বিশ্বদীপ দে: যে কোনও রূপকথাই শেষ হয় সকলের সুখেশান্তিতে দিন কাটানোর বর্ণনা দিয়ে। কিন্তু জীবন তো আর রূপকথা নয়। তাই বারবার বাঁক বদল, আলো থেকে অন্ধকারে হারিয়ে যাওয়ার বিষাদগাথাও লিখিত হতে থাকে। একদিন যিনি ছিলেন নায়ক, যাঁর মাথার উপরে থাকত আলোকবৃত্তের ঝলমলে উপস্থিতি, সেই তিনিও দুম করে মুছে যান। তারপর হঠাৎ একদিন সেই নামটি উচ্চারিত হলে তখন সকলের মনে পড়ে, তাই তো! কোথায় গেলেন তিনি?
শুরু করা যাক এক জমজমাট নৈশভোজের আসর থেকে। লন্ডনের (London) সেই নৈশভোজ ছিল কিংবদন্তি উইকেটরক্ষকদের নিয়ে। অন্যদের সঙ্গে সেখানে হাজির ছিলেন জেফ্রি দুঁজো। খর্বকায় দুঁজো ছিলেন এমন একজন যাঁকে সারা জীবন একের পর এক তীব্র গতির ফাস্ট বোলারদের বল গ্লাভসবন্দি করতে হয়েছে। ক্যারিবিয়ান সেই উইকেটরক্ষককে ওই নৈশভোজে প্রশ্ন করা হয়েছিল, সারা জীবন তো এত পেসারের বলে কিপ করলেন। সবচেয়ে বেশি কঠিন ছিল কার বোলিংয়ের সময় উইকেটের পিছনে দাঁড়ানো?
[আরও পড়ুন: খেলার উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ, ২০৩২ অলিম্পিক পর্যন্ত ‘কুস্তি’কে দত্তক নিল উত্তরপ্রদেশ]
দুঁজোর পরিষ্কার উত্তর ছিল, ”প্যাট্রিক প্যাটারসন (Patrick Patterson) ছিলেন সবার মধ্যে দ্রুততম।” আশপাশে থাকা সকলেই চমকে উঠেছিলেন সেদিন। অ্যান্ডি রবার্টস, মাইকেল হোল্ডিং থেকে ম্যালকম মার্শাল হয়ে কার্টলি অ্যামব্রোজ- অসংখ্য বোলারকে কিপ করেছেন দুঁজো। তারপরও তিনি নাম করলেন প্যাটারসনের! দাবি করলেন প্যাটারসনের মতো ঝামেলায় তাঁকে কেউ ফেলেননি।
সাতের দশকের মাঝামাঝি কিংবা আটের দশকে যাঁদের ছেলেবেলা কেটেছে তাঁদের সকলের মাথার মধ্যেই গেঁথে রয়েছে সেই সোনালি ক্যারিবিয়ান যুগের কথা। আটের দশকের শেষদিকে এসে সেই গৌরব কিছুটা ম্লান হলেও তখনও ওয়েস্ট ইন্ডিজ (West Indies) নামটা হৃৎকম্প ধরিয়ে দিত যে কোনও দলেরই। আর ওয়েস্ট ইন্ডিজ মানেই ‘ধুঁয়াধার’ ক্রিকেট। ভিভ রিচার্ডস, গর্ডন গ্রিনিজ, ডেসমন্ড হেন্সদের ব্যাটিং দৌরাত্ম্যের সমান্তরালে অবশ্যই রয়েছে বিশ্বত্রাস ফাস্টবোলারদের ভয়ংকর দাপট। সেই দলেরই অন্যতম প্যাট্রিক প্যাটারসন। ১৯৯৩ সালে শৃঙ্খলাভঙ্গের অভিযোগে দল থেকে সেই যে ছিটকে গেলেন আর কখনও ফিরে আসেননি তিনি। দল থেকে তো বটেই, একেবারে জীবন থেকেই যেন হারিয়ে গেলেন তিনি। প্রাক্তন সতীর্থ থেকে আত্মীয়স্বজন, কারও কাছেই কোনও খবর নেই।
