কোনওটি সিনিয়র সিটিজেনদের জন্য উপকারী, কোনওটি আবার বাড়ির ছোট কন্যা-সন্তানের ভবিষ্যৎ গড়ার জন্য সেরা। পোস্ট অফিস সেভিংস স্কিমগুলির মধ্যে কোনটি গ্রাহকদের জন্য সবচেয়ে কার্যকরী হতে পারে, তা বুঝতে রয়েছে একাধিক মাপকাঠি। তবে একটি বিষয় সব ক্ষেত্রেই সমানভাবে খাটে। তা হল সঞ্চয়ের মানসিকতা। সেভিংস-এর কোনও বিকল্প নেই। তবে তার ফল আরও সুমিষ্ট হতে পারে, যদি তা করা হয় সঠিক স্কিমে। বৈশিষ্ট্য-সহ সেরা তিনটি তালিকা বেছে দিলেন নীলাঞ্জন দে
রিজার্ভ ব্যাংকের নীতি পরিবর্তনের ফলে লগ্নির বাজারে সুদের হার বেড়েছে। ব্যাংক এবং কর্পোরেট ডিপোজিটের ইন্টারেস্ট যে বেড়েছে তার খবর আমরা পাঠকদের জানিয়েছি। এবার দেখা যাক, এই পরিস্থিতিতে স্মল সেভিংস প্রকল্পের স্থান ঠিক কোথায়। তিনটি প্রধান পোস্ট অফিস সেভিংস স্কিমের কথা আলাদাভাবে এই লেখায় আলোচনা করব। পাশাপাশি প্রকল্পগুলির মূল বৈশিষ্ট্যগুলিও আরও একবার পাঠকদের মনে করিয়ে দেব।
# ন্যাশনাল সেভিংস সার্টিফিকেট
# সুকন্যা সমৃদ্ধি অ্যাকাউন্ট
# সিনিয়র সিটিজেনস সেভিংস স্কিম
সিনিয়র সিটিজেনস সেভিংস স্কিম
তালিকায় শেষে নাম উল্লেখ করলেও তালিকার সবথেকে জরুরি প্রকল্পটির কথা আমরা বিশেষভাবে আলোচনা করতে চাই। আজকের অনিশ্চয়তায় ভরা বাজারে, বয়স্ক নাগরিকের সুরক্ষা এবং নিরাপত্তার অভাব বেশ প্রকট। ইকুইটি এবং অন্য মার্কেটঘেঁষা প্রকল্পে ইদানীং লগ্নির জোয়ার এসেছে বটে, তবে অনেক প্রবীণ মানুষই তাতে বিশেষ উত্তেজনা বোধ করেননি। বরং এড়িয়ে গিয়েছেন-কারণ তো জানাই। রিটার্ন সংক্রান্ত অনিশ্চয়তা তথা ভোলাটিলিটি। নির্দিষ্ট হারে সুদ পাওয়ার গণ্ডির মধ্যেই যে তাঁরা থাকতে চান, তা আর নতুন করে বোঝাতে হবে না। তাঁরাই ভরসা রাখেন সরকারিভাবে স্বীকৃত, বয়স্ক নাগরিকের জন্য সুবিধাযুক্ত এই প্রকল্পটির উপর।
সিনিয়র সিটিজেনদের অতিপ্রিয় এই প্রকল্পের বৈশিষ্ট্যগুলির দিকে নজর দেওয়া যাক।
# সুদের হার : ৭.৬ শতাংশ, গত ১ অক্টোবর থেকে চালু হয়েছে।
# সুদ দেওয়া হয় কোয়ার্টারে একবার। ৩১ মার্চ, ৩০ সেপ্টেম্বর, ৩১ ডিসেম্বর এবং ৩০ জুন।
# ন্যূনতম লগ্নি : এক হাজার টাকা। সর্বোচ্চ লগ্নি : ১৫ লক্ষ টাকা
# ট্যাক্স বেনিফিট : Section 80C-র অন্তর্গত।
অন্যান্য জরুরি শর্ত : প্রিম্যাচিওর ক্লোজিং করা সম্ভব। তবে খোলার এক বছরের মধে্য অ্যাকাউন্ট করলে কোনও সুদ পাওয়া যাবে না। পাঁচ বছরের ম্যাচুরিটির শর্ত অনুযায়ী, পোস্ট অফিসে পাস বই দাখিল করে বন্ধ করতে পারেন। ‘এক্সটেনশন’ করাও যাবে, তার জন্য আলাদাভাবে দরখাস্ত দিতে হবে। তিন বছরের জন্য মেয়াদ বাড়ানো যেতে পারে।
