মাছ ও চিংড়ির রোগজীবাণু দমনে নানাবিধ অ্যান্টিবায়োটিকের (জীবাণুনাশক) যথেচ্ছ ব্যবহার এ শিল্পকে ক্রমশ ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দিয়েছে। ধারাবাহিক গবেষণার ফলাফলের ভিত্তিতে মাছ চাষের জন্য পরিবেশ বান্ধব চাষ পদ্ধতি, উৎপাদন বৃদ্ধি, ক্ষতিকর জীবাণু নিয়ন্ত্রণ ও বিদ্যমান রোগের ঝুঁকি কমাতে উপকারী অণুজীব বা প্রোবায়োটিকের ব্যবহার একটি উদীয়মান প্রযুক্তি। লিখেছেন রামকৃষ্ণ মিশন বিবেকানন্দ শিক্ষা ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের শস্য শ্যামলা কৃষি বিজ্ঞান কেন্দ্রের বিষয়বস্তু বিশেষজ্ঞ (মৎস্য চাষ) ড. স্বাগত ঘোষ। পড়ুন দ্বিতীয় পর্ব।
প্রোবায়োটিক ব্যবহারে সতর্কতা:
প্রোবায়োটিক (Probiotic) ব্যবহারকালে ক্রয়কৃত পণ্যে জীবিত প্রোবায়োটিকের পরিমাণ যাচাই করা ও মেয়াদ আছে কি না দেখা আবশ্যক। ব্যবহারকালে অ্যাপ্রন, গ্লাভস ইত্যাদি-সহ প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা ব্যবস্থা অবলম্বন করাও জরুরি। প্রোবায়োটিক ব্যবহারের পরেও পরিবেশে অতিরিক্ত ক্ষতিকর অণুজীবের সংক্রমণ রোধ করতে সংক্রমিত ব্যক্তি বা সব ধরনের বস্তুসামগ্রী থেকে নিরাপত্তা বিধান করা উচিত। প্রোবায়োটিক রোগ হওয়ার পূর্বেই রোগ প্রতিরোধকারী হিসাবে নিয়মিত ব্যবহার করতে হবে কেবল রোগ হয়ে গেলে প্রতিষেধক হিসাবে ব্যবহার ভাল ফলদায়ক না-ও হতে পারে। সাধারণত স্থির জলে বা কম পরিচলনশীল জলে প্রোবায়োটিক ব্যবহার করলে তা অধিক কার্যকর হয়ে থাকে। তা ছাড়া জল শোধন করার পর অন্য কোনও ক্ষতিকর বা প্রতিযোগী অণুজীব বংশবিস্তারের পূর্বেই প্রোবায়োটিক ব্যবহার করা হলে ভাল ফল পাওয়া যায়। প্রোবায়োটিক ব্যবহারকালে এমন কোনও অ্যান্টিবায়োটিক বা রাসায়নিক ব্যবহার করা উচিত নয় যা প্রোবায়োটিকের মৃত্যুর কারণ হয় বা তাঁদের বুদ্ধির অনুকূল পরিবেশ বিনষ্ট করে।
সঠিক প্রোবায়োটিকের নির্বাচন:
মাছ বা চিংড়ি চাষে ব্যবহারের জন্য বাজারে নানা ধরনের দেশি ও বিদেশি প্রোবায়োটিক পাওয়া যায়। এসব প্রোবায়োটিকের ব্যবহার পদ্ধতি ও প্রয়োগ মাত্রা নির্দিষ্ট করা আছে। মনে রাখা প্রয়োজন, চাষকৃত প্রজাতিতে ও চাষ পরিবেশে প্রাকৃতিকভাবেই উপকারী ও অপকারী উভয় প্রকার অণুজীব থাকে। স্থানীয় পরিবেশে সুস্থ জীবদেহে প্রাপ্ত স্বাভাবিকভাবে উপকার প্রদানকারী প্রোবায়োটিক যে কোনও বিদেশি প্রোবায়োটিক অপেক্ষা শ্রেয়। তাই সর্বপ্রথম সুস্থ জীবদেহে ও স্থানীয় পরিবেশে প্রাপ্ত ভাল গুণসম্পন্ন প্রোবায়োটিক ব্যবহার করাই ভাল। বাজারে প্রাপ্ত সব প্রোবায়োটিক অণুজীব একইরকম কাজ করে না। বিভিন্ন ব্র্যান্ডের প্রোবায়োটিকের ভিতরে বিভিন্ন ধরনের অণুজীব থাকে। আর একেক অণুজীব একেক রকমের কাজ করে। তাই প্রোবায়োটিক কেনা ও প্রয়োগ করার সময় দেখতে হবে তার ভিতরে কোন কোন ধরণের উপকারী অণুজীব রয়েছে, তাদের উৎপাদনকালে মোড়কে লিপিবদ্ধ ঘনত্বে তারা জীবিত অবস্থায় আছে কি না এবং অন্য কোনও বহিরাগত ক্ষতিকর জীবাণু আছে কি না। সাধারণত হ্যাচারি বা নার্সারি পর্যায়ের মড়ক রোধ, অপকারী অণুজীব দমনপূর্বক পুকুর প্রস্তুতি, খাদ্য পরিপাক ও শোষণ সহজ করা জল ও মাটির গুণাগুণ ব্যবস্থাপনা ইত্যাদি কাজের জন্য বিভিন্ন ব্র্যান্ডের নানা প্রকার প্রোবায়োটিক বিদ্যমান। আরও নতুন নতুন নামে দেশি-বিদেশি প্রোবায়োটিক প্রতিনিয়ত বাজারে আসছে। ভাল গুণসম্পন্ন উৎপাদক কোম্পানিগুলি বাজারজাত প্রোবায়োটিক ব্যবহারের জন্য প্রয়োগ মাত্রা ও নির্দেশনা মোড়ক, জার বা বোতলের গায়ে লিখে