সংবাদ প্রতিদিন ডিজিটাল ডেস্ক: ২৭ বছর পর দিল্লি বিজয়। কেজরিওয়ালের গ্যারান্টি ভুলে রাজধানীর বাসিন্দারাও ভরসা রাখলেন মোদি গ্যারান্টিতে। রাজধানীর বুকে উড়ল গেরুয়া নিশান। বিজেপির এই বিরাট সাফল্যের নেপথ্য কারণ কী?
১। বিভাজন ভুলে সঠিক ইস্যু নির্বাচন: হিন্দু-মুসলিম বিভাজন নয়। দিল্লির নির্বাচনে (Delhi Assembly Election Results 2025) একেবারে মানুষের ইস্যু নিয়ে মানুষের কাছে গিয়েছে বিজেপি। ২০২০ ভোটের আগে দিল্লি দাঙ্গাকে সামনে রেখে প্রবল মেরুকরণের চেষ্টা করেছিল বিজেপি। তাতে হীতে বিপরীত হয়। একচেটিয়াভাবে মুসলিম ভোট চলে যায় আপের খাতায়। এবার আর সেই ভুল নয়। যোগী আদিত্যনাথের মতো হিন্দুত্ববাদী নেতাকে প্রচারে এনেও সেভাবে হিন্দুত্বের প্রচার করেনি বিজেপি। বরং তাঁরা পুরো নির্বাচনে ফোকাস করেছে যমুনার জল, দিল্লির দূষণ, অনুন্নয়নের মতো স্থানীয় ইস্যুকে। কেজরিওয়ালের দুর্নীতি বিরোধী এবং আমআদমি ভাবমূর্তিকে চ্যালেঞ্জ করার লক্ষ্যে আবগারি দুর্নীতি এবং শিশমহলের মতো ইস্যু তুলে জোরকদমে প্রচারে নামে গেরুয়া শিবির। আসলে এবার দিল্লিতে বিজেপির কাজটাও সহজ ছিল। কেজরিওয়াল লড়ছিলেন ১০ বছরের প্রতিষ্ঠান বিরোধিতার বিরুদ্ধে। ফলে তাঁর সরকারের খামতির সংখ্যাও নেহাত কম ছিল না। বিজেপি শুধুই সেগুলিকে মানুষের সামনে তুলে ধরেছে।
২। খয়রাতিতে আপকে টেক্কা: দিল্লিতে আপের সাফল্যের অন্যতম কারণ ছিল খয়রাতি। কেজরিওয়ালের বিনামূল্যে শিক্ষা, মহল্লা ক্লিনিকের মাধ্যমে বিনামূল্যে চিকিৎসা, বিনামূল্যে মহিলাদের বাসযাত্রা, ২০০ ইউনিট পর্যন্ত বিনামূল্যে বিদ্যুৎ পরিষেবার মতো প্রকল্প এক সময় গোটা দেশে উদাহরণ হিসাবে উঠে আসে। বিজেপি শুরুর দিকে এই রেওড়ির রাজনীতির বিরোধিতা করলেও পঁচিশের নির্বাচনের আগে পুরোপুরি অবস্থান বদলে নেই। খয়রাতির ঘোষণায় কেজরিওয়ালকেও টেক্কা দেয় গেরুয়া শিবির। দিল্লিতে আয়ুষ্মান ভারত প্রকল্প চালু, গরিব মহিলাদের মাসে ২৫০০ টাকা করে অনুদান, ৫০০ টাকায় সিলিন্ডার, বিনামূল্যে বিদ্যুতের মতো প্রকল্প ঘোষণা করে বিজেপিও। ভোটের বাজারে সেটাও বড় ফ্যাক্টর হয়ে দাঁড়িয়েছে।
৩। নেতাদের মুখে লাগাম: প্রবেশ বর্মা, কপিল মিশ্র, রমেশ বিধুরী, অনুরাগ ঠাকুর। বিজেপির এই নেতারা কোনও না কোনওভাবে দিল্লির নির্বাচনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। এঁরা প্রত্যেকেই আরও একটি কারণে 'কুখ্যাত', সেটা হল ঘৃণাভাষণ। এদের প্রত্যেকের মুখে কোনও না কোনও সময় মুসলিম বিদ্বেষী কথা শোনা গিয়েছে। বিভাজনমূলক বয়ান শোনা গিয়েছে। কিন্তু এবারে দিল্লির ভোটপর্বে এই 'বাচাল' নেতাদের মুখে একপ্রকার লাগাম পরিয়ে রেখেছিল বিজেপি। গোটা ভোটের প্রচারপর্বে এদের কারও মুখে কোনও বিতর্কিত বয়ান শোনা যায়নি। আসলে বিজেপি এবার কোনওভাবেই ধর্মীয় মেরুকরণ চায়নি। কারণ মেরুকরণ হলেই দলিত এবং মুসলিম ভোট একচেটিয়ে আপের খাতায় চলে যেতে পারত, যা বেশ কিছু আসনে নির্ণায়ক শক্তি।
৪। মধ্যবিত্ত ভোট: দিল্লি সরকারের পাশাপাশি হাজারো কেন্দ্রীয় মন্ত্রক রয়েছে দিল্লিতে। রয়েছেন কয়েক লক্ষ কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মচারী। তা ছাড়া, বিভিন্ন সেনাশিবিরের বিপুল সংখ্যক জওয়ান ও অফিসারদের বড় অংশও দিল্লির ভোটার। সব মিলিয়ে দিল্লিতে প্রায় ৬৫ শতাংশ ভোটার মধ্যবিত্ত। এতদিন কেজরিওয়ালের দুর্নীতি বিরোধী স্বচ্ছ্ব ভাবমূর্তি, আমআদমির মতো জীবনযাপনে আস্থা রেখে মধ্যবিত্ত ভোটারদের একটা বড় অংশ আপকে সমর্থন করত। দিল্লির নিম্ন মধ্যবিত্ত এবং মধ্যবিত্তরা তাঁকে নিজেদের প্রতিনিধি মনে করতেন। কিন্তু আবগারি দুর্নীতি, শিশমহলের প্রচারে কেজরির এই দুর্নীতি বিরোধী স্বচ্ছ্ব ভাবমূর্তি চুরমার করে দেয় বিজেপি। তারপর ভোটের ঠিক দিন চারেক আগে কেন্দ্রীয় বাজেটে মধ্যবিত্তর জন্য বিরাট বোনাঞ্জা ঘোষণা। আয়করে বিরাট ছাড় মধ্যবিত্তর মন পুরোপুরি গেরুয়ামুখী করে দেয়।
৫। ভোট ম্যানেজমেন্ট: ভোটে জেতার জন্য ইস্যু, প্রচার, নেতার যেমন প্রয়োজন, তেমনই প্রয়োজন ভোট ম্যানেজমেন্টের। এই মুহূর্তে বিজেপির ভোট মেশিনারির জুড়ি মেলা ভার। এই দিল্লির ভোটেই একেকটা বিধানসভা কেন্দ্রে ৩-৫ জন করে সাংসদকে প্রচারে নামায় বিজেপি। বিভিন্ন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী, উপমুখ্যমন্ত্রী এবং প্রভাবশালী নেতাদেরও নামানো হয়। হাজার হাজার ঘরোয়া মিটিং, মোদি, শাহদের বড় জনসভা করিয়ে ন্যারেটিভ তৈরি করা, আপদা, শিশমহলের প্রচার। এসবই বিজেপি করেছে সুপরিকল্পিতভাবে।