নির্মল ধর: দীর্ঘ তিনমাসের লকডাউন সুশান্ত সিং রাজপুতের মতো দুর্বলমনা মানুষের মধ্যে ডিপ্রেশনের জন্ম দিয়ে তাদের যেমন শেষ করে দিল, পাশাপাশি তেমনি কিছু মানুষ এই গৃহবন্দি অবস্থ্যাকে কাজে লাগছে নতুন ভাবনা দিয়ে। আলস্যাকে সৃজন ভাবনায় রূপ দিচ্ছে। এখন ফেসবুক খুললেই দেখতে পাছে, কেউ গান করছেন, কেউ করছেন আবৃত্তি, আবার কেউ বা নেমে পড়েছেন ১৫-২০ মিনিটের ছোট্ট ছোট্ট ছবি বানাতে। লকডাউনকে বিষয় করেই অমর্ত্য ভট্টাচার্য নিজের ভয়ঙ্কর অবস্থা নিয়েই বানিয়েছেন একটা ছবি। নাটকের মানুষ পৃথ্বীশ রানা এখন একের পর এক বানিয়ে চলেছেন ছোট্ট ছবি। প্রায় প্রতি সপ্তাহে একটা করে। তাঁর অনেক ছবির কেন্দ্রে রয়েছে নাটকে মানুষদের কথাই। তবে এই ধারার সেরা ছবি অবশ্যই দেবেশ চট্টপাধ্যায়ের ‘ইয়ে’।
ছোট নয়, মাঝারি দৈর্ঘ্যের ফিচার ছবি। এই কলকাতা ফিল্ম উৎসবে দেখানো হয়েছিল। রীতিমত পরীক্ষামূলক ভাবনার ছবি। কলকাতাই দেখানোর পর বিদেশেও দেখানো হয়েছে। কিন্তু এমন নতুন ভাবনার ছবির মুক্তির সম্ভাবনা এই করোনার বাজারে নেই-ই বলা যায়। উপরন্তু রাজ্যের সিনেমা হল কবে খুলবে সেটা যেমন কারও হাতে নেই, তেমনই খুললেও ‘ইয়ে’র মত ছবি আদৌ হল পাবে কিনা, সেই প্রশ্নের জন্য দাঁড়িয়ে না থেকে দেবেশ বুদ্ধিমানের মত ছবিটিকে ওটিটি প্ল্যাটফর্মে মুক্তি দিয়ে দিলেন ক’দিন আগেই। দর্শকও ভালই পাচ্ছেন। ইতিমধ্যে কয়েক হাজার ভিউয়ারশিপ। ছবিটা একটা বিদেশি নাটকের অনুপ্রেরণায়। তবে দেশি ভাবটি তিনি বেশ যত্ন ও সুকৌশলে জাড়িয়ে দিয়েছেন চিত্রনাট্যে।
এই শহরের তিনজন মানুষ। তিনটি চরিত্র। তিনজনই খুঁজে চলেছে নিজস্ব সংখ্যা, নিজস্ব ভাষা, নিজস্ব দেশ। অথচ কেউই সেটা পাচ্ছে না। পাওয়ার কথাও নয়। কলকাতায় মোট সিঁড়ির সংখ্যা কত? জানেন কেউ? জানে না সবজান্তা গুগলও। একজন চাইছে ভাষার পুনর্গঠন। সে চেয়ারকে বলবে আয়না, বিছানাকে বলবে পোশাক, কিংবা মুখকে বলবে দরজা ইত্যাদি। তাঁর কাছে কোনও বাড়ির ঠিকানা হল ‘তিনটে সাদা পায়রা উড়ে যাওয়ার পর যেখানে সন্ধ্যা নামে’। আর এক ভবঘুরে চাইছে ‘সাম্য মৈত্রী স্বাধীনতা’র স্বর্গপ্রতিম দেশ। সে আমেরিকায় খুঁজছে তার নিজস্ব দেশ। কিন্তু সে পরে বুঝতে পারে ইন্ডিয়া বা আমেরিকা বলে কোনও দেশই নেই। সবটাই কল্পনা। আসলে পরিচালক ভাষা ও দেশের গন্ডির মধ্যে মানুষকে বেঁধে রাখতে চান না। আমেরিকা আবিষ্কার করেছিল কলম্বাস, নাকি আমেরিগো ভেসপুচি, আর ইন্ডিয়া-.