সত্যিই তাজ্জব ব্যাপার! গেল কোথায় লোকটা? দুঁজোর সেই রাতের স্বীকৃতির পরে ফের নামটা উঠে এসেছিল আলোচনায়। বিশ্বক্রিকেটের মহাকাশ থেকে কোথায় হারাল সেই নক্ষত্র? ইংল্যান্ডের প্রাক্তন তারকা ক্রিকেটার গ্রাহাম গুচ জানিয়েছিলেন, তাঁর কেরিয়ারে প্যাটারসনের উপস্থিতি ছিল রীতিমতো ভয় দেখানো। কেবল গুচ-দুঁজো নয়, প্যাটারসনের বল ফেস করা সেই সময়ের তারকা ব্যাটসম্যানরা অনেকেই একমত। প্যাটারসনের মতো বিপজ্জনক কাউকে মনে হয়নি।
[আরও পড়ুন: অলিম্পিকে পদক জেতার পর থেকেই ব্যস্ততা, চলতি বছরে আর খেলবেনই না Neeraj Chopra]
এহেন এক ক্রিকেটার অবসরের পরে কোথায় গেলেন? কারও মতে, প্যাটারসন হয়তো আমেরিকায় আছেন। কেউ আবার দাবি করতেন, পাগলা গারদে রয়েছেন তিনি। এমনকী, তিনি আদৌ বেঁচে আছেন কিনা তা নিয়েও সন্দেহ প্রকাশ করেন কেউ কেউ। বছর চারেক আগে সেই রহস্যের সমাধান করেন এক ভারতীয় সাংবাদিক। দীর্ঘদিন ধরে তিনি খুঁজে বেরিয়েছেন প্যাটারসনের হালহদিশ। অবশেষে তিনিই খুঁজে পান প্যাটারসনকে। জানা যায়, পাগলা গারদে বন্দি অবস্থায় মোটেই নেই তিনি। কিন্তু খুব ভাল অবস্থাতেও নেই। শরীর গিয়েছে। গিয়েছে সামর্থ্যও। অকালবার্ধক্য নেমেছে শরীরে। নেই নিজস্ব কোনও মাথাগোঁজার ঠাঁইও! কোনও মতে ছোট্ট ভাড়াবাড়িতে দিন গুজরান। যা হোক কাজ করে চালিয়ে নেন পেট। বিস্মৃতির পোকা কুড়ে কুড়ে খেয়েছে স্মৃতি। কেবল ছায়ার মতো মাথার মধ্যে ভেসে রয়েছে পুরনো সময়। আর মনে আছে, খেলা ছাড়ার পরের দিনগুলো ছিল মধ্যরাতের চেয়েও অন্ধকার!
১৯৮৮ সালে মেলবোর্ন টেস্ট প্যাটারসনের কেরিয়ারের এক উজ্জ্বল সময়। তাঁকে স্লেজিং করেছিলেন অজি ক্রিকেটাররা। পালটা অস্ট্রেলিয়ার ড্রেসিংরুমে গিয়ে চ্যালেঞ্জ নিয়ে জানিয়ে দিয়েছিলেন, ”তোদের দেখে নেব।” দ্বিতীয় ইনিংসে অস্ট্রেলিয়া শেষ ১১৪ রানে। প্যাটারসন ৫ উইকেট। ম্যাচে ৯টি। ইউটিউবে সার্চ করলে এখনও পাওয়া যাবে সেই ভিডিও। কিন্তু প্যাটারসনের যে অত কিছু মনে নেই! কেবল মনে আছে, ম্যাচটা ছিল অসম্ভব উত্তেজনাপূর্ণ। ব্যাস! আর সব ঝাপসা। সেই সাংবাদিকের বর্ণনায়, ”উনি এসব শুনলে আপনার দিকে তাকিয়ে থাকবেন। মনে হবে যেন নিজেরই কীর্তির কথা তিনি প্রথমবার জানতে পারছেন অন্য কারও কাছ থেকে।”
তবে মনে আছে ভারতের কৃষ্ণমাচারী শ্রীকান্তের ডাকাবুকো ব্যাটিং। কিংবা মহম্মদ আজহারউদ্দিনের সঙ্গে বন্ধুত্বের কথা। সেই আজহারকে যে বেটিং কেলেঙ্কারিতে জর্জরিত হতে হয়েছে তা শুনে তাঁর মুখে নিমেষে খেলে যায় অন্ধকার। এমনই কিছু স্মৃতি আর অনেকটাই বিস্মৃতির মধ্যে আজও বেঁচে আছেন প্যাটারসন। ব্যাটসম্যানদের রাতের ঘুম কেড়ে নেওয়া সেই সব দিন আজ তাঁর কাছে স্বপ্নের মতো।
