রাহুল গান্ধী সম্প্রতি একটি বিবৃতিতে বলেছেন, ‘হিন্দু ধর্ম আর হিন্দুত্ববাদী রাজনীতি এক নয়।’ এই মন্তব্য করার জন্য রাহুল গান্ধীকে অনেকেই উপহাস করছেন। কিন্তু এই কথাই স্যর উইলিয়াম জোনসও তাঁর ‘এশিয়াটিক সোসাইটি’-র বক্তৃতায়, তাঁর লেখা চিঠিতে বারবার বলার চেষ্টা করেছেন। রাজনৈতিক হিন্দুত্ববাদের সঙ্গে হিন্দু ধর্মের ফারাক রয়েছে। লিখছেন জয়ন্ত ঘোষাল
১৭৮৩ সালের সেপ্টেম্বর মাস। ‘ক্রোকোডাইল’ নামের একটি জাহাজ এসে ভিড়ল কলকাতা বন্দরে। জাহাজ থেকে নামলেন স্যর উইলিয়াম জোনস। শুরু হল তাঁর জীবনের ‘ভারত-পর্ব’। ‘এশিয়াটিক সোসাইটি’-র প্রাণপুরুষ স্যর উইলিয়াম জোনসের সংস্কৃত ভাষা এবং হিন্দু ধর্মের প্রতি অনুরাগ কতটা ছিল, তা আমরা প্রায় প্রত্যেকেই জানি।
জাহাজে আসার সময় ‘ইন্ডিয়া’ তথা ভারতকে কেন্দ্র করে সমগ্র এশিয়াভিত্তিক নানা বিষয়ে গবেষণার চিন্তা তাঁর মনে ছিল। এ-বিষয়ে তিনি তাঁর স্ত্রী-র সঙ্গেও আলোচনা করতেন। উইলিয়াম জোনস তাঁর লেখা বিভিন্ন চিঠিতে বারবার উল্লেখ করেছেন হিন্দু ধর্মের শিকড়ের কথা। তিনি নানা সংস্কৃত গ্রন্থ সংগ্রহ করতেন এবং গবেষণা করতেন। খ্যাতনামা প্রাচ্যবিদ্যাবিদ চার্লস উইলকিন্সকে লেখা একটি চিঠিতে উইলিয়াম জোনস লিখছেন, “আমি বেনারস থেকে সবেমাত্র একটি সংস্কৃত গ্রন্থ পেয়েছি। আলি ইব্রাহিম খান সেই সংস্কৃত গ্রন্থটি পাঠিয়েছিলেন। এই গ্রন্থটি আমাকে হতবুদ্ধি করে দিয়েছিল। আমার মনে হয়, যতক্ষণ না এটি থেকে আমি অর্থ উদ্ধার করতে পারি, ততক্ষণ আমি হতবুদ্ধি হয়ে থাকব। মলাটের পৃষ্ঠদেশে গ্রন্থটিকে ‘ইউতমৎইয়াকিয়ুলক’ নামে অভিহিত করা হয়েছে। এর ভিতরে বলা হয়েছে, ‘ধর্মশাস্ত্র মনুস্মৃতি’।” উইলিয়াম জোনস আরও লিখেছেন, ‘এই আকর্ষণীয় রচনাটির একটি অনুলিপি পেলে, তারপর ভাল কোনও পণ্ডিতের সহযোগিতা নিয়ে আমি মূল গ্রন্থটির অধ্যয়ন শুরু করব।’ এইভাবে তিনি সংস্কৃত শ্লোক চর্চা করতেন।
[আরও পড়ুন: পুরনো বন্ধুত্বের স্পর্শ, অতিরিক্ত মার্কিন নির্ভরতা থেকে বেরিয়ে রাশিয়ার পাশেই ভারত]
উইলিয়াম জোনস ১৭৮৬ খ্রিস্টাব্দে সূর্যস্তোত্র রচনা করলেন। এটি ‘দ্য এশিয়াটিক জার্নাল অ্যান্ড মান্থলি মিসলেনি’-তে প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল। তাঁর রচিত এই স্তোত্রে সৌরশক্তির উৎস সূর্যদেবের প্রতি শ্রদ্ধা প্রকাশ করা হয়েছে। তিনি লিখেছেন, ‘হিন্দু ধর্মের মজা এইখানে যে, বৈজ্ঞানিক উপাদানের সঙ্গে পুরাণকথার মিশ্রণ ঘটছে এই স্তোত্রে স্তোত্রে।’ মার্চ মাসে কলকাতার সূর্যের প্রখরতার প্রতি ইঙ্গিত করছেন তিনি। তারপর বলছেন, গঙ্গায় এসে মানুষ যে সূর্যকে প্রণাম জানায়, সেই হিন্দু আচারের সঙ্গে কী সাংঘাতিকভাবে নানা সামাজিক প্রাসঙ্গিকতা জড়িয়ে রয়েছে! উইলিয়াম জোনসের এইসব চিঠি পড়তে পড়তে দেখছিলাম, ওঁকে এইসব সংস্কৃত গ্রন্থ এবং হিন্দু ধর্মের নানা পুরাণকোষ পাঠিয়েছিলেন আলি ইব্রাহিম খান, যিনি নিজে হিন্দু ধর্মাবলম্বী ছিলেন না।
