চারুবাক: বাংলা সিনেমার দুই কিংবদন্তি ব্যক্তিত্ব উত্তমকুমার এবং মৃণাল সেন। একজন অভিনয় জগতের প্রবাদপ্রতিম শিল্পী। অন্যজন শুধু বাংলার নন, সর্বভারতীয় ক্ষেত্রেও ফিল্ম নির্দেশক হিসেবে এক ব্যতিক্রমী শিল্পী। এঁদের দুজনকে নিয়ে একই সময়ে দুটি ছবি করলেন সৃজিত মুখোপাধ্যায় (Srijit Mukherji )। এর তাঁর প্রশংসা অবশ্যই প্রাপ্য। বাণিজ্যিক ভবিষ্যতের পরোয়া না করে এমন দুটি কনসেপ্ট নিয়ে ছবির ভাবনাটাই তো যথেষ্ট। 'অতি উত্তম' তৈরির সময় ব্যবসায়িক সাফল্যের কথা হয়তো সৃজিত ভাবেননি। নিজের সিনেমার মাধ্যমকে মহানায়ককে সম্মান জানাতে চেয়েছিলেন পরিচালক। এবার 'পদাতিক'-এর (Padatik) পালা। মৃণাল সেনের জীবনকাহিনি।
ব্যক্তি মৃণাল সেন, পিতা মৃণাল সেন, স্বামী মৃণাল সেন, পরিচালক মৃণাল সেন- এই মানুষটার পরিসর তো একে সীমাবদ্ধ নয়, একাধিক মৃণাল সেন! যিনি কখনও গল্প বলতে চেয়েছেন (নীল আকাশের নিচে বা বাইশে শ্রাবণ), কখনও গল্প ভাঙতে চেয়েছেন (ভুবন সোম), রাজনীতিক মৃণাল সেন ('ইন্টারভিউ', 'পদাতিক'), বাঙালি মধ্যবিত্তের প্রতিনিধি মৃণাল সেন ('একদিন প্রতিদিন', 'চালচিত্র') বাস্তবকে পকেটস্থ করার মৃণাল সেন ('আকালের সন্ধানে', 'মহাপৃথিবী') বা এক সিনেমার প্রচলিত ব্যকরণ ভেঙে নতুন ভাষা তৈরির কারিগর মৃণাল সেন। সুতরাং সৃজিতের কাছে কাজটা এক ধরনের চ্যালেঞ্জই ছিল বলতে পারি। চ্যালেঞ্জের প্রথম ধাপ চিত্রনাট্য লেখা।
'ইন্টারভিউ' ছবিতে ট্রামের ভেতর অভিনেতা রঞ্জিত মল্লিককে দিয়ে যেভাবে দর্শকের সঙ্গে আলাপচারিতায় ঘটিয়ে সিনেমার ন্যারেটিভ ভাঙার প্রথম ধাপটি মৃণাল সেন তৈরি করেছিলেন, সৃজিতও প্রায় একই দৃশ্যের পুনরাবৃত্তি করলেন অল্পবয়সী মৃণাল সেন চরিত্রের অভিনেতা কোরক সামন্ত দিয়ে। এবং যতক্ষণ না চঞ্চল চৌধুরীর চেহারায় মৃণাল সেন পর্দায় না এলেন, ততক্ষণ চিত্রনাট্য কেমন আগোছালো রইল। এরই মধ্যে রবীন্দ্রনাথের মরদেহ নিয়ে বিশৃংখলা, শেষ যাত্রার সময় "কহো কানে কানে/ শোনাও প্রাণে প্রাণে /মঙ্গল বারতা" গানটির ব্যবহার ছবির কেন্দ্রীয় বক্তব্যের ইঙ্গিত দিয়ে যায়।
[আরও পড়ুন: নির্ভয়ার প্রসঙ্গ তুলে RG Kar কাণ্ডের তীব্র প্রতিবাদ আলিয়ার, দিলেন পরিসংখ্যান]
