোপ কিছু গর্ত অংশ চোখে পড়ে এবং বাইরে গাছের পাতা হলুদ হয়ে ধীরে ধীরে শুকোতে থাকে।
২) সংক্রমণ বৃদ্ধির সাথে সাথে আক্রান্ত গাছটি ক্রমশ নিস্তেজ হয়ে নুইয়ে পড়ে।
৩) এই রোগের জীবাণুটি মূলত মাটি, সেচ বা বৃষ্টির জল ও কখনও বায়ু দ্বারা বাহিত হয়।
৪) বিশেষত বর্ষাকালে বা বর্ষা পরবর্তী আবহে এই রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটে।
নিয়ন্ত্রণ কৌশল :
১) ঢলে পড়া রোগ নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে প্রতিরক্ষামূলক নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাগুলি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ, যেমন অত্যধিক মাত্রায় নাইট্রোজেন সারের প্রয়োগ এড়িয়ে চলতে হবে।
২) খেতের জল নিকাশি ব্যবস্থার ওপর বিশেষ নজর দিতে হবে।
৩) চাষের সময় নজর রাখতে হবে জানে গাছ কোনো ভাবে আঘাতপ্রাপ্ত না হয়,
৪) ফসল কাটার পর গাছের অবশিষ্টাংশ জমি থেকে নির্মূল করে ফেলতে হবে।
৫) গাছ রোগাক্রান্ত হলে প্রাথমিক পর্যায়ে ১.৮ গ্রাম পরিমাণ কপার অক্সিক্লোরাইড ৫০ ডাব্লিউসি প্রতি ৫ লিটার জলে গুলে প্রয়োগ করতে হবে।
স্মাট রোগ / আখের কালো শীর্ষ রোগলক্ষণ:
১) এই রোগের সংক্রমণে আখের অগ্রভাগ অংশ থেকে চাবুকের মতো আকৃতির ২৫-১৫০ সে.মি. দৈর্ঘ্যের একটি সরু অংশ চোখে পড়ে।
২) এই চাবুকের মত অংশটিতে কালো কালো পাউডারের গুঁড়োর মতো স্পোর থাকে যা সিলভার বর্ণের একটি পাতলা আস্তরণ দ্বারা বেষ্টিত হয়ে থাকে। এই স্পোরগুলি জলের উপস্থিতিতে অঙ্কুরিত হয়ে বায়ু দ্বারা একটি গাছ থেকে অন্য গাছে খুব সহজেই আক্রমণ করে। এই স্পোর গুলি মাটির মধ্যে বেঁচে থাকে এবং সেচের জল বা বৃষ্টির মাধ্যমেও এক জমি থেকে অন্য জমিতে বাহিত হয়।
৩) রোগ আক্রমণের প্রভাবে আখ দৈর্ঘ্যে ক্রমশ খাটো হতে থাকে।
নিয়ন্ত্রণ কৌশল:
১) রোগ প্রতিরোধী ক্ষমতা সম্পন্ন বীজ চাষের কাজে ব্যবহার করতে হবে।
২) রোগ মুক্ত জমি থেকে চারা সংগ্রহ করতে হবে।
৩) রোপণের পূর্বে ৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াস উষ্ণতার জলে ২ ঘণ্টা ভিজিয়ে বীজ শোধন করা প্রয়োজন।
৪) এছাড়াও প্রতিরোধক হিসেবে ১ মিলি পরিমাণ এ্যাজোকসিস্ট্রবিন ১৮.২ এসসি এবং ডাইফেনোকোনজোল ১১.৪ এসসি প্রতি লিটার জলে গুলে স্প্রে করলে ভালো ফল পাওয়া যাবে।
ব্যাকটেরিয়াজনিত পাতা ঝলসানো রোগলক্ষণ:
১) আখের নবীন বা মধ্যবয়স্ক পাতায় মূলত এই রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা যায়।
২) পাতার প্রধান শিরা বরাবর এবং পাতার গোড়ার দিকে হালকা বাদামী রঙের লম্বাটে দাগ সৃষ্টি হয়।
৩) এই দাগ গুলো পরবর্তীতে একটি আর একটির সঙ্গে জুড়ে আকারে বড় হয়। সমস্ত পাতায় ছড়িয়ে পড়ে ও পাতা গুলো ধীরে ধীরে পচতে শুরু করে। ফলে দুর্গন্ধ ছড়ায়।
৪) সংক্রমণের অন্তিম পর্যায়ে গাছের ডগা ও পুষ্পমঞ্জরি ভেঙে মাটিতে নুইয়ে পড়ে।
৫) অধিক তাপমাত্রায় ও আর্দ্র পরিবেশে আক্রান্ত চারা বা মাটির মাধ্যমে এই রোগ ছড়ায়।