পাঠক হয়তো ভাবছেন, এখন হঠাৎ উইলিয়াম জোনসের কথা মনে করছি কেন। রাহুল গান্ধী সম্প্রতি একটি বিবৃতিতে বলেছেন, ‘হিন্দু ধর্ম আর হিন্দুত্ববাদী রাজনীতি এক নয়।’ এই মন্তব্য করার জন্য রাহুল গান্ধীকে অনেকেই উপহাস করছেন। আবার অনেকে এও বলছেন যে, এই সব কথা বলা মানে বিজেপির আরও সুবিধা করে দেওয়া। কেননা, বিজেপি হিন্দুত্বকে রাজনৈতিক অ্যাজেন্ডা করতে চাইছে। কাজেই সে-ব্যাপারে প্রতিক্রিয়া জানানোর অর্থ হল, বিজেপির ফাঁদে পা দেওয়া।
সম্প্রতি জয়পুরে অশোক গেহলটের এক বিশাল জনসভা হল। সেখানে সোনিয়া গান্ধী উপস্থিত ছিলেন, যদিও তিনি সেখানে বক্তৃতা দেননি। রাহুল এবং প্রিয়াঙ্কা দু’জনেই সেখানে বক্তৃতা দেন। রাহুল হিন্দুত্ববাদ এবং হিন্দু ধর্মের ফারাকের কথা বললেও প্রিয়াঙ্কা সে-পথে না গিয়ে আক্রমণ করলেন নরেন্দ্র মোদি সরকারকে। উল্লেখ করলেন মূল্যবৃদ্ধি, মুদ্রাস্ফীতি, পেট্রোল-ডিজেলের দাম, কর্মহীনতা, করোনা প্রতিষেধকের বণ্টন নিয়ে প্রশাসনিক ব্যর্থতা ইত্যাদির কথা।
কংগ্রেসের বেশ কিছু নেতা আমাকে বলছিলেন, বরং মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বিজেপির ফাঁদে পা না দিয়ে, নিজে চণ্ডীপাঠ করে, কলকাতা পুরনির্বাচনের আগে ‘ইউনেসকো’-র দুর্গাপুজোকে স্বীকৃতি দেওয়ার বিষয়টিকে তুলে এনে আরও সঠিকভাবে মোদির বারাণসীর গঙ্গা-স্নানের রাজনীতির মোকাবিলা করতে পারছেন। অর্থাৎ, মমতা কাঁটা দিয়ে কাঁটা তুলছেন। হালে সলমন খুরশিদ থেকে শুরু করে শশী থারুর-সহ কংগ্রেসের বহু নেতা তো বই লিখেও হিন্দু ধর্ম আর হিন্দুত্বের তফাতটা বোঝানোর চেষ্টা করেছেন। কিন্তু প্রশ্ন উঠছে, এসব তাত্ত্বিক আলোচনা করে, বিশেষত হিন্দু বলয়ে কি রাজনীতির ফায়দা পাওয়া যায়? কেননা, সেখানে ‘হর হর মহাদেব’ ধ্বনি দিয়েই বিজেপি রাজনীতি করছে।
সন্দেহ নেই, পরিস্থিতিটা জটিল। কিন্তু এখন রাজনীতির ফায়দা কার হবে এবং কার হবে না- সে আলোচনা না করে, আমি শুধু এটাই বলতে চাইছি যে, রাহুল গান্ধী যেটা বলতে চাইছেন, সেই কথাটাই কিন্তু স্যর উইলিয়াম জোনসও তাঁর ‘এশিয়াটিক সোসাইটি’-র বক্তৃতায়, তাঁর লেখা চিঠিতে বারবার বলার চেষ্টা করেছেন। বিশেষত, বাংলা এবং বাঙালির ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, হিন্দু ধর্ম ঠিক হিন্দুত্ববাদী অ্যাজেন্ডায় কোনও দিনই পরিচালিত হয়নি। হিন্দু ধর্ম বহুত্ববাদী ধর্ম, যা সকলকে নিয়ে চলার দর্শনেই লালিত-পালিত হয়েছে।