দেন। নির্দেশিত প্রয়োগ মাত্রা ও পদ্ধতিতে প্রোবায়োটিক প্রয়োগ করাই যুক্তিযুক্ত। কারণ নির্দেশিত প্রয়োগ মাত্রার কম ব্যবহার করা হলে ও প্রয়োগ পদ্ধতি সঠিক না হলে প্রোবায়োটিক ক্ষতিকর জীবাণু দমনে সক্ষম না-ও হতে পারে। প্রোবায়োটিক নির্বাচন ও প্রয়োগের ক্ষেত্রে নিকটস্থ মৎস্য বিশেষজ্ঞ বা এ বিষয়ে অভিজ্ঞ ব্যক্তির সাহায্য নেওয়া যেতে পারে। তবে কোনওক্রমেই কেবল বিক্রেতার পরামর্শে প্রোবায়োটিক ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত নয়। কারণ কোনও কোনও বিক্রেতা তঁার কাছে থাকা প্রোবায়োটিক অণুজীব ও তার কার্যকারিতার মেয়াদ সম্বন্ধে না জেনে কেবল বিক্রয় ও লাভের আশায় চাষির অযথা আর্থিক ব্যয় বাড়িয়ে দেয়।
প্রোবায়োটিকের সীমাবদ্ধতা:
সাধারণত খাদ্যসামগ্রীতে ব্যবহৃত প্রোবায়োটিকস অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে পৃথক করা হয় এবং বারবার পরীক্ষার পরই ব্যবহারের জন্য বাজারজাতকরণ করা হয় বলে তার নিরাপত্তা নিয়ে আশঙ্কা একেবারেই কম। তবু ব্যবহার ও প্রয়োগজনিত ত্রুটি, অসাবধানতা এবং মানুষের অর্জিত জ্ঞানের সীমাবদ্ধতার দরুন একে একেবারেই ঝুঁকিমুক্ত বলা যায় না। বর্তমানে ঝুঁকির তেমন কোনও জোরালো প্রমাণ না থাকলেও তাত্ত্বিকভাবেও দীর্ঘমেয়াদে কিছু কিছু ঝুঁকির আশঙ্কা থাকে যেমন–শারীরবৃত্তীয় তন্ত্রের সংক্রমণ (Systemic infections), ক্ষতিকর বিপাকীয় কার্যাবলি (Deleterious metabolic activities), রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাপনায় অতিরিক্ত উত্তেজনা সৃষ্টি (Excessive immune stimulation) এবং কৌলিতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্যের পরিবর্তন (Gene transfer) ইত্যাদি।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, এশিয়া এবং ল্যাটিন আমেরিকার বাগদা চিংড়ি (Penaeus monodon) চাষে উপকারী প্রোবায়োটিকস ব্যাকটিরিয়া ব্যাসিলাস সাবটিলিস (Bacillus subtilis) ব্যবহার করেও ব্যাকটিরিয়াল হোয়াইট স্পট সিনড্রোম (BWSS) দেখা গিয়েছে যেখানে ও লক্ষণ প্রায় হোয়াইট স্পট ভাইরাল সিনড্রোমের (wss) মতো হলেও তা WSS-এর মতো ভয়াবহ ক্ষতিকর নয়, বরং BWSS-এ আক্রান্ত হলেও খোলস ত্যাগের পর আর দাগ তেমন থাকে না, মৃত্যুহারও অনেক কমে যায়। কিন্তু চাষিরা এবং গবেষকগণ ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষা ছাড়া সাধারণত BWSS ও WSS—এর সংক্রমণজনিত পার্থক্য নির্ণয় করতে পারেন না। কোনও কোনও গবেষক এমন আশঙ্কা করেছেন যে, প্রোবায়োটিক ব্যবহার করা খাদ্যপণ্য অর্ধসিদ্ধ বা অসিদ্ধ অবস্থায় খাওয়া হলে প্রোবায়োটিকের অবশেষ ভোক্তার শরীরে ক্ষতিকর প্রভাব ফেলতে পারে, কিন্তু পূর্ণ সিদ্ধ পণ্য নিরাপদ। কোনও কোনও ভোক্তা নির্দিষ্ট কিছু অণুজীবের প্রতি অতিমাত্রায় সংবেদনশীল হয়ে থাকেন যার ফলে অর্ধসিদ্ধ বা কাঁচা পণ্য ভক্ষণে তারা সামান্য মাত্রায় নিরাময়যোগ্য সংক্রমণে সংক্রমিত হতে পারেন। কোনও কোনও প্রজাতির প্রোবায়োটিক কোন ধরনের উপকার সাধন করে তঁার বিচ্ছিন্ন গবেষণা বিভিন্ন স্বীকৃত জার্নালে থাকলেও এদের একত্রীভূত পূর্ণাঙ্গ তালিকা কোনও স্বীকৃত প্রতিষ্ঠানসমূহ হতে প্রকাশ করা হয়নি। আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত প্রতিষ্ঠানসমূহ (যেমন-FAO, WHO) কর্তৃক এখনও পর্যন্ত নিরাপদ প্রোবায়োটিক ব্যবহার বিষয়ক পূর্ণাঙ্গ কোনও নির্দেশনা প্রকাশ করা হয়নি যা প্রোবায়োটিক ব্যবহারের একটি সীমাবদ্ধতা হিসাবে বিবেচিত হয়ে থাকে।