নিয়ন্ত্রণ কৌশল:
১) ব্যাকটেরিয়া জনিত রোগের ক্ষেত্রে জমির জল নিকাশি ব্যবস্থার উপর নজর দেওয়া অত্যন্ত আবশ্যক।
২) পরিমাণ অতিরিক্ত নাইট্রোজেন সারের প্রযোগ থেকে বিরত থাকতে হবে।
৩) বপনের পূর্বে বীজ শোধন করা অত্যাবশ্যক।
আখের গ্র্যাসি সুট রোগলক্ষণ:
১) ৩ বা ৪ মাস বয়সি আক্রান্ত কচি পাতা ফ্যাকাশে বর্ণের হয়ে যায় এবং পাতলা সরু দেখতে লাগে।
২) সংক্রামিত গাছের চেহারা অনেকটা ঘাসের মতো হয়ে যায়।
৩) আক্রান্ত গাছের কুশির বৃদ্ধি হ্রাস পায়।
৪) মুড়ি আখ চাষের ক্ষেত্রে এই রোগ সংক্রমণে কুশি গজায় না। ফলে জমিতে শূন্য স্থানের সৃষ্টি হয়,
৫) মূলত জাব পোকা দ্বারা এই রোগ সৃষ্টিকারী জীবাণুটি বাহিত হয়।
৬) আয়রনের ঘাটতিজনিত রোগের লক্ষণের সঙ্গে এই লক্ষণগুলি অনেকটাই মেলে।

[আরও পড়ুন: উত্তরবঙ্গে উধাও ১৬ প্রজাতির নদীয়ালি মাছ! গবেষণায় উঠে এল চাঞ্চল্যকর তথ্য]

নিয়ন্ত্রণ কৌশল:
১) রোগ প্রতিরোধী জাতের চারা রোপণের কাজে ব্যবহার করা অত্যাবশ্যক।
২) রোপণের পূর্বে লেডারমাইসিন অ্যান্টিবায়োটিক দিয়ে বীজ শোধন করতে হবে।
৩) আক্রান্ত গাছ জমি থেকে উপড়ে ফেলতে হবে।
৪) একই জমিতে বার বার আখ চাষ না করে, ফসল চক্রে অন্যান্য ফসল চাষ করলে রোগের প্রাদুর্ভাব অনেকটা কমে।
৫) জাব পোকার আক্রমণ রুখতে হলুদ আঠালো ট্র্যাপ ব্যবহার করে ভাল ফল মেলে অথবা পোকার আক্রমণ অনেক বেশি হলে, নিয়ন্ত্রক হিসেবে কীটনাশক যেমন, ১ মিলি পরিমাণ ডাইমিথয়েট বা ২ মিলি পরিমাণ মিথাইল-ডেমিটন প্রতি লিটার জলে গুলে ১ মাস অন্তর স্প্রে করতে হবে।
আখের আইস্পট রোগলক্ষণ:
১) পাতার উভয় দিকে লালচে দাগ দেখা যায়।
২) দাগগুলো সাধারণত পাতার মধ্য শিরার সাথে সমন্তরালে হয়।
৩) লাল বা বাদামী কিনারা বেষ্টিত ধূসর বর্ণের দাগগুলো উপবৃত্তাকার আকৃতির হয়।
৪) এই ছোট ছোট দাগগুলো একটি আর একটির সাথে মিশে বড় আকার ধারণ করে।
৫) বাইপলারিস নামক ছত্রাকের আক্রমণে এই রোগ হয়।
নিয়ন্ত্রণ কৌশল :
১) রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা সম্পন্ন চারা রোপনের কাজে ব্যবহার করতে হবে।
২) ০.২% কপার অক্সিক্লোরাইড বা ০.৩% ম্যানকোজেব ১০-১৫ দিন অন্তর ২-৩ বার স্প্রে করলে ভাল
ফল মিলবে।

[আরও পড়ুন: আধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে চাষ করলে বাড়বে আয়, খুঁটিনাটি জানালেন বিশেষজ্ঞরা]

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

Advertisement