ভেষজ গুণে ভরপুর ডুমুর (Fig)। ডায়াবেটিক রোগীদের ক্ষেত্রে ডুমুরের পাতা খুব কার্যকরী। এটি ইনসুলিন ব্যবহারের মাত্রা অনেক কমিয়ে দেয়। আবার এর ফলে প্রচুর পরিমাণে হিমোগ্লোবিন বর্তমান যা রক্তশূন্যতা দূর করতে সহায়ক। এছাড়াও বহুবিধ পুষ্টিগুণ রয়েছে ডুমুরে। আবার স্বল্প খরচে চাষ করেও লক্ষ্মীলাভের সুযোগ। এক একর জমিতে ডুমুর চাষ করলে খরচ বাদে লাভ হতে পারে প্রায় তিন লক্ষ টাকা। লিখেছেন বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিদ্যা বিভাগের প্রাক্তন ছাত্রী মিমোসা ঘোষ।
সৃষ্টির প্রায় আদিকাল থেকেই গাছ তার ভেষজ ও অন্যান্য গুণ দিয়ে কোটি কোটি মানুষের প্রাণ স্পন্দন ঘটাতে সক্ষম হয়েছে। গাছই দিয়েছে জীবন। সমৃদ্ধ করেছে সভ্যতা। সভ্যতার শুরু থেকেই রোগমুক্তির একমাত্র উপায় ছিল ভেষজ উদ্ভিদ। কালে কালে বিজ্ঞানের উন্নতি ঘটলে ও ভেষজ উদ্ভিদের প্রতি আগ্রহ মানুষের কমে যায়নি। শুধু আমাদের দেশেই নয়, বিদেশেও এইসব উদ্ভিদের চাহিদা প্রবল। সেই রকমই এক উদ্ভিদ হল ডুমুর। আমরা অনেকেই জানি এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি ভেষজ উদ্ভিদ। কিন্তু সঠিক চাষ আবাদ বা রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে এইসব উদ্ভিদ ধীরে ধীরে কমে যাচ্ছে চারিদিকে। কিন্তু বাজারে এইসব উদ্ভিদের চাহিদা রয়েছে মারাত্মক এবং চাষি ভাইয়েরা তাঁদের গতানুগতিক চাষ থেকে বেরিয়ে এসে এইসব চাষ করেও স্বল্প খরচে বেশি অর্থ উপার্জন করতে পারবেন।
ডুমুরের বিভিন্ন প্রজাতি রয়েছে। তবে তার মধ্যে ভারতে প্রধানত যেগুলো দেখা যায় সেগুলো হল ইন্ডিয়ান রোক, এলিফ্যান্ট ইয়ার, কৃষ্ণা, ওয়েপিং ফিগ, হোয়াইট ফিগ, ইত্যাদি। বিদেশে এর চাহিদা প্রবল, এই ফলটি সতেজ শুকনো উভয় রূপেই ব্যবহার যোগ্য। সাধারণত শীতকালীন শুষ্ক জলবায়ু এই চাষের জন্য খুব উপকারী। ভারতের কিছু কিছু অঞ্চলে এই চাষের প্রাধান্য দেখা দিচ্ছে। তামিলনাড়ু, কর্ণাটক, মহারাষ্ট্র, গুজরাট, উত্তর প্রদেশ সহ আরও বিভিন্ন অঞ্চলে স্বল্প বিস্তর এটি চাষ করা হয়।
[আরও পড়ুন: ওষধি গুণে বাড়ছে জনপ্রিয়তা, সফেদ মুসলি চাষে লাখপতি কৃষক]
ডুমুর চাষের উপযুক্ত পরিবেশ-সহ মৃত্তিকা এবং চাষের পদ্ধতি:
অনেক জাতের ডুমুর প্রায় কমবেশি সারাবছরই চাষ করা হয়। তবে ভারতের কিছু স্থানে সবুজ ও বাদামি বর্ণের ডুমুর বেশি দেখা যায়।
- বৈজ্ঞানিক নাম: Ficus racemosa
- পরিবার: Moraceae
- এর পুষ্পবিন্যাসটি উদুম্বর বা হাইপ্যানথোডিয়াম টাইপের হয়।
- এই উদ্ভিদ সাধারণত বসন্তে বপন করা উচিত। সাধারণত এটি দুই থেকে তিন বছরের মধ্যে ফল ধারনে উপযোগী হয়। গ্রীষ্মের শেষে বা শরতের শুরুতে এর ফল ধারন শুরু হয়।