মনে রাখতে হবে, প্রকল্পে বিনিয়োগ করলে যে সুদ পাবেন, তা কিন্তু করযোগ্য। তবে মোট সুদ সেক্ষেত্রে ৫০,০০০ টাকার বেশি হতে হবে এক আর্থিক বর্ষে। এই প্রসঙ্গে বিনিয়োগকারী যেন TDS (ট্যাক্স ডিডাকটেড অ্যাট সোর্স) সংক্রান্ত নিয়ম জেনে নেন।
SCSS যে কেউ নিজের নামে (৬০ বছর বয়সি হতে হবে অন্ততপক্ষে) অথবা স্ত্রী/স্বামীর সঙ্গে জয়েন্টলি খুলতে পারেন। সুদের হার পরিবর্তনের বাজারে SCSS সম্বল করে দেশের বহু প্রবীণ নাগরিক সংসার সামলান।
সুকন্যা সমৃদ্ধি অ্যাকাউন্ট
বাড়ির ছোট মেয়েদের জন্য বিশেষভাবে গঠিত এই স্কিমটি যথেষ্ট জনপ্রিয়। তার কারণও আছে। সুদের হার মোটামুটি ভাল, তাই অনেক বাবা-মায়েরাই আজ কন্যাসন্তানের ভবিষ্যতের কথা ভেবে সুকন্যা সমৃদ্ধিতে ভরসা রাখেন। মূল বৈশিষ্ট্যগুলি সংক্ষেপে তালিকাযুক্ত করা হল
# সুদের হার : ৭.৬ শতাংশ (গত বছরের এপ্রিল থেকে চালু)।
# ন্যূনতম : ২৫০ টাকা দিয়ে শুরু করা যায়।
# সর্বোচ্চ : ১,৫০,০০ টাকা একটি অর্থবর্ষে।
# লাম্পসাম হিসাবে, অথবা কিস্তিতে, জমানো যাবে।
# কন্যা সন্তানের বাবা/মা খুলতে পারেন এই অ্যাকাউন্ট, তবে মেয়েটির বয়স ১০ বছরের কম হতে হবে।
# একটি মেয়ের নামে একটি মাত্র অ্যাকাউন্ট হবে, সে দেশের যে কোন প্রান্তেই হোক না কেন।
# এখানেও Section 80C-র সুবিধা পাবেন অায়করদাতা হিসাবে।
[আরও পড়ুন: ট্যাক্স বাঁচবে, ইনডেক্স-সুবিধাও মিলবে, জেনে নিন এই মিউচুয়াল ফান্ডের খুঁটিনাটি]
মনে রাখতে হবে যে, সুকন্যা সমৃদ্ধিতে আপনি টাকা জমাতে পারবেন অ্যাকাউন্ট খোলার পর ১৫ বছর পর্যন্ত। সুদ বছরে একবার ক্রেডিট করা হবে, অর্থবর্ষের শেষ। তবে এই সুদ ট্যাক্স-ফ্রি। যে কোনও কন্যাসন্তানের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট অ্যাকাউন্ট চালাতে পারবেন বাবা/মা যতক্ষণ না মেয়েটির বয়স ১৮ বছর হচ্ছে। প্রাপ্তবয়স্ক হয়ে গেলে, অথবা দশম শ্রেণী উত্তীর্ণ হলে, উইথড্রয়াল করা সম্ভব।