তবে মৃণাল সেন হিসেবে চঞ্চল চৌধুরী এবং পরিচালকপত্নী গীতা সেনের চেহারায় মনামী ঘোষ ক্যামেরার সামনে আসার পর ধারাবাহিক ভাবে মৃণাল সেনের জীবনের ট্র্যাকে ছবিটি ফিরে আসে। একের পর এক তাঁদের দাম্পত্য জীবনের খুঁটিনাটির সঙ্গে জড়িয়ে যায় উত্তমকুমারকে নিয়ে প্রথম ছবি 'রাতভোর' বানানোর তিক্ত অভিজ্ঞতা থেকে নিজের মতো করে 'বাইশে শ্রাবণ' তৈরির কিঞ্চিৎ আনন্দপ্রাপ্তির মুহূর্তও। একদিকে তাঁদের ক্ষুন্নিবৃত্তির জন্য লড়াই, অন্যদিকে নিজের মনের মতো সিনেমা বানানোর সংগ্রাম চলতে থাকে। এই পর্বে সৃজিতের চিত্রনাট্য অনেক বেশি সুগ্রন্থিত। চিত্রায়নেও আনতে পেরেছেন মৃণাল সেন ঘরানার ন্যারেটিভ ভাঙার ভঙ্গি। এসেছে ছেলে কুণালের সঙ্গে খোলামেলা আড্ডা, অনুপকুমারের নাম উল্লেখ হল শুধু, ওঁকে একবার দেখালে ভালো হতো।
তবে ছবির আকর্ষণীয় দৃশ্যগুলো হল মৃণাল সেনের সঙ্গে সত্যজিৎ রায়ের ছবি নিয়ে দীর্ঘ ও বন্ধুত্বপূর্ণ অথচ তার্কিক আলোচনা। মৃণাল সেনের বাড়িতে ঢুকে ক্ষুধার্ত ঋত্বিকের খেতে চাওয়া এবং খাওয়ার দৃশ্যটি। তবে হাসপাতালে ঋত্বিকের শয্যার পাশে কখনও মৃণাল-সত্যজিৎ একসঙ্গে দাঁড়িয়েছিলেন, এমনটা শুনিনি। মৃণাল সেনের প্রিয় শহর কলকাতা, বলতেন 'এল ডোরাডো!' সেই শহরের দুটি প্রধান রাজপথের ওপর মৃণাল সেনকে নিয়ে সৃজিত দুটি দৃষ্টিনন্দনতো বটেই, স্মৃতিতে বাঁধিয়ে রাখার মতো শট নিয়েছেন। এর জন্য কৃতিত্ব আলোকচিত্রী ইন্দ্রনাথ মারিককেও দিতে হবে।
ইন্দ্রদীপ দাশগুপ্ত সুচিন্তিত ভাবেই ব্যবহার করেছেন কিছু গণসঙ্গীতের লাইন এবং বিখ্যাত হিন্দি গান "জিন্দা হ্যায় তো জিন্দগি/ স্বর্গ উতার লা জমিন পর!" অভিনয়ে চঞ্চল চৌধুরী (Chanchal Chowdhury) ধারাবাহিকতা বজায় রেখেছেন। তবে তাঁর মেকআপে সেটি বজায় থাকেনি। সত্যজিতের চরিত্রে জীতু কমল 'অপরাজিত' ছবির মতোই। গীতা সেনের চরিত্রে মনামী ঘোষ (Monami Ghosh) মধ্যবিত্ত গৃহবধূর মেজাজটি ফুটিয়েছেন। আসলে সৃজিতের 'পদাতিক' মৃণাল সেনের সিনেমা যাত্রার এক প্রকৃত যাত্রিক। ছবির বিভিন্ন জায়গায় মৃণাল সেনের 'বাইশে শ্রাবণ', 'পদাতিক' , 'আকালের সন্ধানে', 'কলকাতা ৭১', ইত্যাদি ছবির অংশগুলির ব্যবহার অত্যন্ত সুপ্রযুক্ত, প্রাসঙ্গিক। অতীত ও বর্তমান যেন এক সমান্তরাল সময়ের ইঙ্গিত দিতে চায়। বেশ শিল্পসম্মত অংশগুলির নির্বাচন।
সিনেমা - পদাতিক
অভিনয়ে - চঞ্চল চৌধুরী, মনামী ঘোষ, কোরাক সামন্ত, ঐশানী দে, বরুণ চন্দ, জীতু কমল, সুজন মুখোপাধ্যায়, সম্রাট চক্রবর্তী
পরিচালনায় - সৃজিত মুখোপাধ্যায়