১৮৭২ সালের সেনসাসের একটি অধ্যায়ের শিরোনাম ছিল ‘স্টেটমেন্ট অফ ন্যাশনালিটিজ, রেসেস, ট্রাইবস অ্যান্ড কাস্ট’। ‘রেজিস্টার অফ দ্য ব্রিটিশ কলোনিজ অফ বেঙ্গল অফিস’ লিপিবদ্ধ করেছিল যে, হুগলি এবং হাওড়ায়, যেটি তখন বর্ধমান ডিভিশনের অধীনে ছিল, সেখানে নানা ধরনের ‘ন্যাশনালিটিজ’ রয়েছে। ২৫ জন আর্মেনিয়ান, ১২ জন ইহুদি এবং চার জন চাইনিজ, এমনকী, বহু ফরাসি নাগরিকও ছিলেন। তার ফলে বাংলার যে নাগরিক সমাজ ও সংস্কৃতি গড়ে উঠেছিল, সেখানে বিভিন্ন ধর্মের সমাবেশ হয়েছিল। দেখা যাচ্ছে যে, বৌদ্ধ ধর্ম, ইসলাম ধর্ম, খ্রিস্টান ধর্ম, হিন্দু ধর্মের পাশাপাশি এই অন্যান্য ধর্মগুলিও পশ্চিমবঙ্গের জেলায় জেলায় উপস্থিত ছিল।
বাংলার নাগরিক সমাজে বাঁকবদল ঘটে ঠাকুর শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণের সূত্রে (১৮৩৬-১৮৮৬)। ক্যালিফোর্নিয়া স্টেট ইউনিভার্সিটির সমাজতত্ত্বের এমিরিটাস অধ্যাপক অশোক বসু তাঁর ‘দ্য রাইজ অফ সিভিল সোসাইটি ইন বেঙ্গল’ বইয়ে দেখিয়েছেন যে, ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের যে হিন্দু ধর্ম, তা আসলে স্পিরিচুয়াল হিউম্যানিজম। এই মানবতাবাদকে স্বামী বিবেকানন্দ (১৮৬৩-১৯০২) শুধু ভারতে নয়, সমগ্র বিশ্বে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন। আসলে সেই হিন্দু ধর্মের কথা তাঁরা বললেন, যেখানে বৌদ্ধ ধর্ম, খ্রিস্টান ধর্ম, জৈন ধর্ম, ইসলাম ধর্ম, এমনকী, জরাথ্রুস্টবাদও মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়।
১৮৫৫ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া রেলওয়ে কোম্পানি তৈরি হয়। আর তার সঙ্গে প্রযুক্তির যে অনুপ্রবেশ ঘটে ভারতীয় মাটিতে, তা হিন্দু ধর্মকে আরও ফুলে ফলে বিকশিত করে। উইলিয়াম জোনস সুদূর লন্ডন থেকে এসে হিন্দু ধর্মের এই সারসত্যটি বুঝে ফেলেছিলেন। তিনি অক্সফোর্ডে উচ্চশিক্ষা পেয়ে কলকাতায় আসেন। তিনি বারবার বলেছেন, ‘আমি যেন এক তৃষ্ণার্ত হরিণ’। সংস্কৃত ভাষায় আমি একটি শ্লোক রচনা করেছি, যেখানে আমি বলতে চেয়েছি, ‘এক তৃষ্ণার্ত হরিণ যেমন মিষ্টি জলের সরোবরের দিকে ছুটে যায়, আমি তেমনই সমস্তরকম পিপাসা নিবৃত্তির জন্য অমৃতময় জ্ঞান-রূপ জলাশয়ের প্রতি ধাবিত হয়েছি।’ আর সেই জলাশয় হিন্দু শাস্ত্রের মধ্যে নিহিত ছিল, যে হিন্দু শাস্ত্র কখনও মুসলিম-বিরোধী তো দূরের কথা, কোনও ধর্মকেই আঘাত করার কথা বলে না। তাহলে রাজনৈতিক হিন্দুত্ববাদ যদি অন্য ধর্মের প্রতি অবজ্ঞা প্রকাশ করে, তাদেরকে দূরে সরিয়ে দেয়, ইসলামকে বিশ্ব-দীক্ষার নিরিখে না দেখে শুধু মৌলবাদের প্রিজমেই দেখে- তবে সেই রাজনীতি কি নতুন ভারত গঠনের জন্য কাম্য?