সংবাদ প্রতিদিন ডিজিটাল ডেস্ক: মামুলি গা ব্যথা। হাতে পায়ে খানিকটা অস্বস্তি - প্রথম দিকে এমন অবস্থা। এরপর শুরু হয় হাত-পায়ের আঙুলে মামুলি অস্বস্তি দিয়ে। তার পর পা অসাড় হতে থাকে এবং পেশির সেই দুর্বলতা ধীরে ধীরে শরীরে উপরিভাগকেও গ্রাস করে। দিনদুয়েকের মধ্যে দেখা যায়, রোগী কথা বলতে, খাবার গিলতে, চোখ বুজতে, এমনকী শ্বাসপ্রশ্বাসও নিতে পারছে না ভালো করে। বাচ্চা ছেলেমেয়ে হাঁটতে গিয়ে পা জড়িয়ে পড়েও যায়! একসময়ে হৃদযন্ত্র ও ফুসফুসের পেশিও পক্ষাঘাতের কবলে চলে গিয়ে ডেকে আনে প্রাণসংশয়। আট থেকে আশি বাড়ির কারও এমন সমস্যা হলে দেরি করবেন না। আগে হাসপাতালে নিয়ে যান। কারণ, জিবি সিনড্রোমে আক্রান্ত হতেই বস্তুত শুরু হয় যমে-মানুষে টানাটানি।

চিকিৎসকরা বলছেন, জিবি সিনড্রোম ১৯১৬ সালে অসুখটিকে প্রথম চিহ্নিত করেন ফরাসি স্নায়ুরোগ বিশেষজ্ঞ জর্জেস গিল্যাঁ এবং জিন আলেক্সান্দ্রে বারে। আর বিরল এই স্নায়বিক সমস্যাই ছোটবড় অনেকের মধ্যে আজকাল মাথাচাড়া দিয়েছে মহারাষ্ট্রে। শতাধিক আক্রান্তের সেই বাড়বাড়ন্তের মধ্যে মৃত্যুও দেখা গিয়েছে। তবে এ রাজ্যের ছবিটা অনেকটাই স্বস্তির বলে জানাচ্ছেন স্বাস্থ্যকর্তারা। কারণ, জিবি সিনড্রোমে আক্রান্ত রোগী কলকাতাতেও একাধিক হাসপাতালে আছে ঠিকই। তবে তা স্বাভাবিক গড়ের চেয়ে একেবারেই বেশি নয়। মহারাষ্ট্রের বিভিন্ন জেলা মিলিয়ে শতাধিক আক্রান্ত। মৃত্যু হয়েছে দুজনের। বঙ্গে গত এক সপ্তাহে চারজনের মৃত্যু হয়েছে। ঠিক কতজন আক্রান্ত বৃহস্পতিবার পর্যন্ত স্পষ্ট নয় স্বাস্থ্যদপ্তরের কাছে। তাই সব হাসপাতালের কাছে সন্দেহজনক ও আক্রান্তের দৈনিক তথ্য পাঠাতে বলা হয়েছে। রাজ্যের স্বাস্থ্যসচিব নারায়ণস্বরূপ নিগমও জানিয়েছেন, নতুন করে কোনও আউটব্রেক নজরে আসেনি বাংলায়। ফলে শঙ্কার কোনও কারণ নেই । জিবি সিনড্রোমের জেরে যে ফ্লাসিড প্যারালাইসিস বা পক্ষাঘাত হয়, তার উপরেও নজরদারি চালায় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (হু)-র ন্যাশনাল পোলিয়ো সার্ভিল্যান্স প্রোগ্রাম। কিন্তু সেই কর্মসূচিতেও পক্ষাঘাতের কোনও বাড়াবাড়ি মাথাচাড়া নজরে আসেনি বলে জানাচ্ছে স্বাস্থ্যদপ্তর।
গতবার যদিও স্বাভাবিকের চেয়ে কিছুটা বেশি জিবি সিনড্রোম রোগীর খোঁজ মিলেছিল শহরে। যদিও আজকাল উন্নত ক্রিটিক্যাল কেয়ার পরিষেবার দৌলতে প্রাণহানি তেমন হয় না। শীতের এই সময়টায় নানা রকম সংক্রমণের জেরে ইমিউনিটি অতিসক্রিয় হয়ে উঠে জীবাণুর বদলে শরীরকেই আক্রমণ করে বসে বলে জিবি সিনড্রোম রোগীর সংখ্যাও বছরের আর পাঁচটা সময়ের চেয়ে এই ডিসেম্বর-জানুয়ারিতে বেশি দেখা যায়। কিন্তু এবার না হলেও গত মরশুমের শীতে সেই সংখ্যাটাই গড়ের চেয়ে বেশ কিছুটা বেশি দেখা গিয়েছিল।