লগ্নিকারীরা যেন এই উইথড্রয়াল সংক্রান্ত অন্যান্য শর্তগুলি ভালভাবে বুঝে নেবেন। এছাড়াও, প্রিম্যাচিওর ক্লোজিং নিয়ে যে শর্তগুলি আছে, সেগুলিও জানা দরকার।
ম্যাচুরিটির ক্ষেত্রে দুটি জরুরি শর্ত :
#এক, অ্যাকাউন্ট ওপেনিংয়ের ২১ বছর
#দুই, মেয়ের বিয়ে/প্রাপ্তবয়স্ক হয়ে যাওয়ার পর।
ন্যাশনাল সেভিংস সার্টিফিকেট (NSC)
ন্যাশনাল সেভিংস সার্টিফিকেটের আলাদা কোনও বৈশিষ্ট্য নেই – SCSS বা SSA-র তুলনায় কিঞ্চিৎ ম্যাড়ম্যাড়ে মনে হলেও, সঞ্চয় করার ক্ষেত্রে এর ভূমিকা খুবই ইতিবাচক। পাঁচ বছরের মেয়াদের জন্য NSC-র সমকক্ষ পাওয়া যাবে না (সাবেকি ডিপোজিটের সঙ্গে তুলনা টানা হচ্ছে না)। এর প্রধান বৈশিষ্ট্য :
# সুদের হার : ৬.৮ শতাংশ (ম্যাচুরিটির সময় পাওয়া যাবে)
# হিসাব মতো, এক হাজার টাকা যদি আজ লগ্নি করেন, মেয়াদের শেষে আপনি পাবেন ১৩৮৯ টাকা। এক্ষেত্রে লগ্নির কোনও সর্বোচ্চ লিমিট ধার্য করা হয়নি।
# সিঙ্গল অথবা জয়েন্ট অ্যাকাউন্ট খুলতে পারবেন। একসঙ্গে তিন জন অ্যাডাল্ট নাগরিক এখানে বিনিয়োগ করতে পারেন। তবে মাইনর বাচ্চার ক্ষেত্রে গার্জেন থাকতে হবে।
# এই প্রকল্পে যে কোনও সংখ্যক অ্যাকাউন্ট খোলা সম্ভব। ডিপোজিটের খাতিরে Section 80C-র সুবিধা এখানেও পাবেন। পাঁচ বছরে ম্যাচুরিটি, তবে সিঙ্গল অ্যাকাউন্ট হোল্ডারের মৃত্যুতে অ্যাকাউন্টটি বন্ধ হবে। কয়েকটি বিশেষ শর্ত পূরণ না হলে NSC-এর ট্রান্সফার করা সম্ভব হবে না।
কিছু কড়া নিয়ম থাকলেও, মনে রাখতে হবে যে NSC-বাঁধা রেখে অনেকেই ধার নেওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। হ্যাঁ, এমনটি করা সম্ভব, এবং সেই জন্য নির্দিষ্ট অ্যাপ্লিকেশন ফর্ম আছে। সংশ্লিষ্ট পোস্ট অফিসে সেই ব্যবস্থা করা যায়। গ্রাহক মনে করলে কোন ব্যাঙ্কে গিয়ে NSC-র কাগজপত্র রেখে প্লেজ করতে পারেন। হাউজিং ফাইন্যান্স কোম্পানির জন্যও প্লেজ অনেক সময় জরুরি হয়ে পড়ে।
সঞ্চয়-এর বক্তব্য :
সবমিলিয়ে স্মল সেভিংসের জগতে অাজও জমজমাট। প্রয়োজনীয়ও বটে, কারণ অনিশ্চিত বাজারে নিশ্চয়তা দিতে পারে এইসব প্রকল্পগুলি। সাধারণ লগ্নিকারী এই সমস্ত স্কিমে ভরসা রাখেন, টাকা জমানোর পক্ষে অনেকেই এগুলি আদর্শ বলে মনে করেন। যতই অন্যান্য বাজার বাড়ুক, স্মল সেভিংয়ের চিরকালীন এক আকর্ষণ আছে। সেই ‘অ্যাপিল’ অটুট থাকবে আগামিদিনেও।
(লেখক লগ্নি পরামর্শদাতা)