সঞ্জিত ঘোষ, নদিয়া: বাঙালির সেরা উৎসব শারদীয়া। শুধু তো ধর্মীয় উৎসব নয়, দুর্গাপুজো ঘিরে সারাবছরের যাবতীয় আনন্দের বহিঃপ্রকাশ ঘটে থাকে বাঙালির মননে, বাঙালির প্রতি মুহূর্তের উদযাপনে। পুজোর কটা দিন সাজপোশাকেও অনন্য ছোঁয়া লাগে, বিশেষত বঙ্গনারীর জীবনে। আর কে না জানে নারী মানেই শাড়িপ্রেমী? প্রতি পুজোয় ফ্যাশন জগতে নতুন কিছু আসার অপেক্ষা করেন কেতাদুরস্ত নারী-পুরুষ। তাঁদের জন্য সুখবর। এবারের পুজোয় বিশেষ চমক শাড়িতেও ভাষা আন্দোলনের ডাক! শুনে অবাক হচ্ছেন? এটাই কিন্তু খাঁটি সত্যি। শান্তিপুর-ফুলিয়ার তাঁতশিল্পীদের বুননে স্রেফ নকশা নয়, শাড়ির পাড়ে বাংলা হরফে ফুটে উঠছে বাংলায় লেখা। আসলে উৎসবের মধ্যে দিয়েও ভিনরাজ্যে বাংলা ভাষা অবমাননার প্রতিবাদ জারি রাখছেন বাংলার তাঁতশিল্পীরা।
উজ্জ্বল হলদে তাঁতের শাড়িতে তুঁতে সরু পাড়। তাতে স্পষ্ট বাংলা হরফে লেখা রবীন্দ্রসঙ্গীত - 'পুজোর গন্ধ এসেছে'। পোশাকে বাঙালিয়ানা উপস্থাপনের জন্য এর চেয়ে বড় আর কী-ই বা হতে পারে? বাংলার তাঁতশিল্পের পীঠস্থান শান্তিপুর, ফুলিয়ায় তাঁতে বোনা এসব শাড়ি আসলে বাঙালির আত্মমর্যাদার প্রতীক হয়ে উঠতে চলেছে এবারের পুজোয়। ফুলিয়ার গলিতে এখন সকাল-সন্ধ্যা লুমের শব্দ। কারও হাতে শাড়ির পাড়ে ফুটে উঠছে 'আহা তোমার সঙ্গে প্রাণের খেলা', কোনও শাড়িতে 'প্রিয় আমার ওগো প্রিয়'। তাঁতশিল্পীদের দাবি, এই শাড়িই হতে চলেছে এবারের পুজোর সবচেয়ে বড় ‘ট্রাম্প কার্ড’। তবে তাঁতের শাড়ি মানে শুধুই এই ঐতিহ্য, তা কিন্তু নয়। বাঙালির চিরন্তন ঐতিহ্যের সঙ্গে আধুনিকতার দারুণ মেলবন্ধনে তৈরি হচ্ছে নানা ধরনের শাড়ি।
রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে সেসব শাড়ির জন্য বরাত মিলছে। বিদেশেও বিপুল চাহিদা। 'পদ্মশ্রী' বীরেন বসাকের পরিবার জানাচ্ছে, “বাংলা লেখা শাড়ির চাহিদা গতবছর থেকেই শুরু হয়েছিল। কিন্তু এ বছর সেই চাহিদা আকাশ ছুঁয়েছে। বিদেশ থেকেও প্রচুর অর্ডার পাচ্ছি আমরা। এসব শাড়ির দাম দেড় হাজার থেকে সাত হাজার টাকা।”
পাড়ে বাংলা লেখা এসব শাড়ি তৈরি হচ্ছে শান্তিপুর, ফুলিয়ায়। নিজস্ব ছবি।
ভাষা বিতর্কের মাঝে ‘বাংলা পাড়’ দেওয়া শাড়ি যেন বাঙালির আত্মমর্যাদা ফিরিয়ে দেওয়ার দায়িত্ব নিয়েছে। শান্তিপুর-ফুলিয়ার তাঁতশিল্পীরা বলছেন, “এই পুজোয় বাঙালির আবেগের শাড়ি হবে একেবারেই বাংলার শাড়ি”। এই শাড়ি কেবল একটি পোশাক নয়, বাংলা ভাষার প্রতি ভালবাসার প্রকাশ এবং সংস্কৃতি রক্ষা হাতিয়ার।
শাড়িতে এভাবেই ফুটে উঠছে মাতৃভাষা।
আসলে পোশাকের মাধ্যমে বাংলার মাটিতে আন্দোলনের ডাক এই প্রথম নয়, স্বাধীনতা পূর্ববর্তী সময়েও তা ছিল। ইংরেজ বিরোধিতায় স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর দেশবাসীকে আহ্বান জানিয়েছিলেন, 'মায়ের দেওয়া মোটা কাপড় মাথায় তুলে নে রে ভাই...'। আজ সেই দিন হয়ত নেই। কিন্তু আজও দেশজুড়ে বাঙালি-বিরোধিতায় চোরাগোপ্তা যে আক্রমণ চলছে, তার যথার্থ জবাব দিতে বঙ্গনারীর আয়ুধ হয়ে উঠুক বাংলা লেখা শাড়ি। তাও আবার দশভুজা আরাধনার বিশেষ সময়টিতে।
