সংবাদ প্রতিদিন ডিজিটাল ডেস্ক: মঙ্গলবার রাত সাড়ে দশটা নাগাদ প্রয়াত হয়েছেন সাহারা গোষ্ঠীর কর্ণধার সুব্রত রায়। কিন্তু তিনি কি একজন ব্যক্তিমাত্র? যাঁরা গত শতকের সাতের দশক থেকে তাঁর উত্থান ও নতুন সহস্রাব্দে এসে তাঁর বিতর্কে জড়িয়ে পড়া ও হাজতবাসের ইতিবৃত্ত সম্পর্কে ওয়াকিবহাল তাঁরা জানেন সুব্রত রায় নামটার ব্যাপ্তি তার চেয়ে অনেকটাই বেশি। স্বপ্ন ও স্বপ্নভঙ্গ, সাফল্য ও ব্যর্থতার নিক্তিতে দেখলে সুব্রত রায় একজন নায়ক, যিনি পরবর্তীতে ট্র্যাজিক নায়কে পরিণত হয়েছিলেন।
স্বপ্ন ছিল সেনাবাহিনীতে যাবেন। কিন্তু তা হয়নি। পড়াশোনাতেও তেমন ভাল ছাত্র ছিলেন না। আইএসসিতে অকৃতকার্যও হয়েছিলেন। তবে শেষপর্যন্ত গোরক্ষপুর থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং ডিপ্লোমা পাওয়া। পরে গোরক্ষপুর থেকেই ব্যবসায় হাতেখড়ি। আঠাশ বছর বয়সে সাহারা ফিনান্সে যোগ দেন। ধুঁকতে থাকা সেই সংস্থা ছিল আদপে চিট ফান্ড। ক্রমে সংস্থাটিই তিনি কিনে নেন। বদলে দেন সংস্থাটির বিজনেস মডেল। মাথায় ছিল পিয়ারলেস গ্রুপের মতো সংস্থার আদল। সেই আদলেই গড়ে তোলেন ‘সাহারা পরিবার’ (Sahara Parivar)। সেই শুরু। পরবর্তী অল্প সময়ের মধ্যে স্বপ্নের উত্থান। এক বঙ্গতনয়ের এমন সাফল্য যেন রূপকথা।
[আরও পড়ুন: মিলেছে কত অনুদান? বুধবারের মধ্যে জানাবে সব রাজনৈতিক দল, নির্দেশ কমিশনের]
কিংবদন্তি সাহিত্যিক শংকরের ‘সাহারার ইতিকথা’ বইয়ে রয়েছে সুব্রত রায়ের (Subrata Roy) সঙ্গে তাঁর দীর্ঘ আলাপচারিতার কথা। সেখানে তিনি বলেছিলেন, ”আমার ইমোশন আছে, কিন্তু আমি আগাম প্ল্যানিং-এও প্রচণ্ড বিশ্বাসী। এখন থেকে চার বছর পরে, সাত বছর পরে, এমনকী বারো বছর পরে সাহারায় কী হতে চলেছে তা আমি মানসচক্ষে দেখতে চাই।” এই দর্শনই তাঁকে চালিত করেছে। শাখাপ্রশাখায় বাড়তে থাকে ব্যবসা। অ্যাম্বি ভ্যালি সিটি, সাহারা মুভি স্টুডিওজ, এয়ার সাহারা… সাফল্যের মুকুটে জুড়েছে একের পর এক পালক। ১৯৯২ সালে হিন্দি ভাষার সংবাদপত্র ‘রাষ্ট্রীয় সাহারা’ দিয়ে মিডিয়া ব্যবসায় প্রবেশ। এর পর ‘সাহারা টিভি’র আত্মপ্রকাশ। সময়টা ২০০০ সাল। ২০০৩ সালে নাম বদলে হয় ‘সাহারা ওয়ান’। ক্রমে দেশের গণ্ডি পেরিয়ে সুব্রত পা রাখেন বিদেশেও। সেখানেও ‘সাম্রাজ্য’ স্থাপন। এমন ব্যবসায়িক সাফল্য তাঁকে দেড়-দু দশকের মধ্যে এক অবিশ্বাস্য উচ্চতায় পৌঁছে দিয়েছিল। ২০০৪ সালে টাইম ম্যাগাজিন জানায়, কর্মসংস্থানের নিরিখে ভারতীয় রেলওয়ের পরই সাহারা গোষ্ঠীর স্থান।
কিন্তু প্রায় সেই সময় থেকেই বিতর্ক ঘনাতে থাকে সুব্রতকে ঘিরে। আইনি জটিলতায় জড়িয়ে পড়েন তিনি। চিটফান্ড সংস্থা তৈরি করে বিপুল টাকা তছরুপের অভিযোগ ওঠে। SEBI-র সঙ্গে দীর্ঘ আইনি লড়াই চলতে থাকে। ২০১৪ সালের মার্চে তিহাড় জেলে ঠাঁই হয় তাঁর। দুবছর পরে ২০১৬ সালে প্যারোলে মুক্তি পান। তার পর থেকে জেলের বাইরে থাকলেও ক্রমেই যেন খ্যাতির দ্যুতি থেকে দূরে সরে গিয়েছিলেন সুব্রত। দীর্ঘদিন ধরেই ভুগছিলেন বহু অসুখে। একদিকে ক্যানসার, অন্যদিকে মধুমেহ, উচ্চ রক্তচাপ, শ্বাসকষ্টের মতো নানা রোগে শরীর জীর্ণ হয়ে গিয়েছিল। মঙ্গলবার রাতে তাঁর মৃত্যুর খবরে ফের নতুন করে আলোচনা সুব্রতকে ঘিরে। স্বপ্নের উত্থান থেকে বিতর্কের বেড়াজালে আটকে পড়া এক ট্র্যাজিক নায়ক কিন্তু বিস্মৃত হবেন না।
[আরও পড়ুন: রাহুল ‘মূর্খের সর্দার’! ভোটপ্রচারে কংগ্রেস নেতাকে তীব্র কটাক্ষ মোদির]
তাঁর বিরুদ্ধে ওঠা সমস্ত অভিযোগ অস্বীকার করে গিয়েছেন আজীবন। অভিযোগ ছিল, সোনিয়া গান্ধীর ভারতের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হলে তিনি তার প্রতিবাদ করেছিলেন। আর সেই কারণেই নাকি তাঁকে ফাঁসানো হয়েছিল। এই সব অভিযোগ, ব্যর্থতা, কেলেঙ্কারি এবার চলে গেল ইতিহাসের গর্ভে। থেকে গেল সুব্রত রায় নামের এক আশ্চর্য মানুষের স্মৃতি। সামান্য ব্যবসায়ী থেকে যিনি দেশের প্রভাবশালীদের অন্যতম হয়ে উঠেছিলেন। বিতর্ক যাই থাক, তাঁর উত্থানের কাহিনিও একই ভাবে থেকে যাবে।