উল্লেখ্য, কোভিড আবহেও জিবি সিনড্রোম রোগীর সন্ধান মিলেছিল। শহরের যে বেসরকারি শিশু হাসপাতালে জিবি সিনড্রোমে ভোগা সবচেয়ে বেশি রোগীর চিকিৎসা হয়, পার্ক সার্কাসের সেই ইনস্টিটিউট অফ চাইল্ড হেলথ (আইসিএইচ) হাসপাতালে বর্তমানে দুজন শিশু জিবি সিনড্রোম নিয়ে ভেন্টিলেশনে আছে। আইসিএইচ-এর পেডিয়াট্রিক ইন্টেন্সিভ কেয়ার ইউনিট (পিকু)-এর প্রধান চিকিৎসক প্রভাসপ্রসূণ গিরি জানাচ্ছেন, বছরে গড়ে সাধারণত ৮-১২ জন জিবি সিনড্রোমের রোগীর চিকিৎসা হয় তাঁদের হাসপাতালে। কিন্তু গত ২০২৩-এর অক্টোবর থেকে ২০২৪-এর জানুয়ারি পর্যন্ত শুধু চার মাসেই ১৪ জন এমন রোগীর চিকিৎসা হয়েছিল আইসিএইচে। তবে এবার তেমন বাড়াবাড়ি এখনও চোখে পড়েনি।
কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের পিকু-র প্রধান চিকিৎসক মিহির সরকার জানাচ্ছেন, বর্তমানে একজনই জিবি সিনড্রোম রোগী তাঁদের পিকু-তে চিকিৎসাধীন। তবে সেরে উঠছে সে। মুকুন্দপুর মণিপাল হাসপাতালের পিকু-র প্রধান চিকিৎসক সৌমেন মেউর জানাচ্ছেন, তাঁদের হাসপাতালে বছরে গড়ে ৫-৬টি জিবি সিনড্রোম কেস আসে। তবে এই মুহূর্তে কোনও রোগী ভর্তি নেই। একই সুর পিয়ারলেস হাসপাতালের সিইও সুদীপ্ত মিত্র কিংবা বিপি পোদ্দার হাসপাতালের গ্রুপ অ্যাডভাইজর সুপ্রিয় চক্রবর্তীর গলায়। বাইপাস লাগোয়া একটি বেসরকারি হাসপাতালেরই শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ সুমিতা সাহা জানাচ্ছেন, প্রতি ৪০ হাজার থেকে ১ লক্ষ শিশুর মধ্যে একজনের জিবি সিনড্রোম হতে পারে কোনও সংক্রমণের প্রভাবে। এটি একটি অটো-ইমিউন ডিজিজ। অর্থাৎ, সংক্রমণের প্রভাবে সক্রিয় হয়ে ওঠা শরীরের ইমিউনিটিই কখনও কখনও অতিসক্রিয় হয়ে উঠে জীবাণুর বদলে শরীরকেই আক্রমণ করে বসে। বিশেষজ্ঞরা জানাচ্ছেন, জিবি সিনড্রোমে শরীরের তিন রকম স্নায়ুতন্ত্রই (মোটর, সেনসরি ও অটোনোমাস) আক্রান্ত হয়ে গিয়ে শুধু পক্ষাঘাত নয়, শ্বাসযন্ত্র ও হৃদযন্ত্রের কাজও ব্যাহত করে। পাশাপাশি শরীরের তাপমাত্রা ও রক্তচাপ ঠিক থাকার স্বয়ংক্রিয় প্রক্রিয়াটিতেও প্রবল বিঘ্ন ঘটায়। ক্রিটিক্যাল কেয়ার বিশেষজ্ঞদের অভিমত ৮০ শতাংশ রোগী জিবি সিনড্রোম থেকে পুরোপুরি সেরে উঠলেও ১০-১৫% রোগীর সেরে উঠতে দীর্ঘদিন লেগে যায়। আর ৫-১০% রোগী মারা যায়।