কেন এমন হয়? অ্যাশলে গ্রে তাঁর ‘দ্য আনফরগিভেন’ বইয়ে প্যাটারসন সম্পর্কে লিখতে গিয়ে লিখেছেন, ”প্যাট্রিক প্যাটারসন ছিলেন এক বিপজ্জনক পেস বোলার। জেফ্রি দুঁজো জানিয়েছিলেন তাঁর জীবনে দেখা দ্রুততম ছিলেন তিনিই। কিন্তু ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জের বহু ক্রিকেটারের মতোই স্পটলাইটের বাইরে চলে যাওয়ার পরে জীবন নিয়ে কী করতে হয় তা বুঝতে পারেননি তিনি।” প্যাটারসনকে যে কেউ কেউ সাহায্যও করতে চেয়েছিলেন তাও জানাচ্ছেন অ্যাশলে। কিন্তু ওই অঞ্চলের আর্থিক পরিস্থিতি বেশ কঠিন। তাছাড়া মানসিক অসুস্থতা নিয়ে লোকের ধারণাও বেশ সেকেলে। ফলে চাইলেও সেভাবে সাহায্য করে ওঠা যায়নি তাঁকে।
প্যাটারসন অবশ্য একা নয়। সাতের দশকের ক্যারিবিয়ান ক্রিকেটার রিচার্ড অস্টিনকে দীর্ঘদিন জামাইকার রাজধানী কিংসটনের রাস্তায় দিন কাটাতে হয়েছিল। ড্রাগের নেশার সর্বস্বান্ত হয়ে ঘরবাড়ি সব হারিয়ে ফেলেছিলেন তিনি। কিংবদন্তি স্যার এভার্টন উইকসের ছেলেকেও ড্রাগের নেশায় এভাবেই হারিয়ে যেতে হয়েছিল অন্ধকার বৃত্তে।
প্যাটারসন তাঁদেরই উত্তরসূরি। ১৯৮৬ সালে অভিষেকের পর ২৮টি টেস্টে ৯৩টি উইকেট সংগ্রহ করেছিলেন তিনি। অকালে কেরিয়ার শেষ না হলে আরও বহুদূর যেতেন। তার পরিবর্তে দল থেকে বাদ পড়ে যেন জীবন থেকেই বাদ পড়ে যাওয়া। তাঁর কথায়, ”একদিন জানতে পারলাম আমারই একদা সতীর্থ আমার নামে বলছে আমি নাকি কিংসটনের বেলভিউ পাগলা গারদে রয়েছি। তার মুখে এমন কথা শুনে আমি স্তম্ভিত হয়ে যাই। ওরা আমাকে খুঁজে পাইনি। কিন্তু আমি তো এখানেই ছিলাম।”
কিন্তু কেন প্রতিবাদ করেননি তিনি? কেন জানিয়ে দেননি আসল সত্যিটা? প্যাটারসনের উত্তর সংক্ষিপ্ত, ”ওরা আমার ভাবমূর্তি নষ্ট করে দিচ্ছিল। কিন্তু আমি কিছুই করতে পারিনি। কেননা আমার মাথাব্যথা ছিল আরও নিয়ে। যার নাম খিদে।” এই কথার পর আর কোন কথাই বা চলে? বিশ্বত্রাস এক পেসারের মুখের করুণ আকুতি যেন তখন হয়ে ওঠে মাটিতে রথের চাকা বসে যাওয়া কর্ণের মতো। নিখুঁত ইয়র্কারে ব্যাটসম্যানের স্টাম্প উড়িয়ে দেওয়া যে কৃষ্ণাঙ্গ যুবা আজও ইউটিউবের ভিডিওয় হাত মেলান সতীর্থদের সঙ্গে, তিনি আর এই মানুষটি তাই এক হয়েও এক নন। নিজেই নিজের জাতিস্মর হয়ে বেঁচে রয়েছেন প্যাটারসন। পুরনো সময়ের কেবল ক্ষীণ ঝলকটুকুই যাঁর মাথায় ঘাই মারে কেবল। কিন্তু ক্রিকেট রসিকের মন থেকে তাঁর স্মৃতি কোনওদিনই ঝাপসা হবে না। একথা হলফ করে বলাই যায়।