সেই তর্কের মীমাংসার জন্য পরিচালক তিন জনকেই ঢুকিয়ে দিলেন আলো-আঁধারি গারদে। আজকের দিনে সত্যি কিছু জানার চেষ্টাই নিস্ফল। বৃথা। সেটাকেই ব্যঙ্গ করে এই ছবি। দেবেশের প্রকারণশৈলী সহজ এবং জটিল। তবে আমেরিকা আবিষ্কারের কাহিনী যাত্রাপালার কৌশলে প্রকাশ করাটা খুবই সিনেম্যাটিক। অভিনয়ে নিত্য গাঙ্গুলি, অর্পিতা ঘোষ, ও দেবশঙ্কার হালদার একবারই চরিত্র মাফিক কাজ করেছেন। সবচেয়ে ভাল কাজটি করেছেন দেবেশ। এমন একটি পরীক্ষাধর্মী ছবিকে হল মালিকদের সিনেমা হল দেওয়ার ওপর বিশ্বাস না রেখে আগেই দর্শকদের সামনে নিয়ে এলেন। ওটিটি প্ল্যাটফর্মে MyCinemaHall-এ দেখা যাবে ‘ইয়ে’। গুগল প্লেস্টোর থেকে ডাউনলোড করে লগ-ইন করে দেখা যাবে ছবিটি। এক মাস এই প্ল্যাটফর্মে থাকবে ‘ইয়ে’।
কিছুদিন আগে প্রদীপ্ত ভট্টাচার্য তাঁর ছবি “রাজলক্ষ্মী ও শ্রীকান্ত” ওটিটি প্লাটফর্মে মুক্তি দিয়েছিলেন। বলা হচ্ছিল ওটাই নাকি প্রথম বাংলা ছবি যা এই ভাবে রিলিজ হল। “রাজলক্ষ্মী” গত বছর সাধারণ সিনেমা ঘরে মুক্তি পায়। তখন সিরিয়াস দর্শকের কাছে সমাদৃত হলেও, সাধারণ দর্শক একটু মুখ ফিরিয়ে নেয়। ওটিটি-তে মুক্তি পেয়ে ভালো দর্শকই দেখেছে। শোনা যাচ্ছে, নায়ক প্রসেনজিতের ছবি “নিরন্তর” খুব শিগগির নাকি জি-সিনেমায় মুক্তি পাবে, সাধারণ হলে দেখানোর আগেই। বেচারি চন্দ্রাশিসের প্রথম ছবি “নিরন্তর”।.বুঝতে পারছি, উপায়ান্তর হয়েই প্রস্রঞ্জিত এমনটি করছেন। এখন প্রশ্ন- তাহলে কি আগামীতে এভাবেই প্রথম চ্যানেল বা ওটিটি মাধ্যমে বাংলা ছবি রিলিজ হবে? পরে ছবির জনপ্রিয়তা বুঝে পরদাওলা হলে ছবি আসবে? সেটা কি সত্যিই সম্ভব? বরং বলতে পারি, প্রদীপ্ত, ইন্দ্রনীল, সৌকর্যদের মতো যারা “হটকে” ধরনের ছবি করবেন, তাদের কাছে চ্যানেল বা ওটিটি প্লাটফর্মটাই সেরা মুক্তির জায়গা। দেবেশ চট্টোপাধ্যায় প্রথম সেই দরজা দিয়ে প্রবেশ করলেন।
The post করোনা আবহে মুক্তি পেল ‘ইয়ে’, পরীক্ষমূলক ছবিতে সসম্মানে উত্তীর্ণ পরিচালক দেবেশ চট্টোপাধ্যায় appeared first on Sangbad Pratidin.