- গাছ এমন জায়গায় রোপণ করতে হবে যাতে যথেষ্ট পরিমাণে সূর্যালোক প্রবেশ করে। এরপর দুই ভাগ বেলে ও দোআঁশ মাটি এবং একভাগ গোবর সার, কুড়ি থেকে চল্লিশ গ্রাম এসএসপি সার, পটাশ দুইশো গ্রাম এবং হাড়ের গুঁড়ো সামান্য পরিমাণে একত্রে মিশিয়ে সঠিকভাবে মাটি তৈরি করতে হবে। মাটি যখন খুব ঝুরঝুরে হবে তখন কাটিং বা চারা রোপণ করতে হবে। ডুমুর গাছ সাধারণত কাটিং পদ্ধতিতে ভাল হয়।
- চারাগাছগুলো জমিতে সোজাসুজি ভাবে লাগাতে হবে। সেই সঙ্গে গাছের গোড়ার মাটি কিছুটা উচুঁ করে দিতে হবে এবং হাত দিয়ে চেপে দিতে হবে যাতে গাছের গোড়ার দিকে বেশি জল প্রবেশ না করে।
- চারাগাছ রোপণের প্রথম দিকে কম জল দিতে হবে। পরে ধীরে ধীরে বেশি জল প্রয়োগ করতে হবে এবং লক্ষ্য রাখতে হবে যাতে গাছের গোড়ায় বেশি জল না জমে বা বেশি শুকিয়েও না যায়।
- ডুমুর চাষের জন্য কোনও বিশেষ মাটির প্রয়োজন হয় না। কিন্তু বেলে বা দোআঁশ মাটিতে এর বৃদ্ধি বা ফলন খুব বেশি হয়।
- এই গাছ রোপণের পর নির্দিষ্ট সময় অনুসারে এর পরিচর্যা নিতে হবে। গাছের চারপাশে ঘাস লাগালে খুব ভাল হয়। যা গ্রীষ্মের মরসুমে আর্দ্রতা বজায় রাখবে এবং শীতকালে হিম থেকে উদ্ভিদটিকে রক্ষা করবে।
- তবে বছর বছর গাছের কয়েকটি শক্তিশালী ডালপালা রেখে বাকি ছাঁটাই করে দিলে খুব ভাল হয়। ফলনও বৃদ্ধি পায় এর ফলে। এইভাবে চাষি ভাইয়েরা এই উদ্ভিদটির পরিচর্যা নিতে পারলে খুব কম সময়েই তাঁরা ভাল ফসল পেতে পারবেন।
[আরও পড়ুন: বাড়িতে কৃত্রিম মরুভূমি বানিয়ে দুম্বা চাষ, আয়ের নতুন দিশা দেখালেন মালদহের মিরাজুল]
ডুমুরের উপকারিতা:
ডুমুর খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি ভেষজ এবং বিভিন্ন রোগের ক্ষেত্রে খুব উপকারী। কিন্তু অনেকেই এর সঠিক ব্যবহার জানেন না। তাই অযত্নে অবহেলায় এইসব গাছগুলো বেড়ে ওঠে। কিন্তু এইসব উদ্ভিদের ঠিক মতো চাষ বা রক্ষণেবেক্ষণ করতে পারলে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ঘটবেই। আবার এই ফল খেয়ে মানুষ রোগ থেকে মুক্তি পেতে পারবেন।
১) ডুমুর পাকস্থলীর জন্য খুব উপকারী। কারণ এতে রয়েছে প্রচুর খাদ্য আঁশ।
২) এটি রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে।
৩) এর ফল বা পাতার রস সেবন করলে কোষ্ঠকাঠিন্য সেরে যায়।
৪) শরীরে অ্যাসিডের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখে এবং পিএইচ এরর ভারসাম্য বজায় রাখে।
৫) ডায়াবেটিস রোগীদের ক্ষেত্রে ডুমুরের পাতা খুব কার্যকরী। এটি ইনসুলিন ব্যবহারের মাত্রা অনেক কমিয়ে দেয়। প্রাতরাশের আগে ডুমুর পাতার রস খালি পেটে সেবন করলে ডায়াবেটিস রোগ উপশম হয়।
৬) গবেষণায় দেখা গেছে ডুমুরের পাতা কোলেস্টেরল ও ট্রাইগ্লিসারাইডের মাত্রা কমাতে সাহায্য করে।
৭) এছাড়া এক টেস্টটিউব গবেষণায় দেখা গিয়েছে ডুমুর পাতার রস এক বিশেষ ধরনের ক্যানসার কোষের বৃদ্ধি কমিয়ে দিতে সক্ষম।
