স্টাফ রিপোর্টার: মোহনবাগান ক্লাবের নির্বাচন নিয়ে আসর জমজমাট। অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি অসীম রায়ের নেতৃত্বে নির্বাচনী বোর্ড কাজ শুরু করে দিয়েছে। ভোট সম্ভবত জুন মাসের দ্বিতীয় বা তৃতীয় সপ্তাহে। খসড়া ভোটারতালিকা প্রকাশিত। সর্বশেষ পরিস্থিতি, বর্তমান সচিব দেবাশিস দত্তর শিবিরের সঙ্গে প্রাক্তন সচিব সৃঞ্জয় বোসের শিবিরের টক্কর চলছে। তার মধ্যে ঘোলাজলে ‘অন্য’ মাছ ধরতে নেমেছে কোনও কোনও পক্ষ।
ট্রফি জয়ের উদ্যাপনের আড়ালে বা অন্য কোনও অরাজনৈতিক এলাকাভিত্তিক সামাজিক কর্মসূচির আড়ালে কার্যত ভোটের প্রচার বা নিজেদের শক্তি যাচাই করার সভা নিয়মিত চলছে। এই সময়ের একটি একটি দৈনিক সংবাদপত্র বৃহস্পতিবার লিখেছে, এই ভোট ঘিরে তৃণমূলে শুরু গৃহযুদ্ধ। বাস্তবে এটি সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন কথা। কারণ, তৃণমূল কংগ্রেস একটি আলাদা দল, তাঁদের অনেকেই মোহনবাগানে যুক্ত, আবার মোহনবাগানে অন্যান্য মতামতের ব্যক্তিরাও স্বাভাবিকভাবেই থাকেন। এই ভোটের সঙ্গে তৃণমূলের গৃহযুদ্ধের কোনও সম্পর্ক নেই। এই সময়ের একটি দৈনিক তাদের ইচ্ছাটি খবরের মোড়কে ভাসিয়ে দিতে চাইছে। এর সঙ্গে প্রত্যক্ষ রাজনীতির রসায়ন নেই। কোন নেতা কোন শিবিরের সভায় থাকলেন, তার থেকে তৃণমূলের দলীয় বিষয় সম্পূর্ণ আলাদা। যেমন, শাসক গোষ্ঠীর অনুষ্ঠানে যাঁরা থাকছেন, তাঁদের সকলের সঙ্গেই বিরোধীপক্ষের কথা হচ্ছে, আবার অনেকে খোলাখুলি বিরোধী গোষ্ঠীর সভায় থাকছেন। এই সময়ের একটি দৈনিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে লিখেছে, আর জি করের সময়ে আন্দোলন সংগঠিত করা কয়েকজনকে বিরোধীগোষ্ঠীতে সক্রিয় দেখা গিয়েছে। মজার বিষয়, যে কাগজে এই কথা লেখা হচ্ছে, এই সময়ের সেই দৈনিকটি নিজেই আর জি কর থেকে শুরু করে একাধিক স্পর্শকাতর ইস্যুতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারের বিরোধী আন্দোলন এবং বিরোধী রাজনৈতিক মতামতকে প্রোমোট করে এসেছে। এখন তারা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত পরিকল্পনায় মোহনবাগানে আর জি কর খুঁজতে নেমেছে। আর জি করের সময়ের ওই কাগজের প্রথম পাতাগুলি উল্টে দেখলেই প্রমাণ হয়ে যাবে এই দ্বিচারিতার আড়ালে থাকা অন্য এজেন্ডা।
