স্বপনসাধন বোস: দেখতে দেখতে ১৬টা বছর কেটে গেল। সেই ২০০৯ সালের কথা। দিনটা ছিল ২৫ অক্টোবর। সল্টলেকের যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গন বহু সোনালি মুহূর্ত উপহার দিয়েছে। কত স্বপ্ন যে এখানে বাস্তব হয়েছে। কিন্তু ২০০৯ সালের ২৫ অক্টোবরের রাত একবারই আসে। আর চাইব, এরকম পাঁচ গোলের দিন বারবার ফিরে আসুক। কারও ধার বাকি রাখব না, সব মিটিয়ে দেব। মোহনবাগানের দায়িত্বে আসার পর প্রতিজ্ঞা নিয়েছিলাম পাঁচের বদলা পাঁচ দিয়েই হবে। সেদিন ইস্টবেঙ্গলকে ৫ গোল দিয়ে তা প্রতিজ্ঞা পূরণ করেছিলাম। এখন যতবার অতীতের দিকে তাকাই, ততবার ওই দিনটার কথা মনে পড়লেই একটা অদ্ভুত তৃপ্তি পাই। আহা! কী দিন ছিল!
তার আগে পর্যন্ত ধাওয়া করেছিল ৫ গোলে হারের অস্বস্তিজনক ইতিহাস। ১৯৭৫ সালের স্মৃতিতে লেখা থাকবে উমাকান্ত পালোধির নাম। ফুটবল শুধু একটা খেলা নয়। জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা লড়াইয়ের গল্প। আমরা জিতি, হারি। কিন্তু হারিয়ে যাই না। মোহনবাগান সেই লড়াইয়ের নাম। ইংরেজদের বিরুদ্ধে খালি পায়ে লড়ে স্বাধীনতার মন্ত্র শিখিয়েছিল আমাদের প্রাণের ক্লাব। উমাকান্ত পালোধি সেই সবুজ-মেরুন পতাকা ঊর্ধ্বে তুলে ধরার প্রতীক। তাঁর প্রয়াণের যে যন্ত্রণা তা আজও কুরে কুরে খায়। তাঁর প্রয়াণের ৫০ বছর পরে এসে অন্তত এটুকু বলতে পারি, হ্যাঁ, আমরা বদলা নিয়েছি।
একটা সময় ছিল যখন ইস্টবেঙ্গলের কাছে আমরা বারবার পরাস্ত হয়েছি। আমি যখন দায়িত্ব নিই, তখন সমর্থকরা যেন ম্রিয়মাণ হয়ে পড়েছিল। কিন্তু আমিও তো ছাড়নেওয়ালা বান্দা নই। 'দেখে নেব' এই মানসিকতা নিয়ে লড়াইয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলাম। সমর্থকরা সে সময় যুবভারতী মুখী হত না। শপথ নিয়েছিলাম, এই ধারণাটা বদলাতে হবেই। যুবভারতীকে আমাদের দুর্গ বানিয়ে তুলে ছাড়ব। আমার উৎসাহে-উদ্দীপনায় সমর্থকদের মধ্যে একটা জেদের সঞ্চার হয়। হ্যাঁ, আমরাও করে দেখাব, দেখাবই। সেটাই মাঠের সবুজ ঘাস বেয়ে ছড়িয়ে পড়েছিল সবুজ-মেরুন জার্সি পরা ফুটবলারদের মধ্যে। সমর্থকরাও আত্মবিশ্বাস ফিরে পেল।
অবশেষে এল সেই বহু প্রতীক্ষিত দিন। ২০০৯ সালের ২৫ অক্টোবর। যুবভারতীতে আই লিগের ম্যাচে মোহনবাগানের মুখোমুখি ইস্টবেঙ্গল। আমি তখন দুবাইয়ে। শুরুতে এগিয়ে গিয়েছিল ইস্টবেঙ্গল। নির্মল ছেত্রীর গোলের পালটা জবাব দিতে আমাদেরও বেশিক্ষণ লাগেনি। চিডি আর মণীশ মৈথানির গোলে আমরা ২২ মিনিটের মধ্যে এগিয়ে যাই। ৩৩ মিনিটে চিডি ফের আমাদের এগিয়ে দেয়। হাফটাইমের আগে যদিও ইয়াকুবু ও হ্যামন্ডের গোলে সমতা ফেরায় ইস্টবেঙ্গল। কিন্তু সেদিন বোধহয় মোহনবাগানকে রোখার ক্ষমতা কারও ছিল না। বাঘের বাচ্চার মতো ঝাঁপিয়ে পড়েছিল সবাই। দ্বিতীয়ার্ধে চিডির জোড়া গোলে ওদের জালে পাঁচবার বল জড়াই। বিদেশবিভুঁইয়ে বসে আমার একটা কথাই বারবার মনে হয়েছিল, আজ আমার মোহনবাগানি হওয়া সার্থক। একটা আত্মতৃপ্তি কাজ করছিল, পাঁচের বদলা পাঁচ দিয়েই নিয়েছি।
তারপর গঙ্গায় অনেক জল বয়ে গিয়েছে। আমরা আই লিগ জিতেছি। একের পর এক সাফল্য এসেছে আমাদের ঝুলিতে। কথায় বলে না, স্মৃতি সততই সুখের। ফিরে দেখা দিনগুলোতে জ্বলজ্বল করছে সেই দিনটা। ফের এরকম পাঁচ গোলের একটা দিন নিশ্চয়ই ফিরবে। যুবভারতীতে তরতর করে ছুটবে পালতোলা নৌকা। ডার্বিতে ৫ গোলের উৎসবে কলকাতা ফের সবুজ-মেরুন হয়ে উঠবে।