৮) এর ফলে প্রচুর পরিমাণে ফাইবার থাকায় দেহকে দীর্ঘ সময়ের জন্য পরিপূর্ণ রাখে।
৯) এর ফলে প্রচুর পরিমাণে হিমোগ্লোবিন বর্তমান যা রক্ত শূন্যতা দূর করতে সহায়ক।
১০) এটি ত্বক, চুল, নখ ইত্যাদি দেহের বিভিন্ন অঙ্গের ক্রিয়া সচল রাখতে সক্ষম। ডুমুরের পেস্ট তৈরি করে মুখে লাগালে ত্বকের যে কোনও সমস্যা দূর হয়।
১১) পর্যাপ্ত ও নিয়মিত পরিমাণ ডুমুর খাদ্যাভ্যাসে রাখলে দ্রুত দেহের ওজন বৃদ্ধি কমে।
আরও বিভিন্ন ধরনের পুষ্টি গুণে ভরপুর এই ডুমুরের বাজার চাহিদাও প্রবল। কিন্তু সঠিক চাষ পদ্ধতির অভাবে ধীরে ধীরে এর অস্তিত্ব বিপন্ন হতে বসেছে। তাই এই সব চাষ করলে চাষিরা অনেক লাভ পাবেন।বিভিন্ন দেশে ডুমুরের চাহিদা খুব বেশি। সৌদি আরব ও বাংলাদেশ এইসব স্থানে প্রচুর পরিমাণে এর চাষ হয়। সেখানে এটি ত্বীন ফল নামে পরিচিত। আবার ভারতের বিভিন্ন স্থানে এবং মিশর, তুরস্ক এইব জায়গাগুলিতে এটি আঞ্জির নামে পরিচিত। এই ফলের উৎপাদন বাণিজ্যিকভাবে করা হয়।
এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ অর্থকরী ফসল। বিদেশে এর চাহিদা প্রবল। এই ফলটি সতেজ ও শুকনো উভয় রূপেই ব্যবহৃত হয়। এছাড়াও পাকা ডুমুর মোরব্বা তৈরিতে ব্যবহার করা হয়। তবে ভারতের বিভিন্ন স্থানে এটি কাঁচা অবস্থায় সবজি হিসেবে ব্যবহার করা হয় বেশি। এটি কার্বোহাইড্রেট, প্রোটিন, ফ্যাট, রাইবোফ্ল্যাভিন, থায়ামিন, ক্যালশিয়াম, আয়রন ইত্যাদি বিভিন্ন পুষ্টি গুণে সমৃদ্ধ।
ডুমুর চাষের গুরুত্বপূর্ণ সুবিধা:
প্রথমত: এই গাছের বিশেষ যত্নের প্রয়োজন পড়ে না। অনেক দামি দামি সার প্রয়োগ করতে ও হয় না।
দ্বিতীয়ত: এই উদ্ভিদ পোকামাকড় দ্বারা বেশি সংক্রমিত হয় না। যার ফলে ফলন ও খুব ভাল হয়।
তৃতীয়ত: কম খরচে চাষ করে চাষিরা ভাল দামে ফসল বাজারে বিক্রি করতে পারবেন। এমনকী এর চারা তৈরি করে বাজারে বিক্রি করলে অনেক লাভ পাবেন চাষিরা।
ডুমুর চাষে আয়:
ডুমুর গাছ যেহেতু খুব উপকারী তাই এর ফল, পাতা, ডালপালা সবই মানুষের ব্যবহারে লাগে। বাজারে এর চাহিদা ও যথেষ্ট। এর ছোট ছোট ডালপালা হিন্দু ধর্মের পূজোয় কাজে লাগে। তাই অনেক অর্থ খরচ করেও মানুষেরা এই সব কেনেন। আবার এর চারা তৈরি করেও চাষিরা বিক্রি করতে পারেন। চারার পাইকারি মূল্য প্রায় ৫২০ টাকা এবং খুচরো মূল্য হিসেবে প্রায় ৭০০ টাকার মতো। সুতরাং চারা তৈরি করে বিক্রি করলেও ভাল আয় পাবেন চাষিরা। এছাড়াও বড় জমিতে চাষ করলে সেখান থেকে তো আয় হবে যথেষ্ট পরিমাণে। কারণ এতে রোগ বা পোকার আক্রমণ বেশি হয় না। তাই ফলন খুব ভাল হয়। এক একর জায়গায় চাষ করলে চাষের খরচ বাদে লাভ হবে প্রায় তিন লক্ষ টাকা। সাধারণত এক কেজি ডুমুর বাজারে বিক্রি হয় একশো টাকায়। চাষিরা তাঁদের গতানুগতিক চাষের পাশাপাশি এইসব চাষ করেও অল্প ব্যয়ে যথেষ্ট আয়ের মুখ দেখতে পারেন।