এদিকে বাস্তব হল, দেবাশিস দত্তকে সামনে রেখে মোহনবাগানের দখল নিতে নেমেছে বিজেপি শিবির। কারণ, এআইএফএফ সভাপতি এবং মানিকতলা কেন্দ্রের বিজেপির রেকর্ড ভোটে পরাজিত প্রার্থী কল্যাণ চৌবের স্ত্রী সোহিনী মিত্র চৌবে দেবাশিসের অতি-নির্ভরযোগ্য এক্সিকিউটিভ কমিটির সদস্য। একাধিক ইস্যুতে দেখা গিয়েছে, দেবাশিসকে সামনে রেখে বিজেপির প্রভাব খাটানোর চেষ্টা চলেছে। এমনকী, এই যে ক্লাবে নির্বাচন হচ্ছে, ইসি বৈঠকে তার বিরোধিতাও করতে দেখা গিয়েছিল সোহিনীকে। এখন ইতিমধ্যেই তাঁকে দেবাশিসের হয়ে প্রচারে দেখা যাচ্ছে। প্রয়াত অঞ্জন মিত্রর কন্যার থেকেও এখন অগ্রাধিকার পাচ্ছে তাঁর বিজেপি নেতা ও এআইএফএফ সভাপতি কল্যাণ চৌবের স্ত্রীর পরিচয়। সিপিএমের একটা অংশকে সঙ্গে নিয়ে বিজেপি আপাতত দেবাশিসকে প্রোমোট করার চেষ্টা করছে। সিপিএমের একাধিক নেতার কাছে শাসক গোষ্ঠীর তরফে আসা এ সংক্রান্ত হোয়াটসঅ্যাপ চ্যাট রয়েছে, যেগুলি আপাতত বিরোধী গোষ্ঠীর হাতে। ওই সংবাদপত্রটি দেখাতে চেষ্টা করেছে, সচিব কীভাবে শাসকদলকে সাহায্য করেছেন। কিন্তু মোহনবাগানের অভ্যন্তরীণ সূত্র জানাচ্ছে, ওই কমিটিতে এমন কেউ কেউ ছিলেন, যাঁরা বিজেপির প্রভাবকে উড়িয়ে দিয়ে সচিবকে সঠিক পথে থাকার পরামর্শ দিয়েছেন। সে সব ভুলিয়ে দিয়ে বিজেপি লবির সঙ্গে হাত মিলিয়ে এই সময়ের দৈনিকটি এখন পাঠকদের বিভ্রান্ত করার কাজে নেমেছে। তারা মূলত বিজেপির উদ্দেশ্য সাধন করছে। ওই দৈনিকটি কিছু নামের তালিকা দিয়ে দেখানোর চেষ্টা করেছে, কারা কোন দিকে। মোহনবাগান সূত্রের খবর, যে ক’টি নামে ছাপা হয়েছে তাঁদের প্রত্যেকে বিরোধী গোষ্ঠীকে জানিয়ে দিয়েছেন, তাঁরা টুটু বোসের অবদানের কথা কখনও ভোলেননি। এবারও ভুলবেন না। কখন, কার অনুরোধে কোথায় যেতে হবে এসব বিচার করার কোনও কারণ ঘটেনি। সিপিএমের এক প্রাক্তন পুরসভার কর্তা বলেন, “বর্তমান শাসকগোষ্ঠী আমার কাছে সহযোগিতা চেয়েছে। তবে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিইনি।”
সিপিএমের আরেক নেতা বলেন, “মোহনবাগান যখন দিনের পর দিন ইস্টবেঙ্গলের কাছে হেরে আসত, তখন যেভাবে টুটুদা হাল ধরেছিলেন, তখন থেকে আমি ক্লাবগতভাবে তাঁর ভক্ত। এর সঙ্গে দলীয় রাজনীতি দয়া করে মেলাবেন না।” বিজেপির এক নেতা বলেন, “আমরা চাই দেবাশিস জিতুক। কল্যাণবাবু এর জন্য সবরকম কৌশল প্রয়োগ করেছেন বলে শুনেছি। এআইএফএফের পাশাপাশি জাতীয় ক্লাবও আমরা দখল করতে চাই বলে বর্তমান সচিবকে আবার ফেরানোর চেষ্টা করছি।” তৃণমূলের এক নেতা বলেন, “দল আলাদা। ক্লাব আলাদা। আমরা দীর্ঘদিন ধরে মোহনবাগান করি। আমাদের মুখ্যমন্ত্রী মোহনবাগান-সহ সব ক্লাবকে বিপুল সাহায্য করেন। ক্রীড়ামন্ত্রীও সব ক্লাবের পাশে থাকেন। তাই এর মধ্যে কোনও লুকোছাপার ব্যাপার নেই। আবার ভোট নিয়ে দলে কোনও গৃহযুদ্ধও নেই। ‘খেলা হবে’ বলতে যাবেন না। এখন ‘খেলা শেষের’ দিকে নজর রাখুন।
উল্লেখ্য, ইতিমধ্যেই দুই শিবিরের সভা এবং অন্যান্য সামাজিক কর্মসূচিতে যাঁদের দেখা গিয়েছে তাঁরা হলেন, মন্ত্রী অরূপ রায়, অতীন ঘোষ, শ্রেয়া পাণ্ডে, মন্ত্রী প্রদীপ মজুমদার, বিধায়ক খোকন দাস, সাংসদ পার্থ ভৌমিক, প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রাক্তন মোহনবাগান অধিনায়ক শিশির ঘোষ, শিল্টন পাল, কম্পটন দত্ত, ‘মোহনবাগান রত্ন’ সুব্রত ভট্টাচার্য প্রমুখ। একপক্ষ বলছেন, বর্তমান সচিবের নেতৃত্বে কমিটি সমালোচনামূলক কোনও কাজ করেনি। অন্যপক্ষের বক্তব্য, গতবার ক্লাবের বাইরের সমীকরণে সৃঞ্জয়কে ছিটকে দিয়ে চেয়ার পেয়েছিলেন বর্তমান সচিব। ফলে এই সচিব নির্বাচিত নন। সে ক্ষেত্রে সৃঞ্জয় কেন সমান সুযোগ পাবেন না। ক্লাব সূত্রের খবর, এখন ফুটবলের সাফল্য বস্তুত কমিটির হাতে থাকে না। সেটা পুরো সঞ্জীব গোয়েঙ্কার হাতে। টাকা জোগাড়ের চাপও থাকে না। তাই অন্য কিছু কাজে নজর দেওয়া যায়। এই কমিটি আর্থিকভাবে চাপমুক্ত হয়ে কাজ করেছে। অন্যদিকে সঞ্জীব গোয়েঙ্কাকে ক্লাবের ফুটবলে অন্তর্ভুক্ত করারও মূল কৃতিত্ব টুটু বোসের, তখন এই সৃঞ্জয়ই ছিলেন সচিব। সে সময়ে ব্যক্তিগত সম্পর্কের ভিত্তিতে যদি গোয়েঙ্কাকে ‘বোস পরিবার’ মোহনবাগানে অন্তর্ভুক্ত না করতেন, তা হলে ফুটবলের এই সাফল্য কতটা দেখা যেত তা নিয়ে সন্দেহ আছে। টুটু বোস দূরদর্শী, তাই তিনি ক্লাব চালাতে অর্থের জোগানকে গুরুত্ব দিয়ে নিজে যতদিন পেরেছেন টাকা দিয়েছেন, তারপর সঞ্জীব গোয়েঙ্কাকে বন্ধনীযুক্ত করেছেন। ফলে, টুটুবাবু যদি এখন সৃঞ্জয়কে আবার সমর্থন করেন, তার মধ্যে শুধু পিতা-পুত্র নয়, মোহনবাগানের সুদূরপ্রসারী উন্নতির দরজা খোলা থাকছে।
উল্লেখ্য, ২০১৮-র ক্লাব নির্বাচনের প্রচারে যখন অঞ্জন মিত্র বনাম টুটু বোসের লড়াই, তখনও দেবাশিস টুটু-সৃঞ্জয়ের ছায়াসঙ্গী এবং অঞ্জনবাবুকে টেক্কা দিতে দেবাশিস প্রচারে বলতেন, “অঞ্জনদাও বলেন, আমার পরে ভবিষ্যতে একদিন সৃঞ্জয় আমার চেয়ারে বসবে, আমি তখন বিরোধিতা করতাম। কিন্তু আজ সৃঞ্জয় নিজের যোগ্যতায় নিজে ভোটে দাঁড়াচ্ছেন।” বস্তুত, একটা সময়ে টুটুবাবু, অঞ্জনবাবু, সৃঞ্জয়, দেবাশিস সকলেই একটি টিম ছিলেন। পরে তাতে ভাঙন ধরে। এখন দীর্ঘদিনের অবদান এবং পারফরম্যান্সের সূত্রে টুটুবাবু সৃঞ্জয়কে সমর্থন করছেন। সেই পরিপ্রেক্ষিতেই এখন ভোটের আবহ। তবে এই সময়ের একটি সংবাদপত্র যেভাবে এই ভোটকে তৃণমূলের গৃহযুদ্ধের সঙ্গে তুলনা করেছে, তা সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। আর জি করের সময়ে আগাগোড়া সিপিএম, বিজেপি এবং রাজ্য সরকারের সব বিরোধীকে ‘তোল্লা’ মারা ওই দৈনিক এখন বিজেপির প্রার্থী দেবাশিস দত্তকে প্রোমোট করছে।
