নানা প্রতিকূলতা অতিক্রম করে এগিয়ে চলেছেন সঙ্গীতশিল্পী সায়নী পালিত। বাংলা-হিন্দি দুই ভাষার গানে তিনি স্বচ্ছন্দ। দৃষ্টিহীনতা তাঁর চলার পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি। আন্তর্জাতিক নারী দিবসে এই নারীর সঙ্গে কথা বললেন শম্পালী মৌলিক। শুনলেন তাঁর কাহিনি।
প্রায় বারো বছর কাটিয়ে ফেলেছেন ইন্ডাস্ট্রিতে। নিজের যোগ্যতা অনুযায়ী সুযোগ বা ওয়ার্ম ওয়েলকাম পেয়েছেন?
যোগ্যতার বিচার ওরকম ভাবে করা যায় না। একজন শিল্পীর কাছে সবচেয়ে ভালো বিষয় হল ভালো গান পাওয়া। সেটা আমাদের হাতে সবসময় থাকে না। একটা গান গাইলাম কিন্তু সেই স্পেসিফিক ছবিটা হয়তো মানুষের কাছে পৌঁছল না। কাজ পাইনি সেটা বলতে পারি না। সুযোগ পেয়েছি বলেই বারোটা বছর কাটিয়ে দিলাম। আশা করছি আগামি দিনেও ভালো ভালো গান পাব। যেমন পেয়েছি আগে।
নতুন কোনও ইন্টারেস্টিং কাজের কথা বলা যায়?
বলিউডের অভিনেত্রী হিনা খানের ছবিতে গান গেয়েছি। এই বছরই ছবিটা রিলিজ করার কথা।
সিনেমায় প্রথম প্লেব্যাক তো ২০১২-১৩ সালে?
হ্যাঁ, রাজ চক্রবর্তীর ‘প্রলয়’ ছবিতে ‘রোশনি এল’ গানটা গেয়েছিলাম। যে গানে অরিজিৎ সিং, অন্বেষাও ছিলেন। সেই সময়ই ‘হনুমান ডট কম’ ছবিতে ‘তোরে নয়না যাদু ভরে’র সঙ্গে ‘মম চিত্তে’র ফিউশন গেয়েছিলাম। ‘প্রলয়’ আগে রিলিজ করেছিল আর ‘হনুমান ডট কম’-এর গানটা প্রথমে রেকর্ড করেছিলাম। পরবর্তীকালে পাভেলের ছবি ‘অসুর’-এও মহম্মদ ইরফানের সঙ্গে ‘তোর হয়ে যেতে চাই’ গানটা গেয়েছিলাম। এছাড়া ‘মুখোমুখি’ ‘ পেণ্ডুলাম’ ছবিতেও গেয়েছি। হিন্দিতে আমার শুরু শঙ্কর. এহসান- লয়-এর ‘ওভে জানিয়া’ গান দিয়ে ‘কাট্টি বাট্টি’ ছবিতে। এছাড়া শঙ্করজির সঙ্গে অ্যাড ফিল্মে ডুয়েটের কাজও করেছি। Zee5-এ এসেছিল ‘সিজনস গ্রিটিংস’ বলে একটা ছবি, রামকমল মুখোপাধ্যায়ের পরিচালনায়, অভিনয়ে সেলিনা জেটলি। সেখানেও আমার গান ছিল। তারপর ‘গ্যাংস্টার’-এ নিজের সুর করা গানও গেয়েছি, এটা OTT-তে।
বাংলায় কার সঙ্গে কাজের অপেক্ষা রয়েছে?
অনুপমদাকে ভীষণ পছন্দ করি। এখনও ওর সুরে গাওয়া হয়নি। কবে গান দেবে সেই অপেক্ষায় আছি। জিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে আমার খুব ভালো সম্পর্ক। কালার্সে একটা রিয়ালিটি শোয়ে উনি আমাদের জাজ ছিলেন। তার পর থেকে আমার গান শোনেন। একটা সময়ে আমি ‘বিগ গোল্ডেন ভয়েস’-এর উইনার হয়েছিলাম, সেটা ২০১৪ সাল। দেবজ্যোতি মিশ্র, ইন্দ্রজিৎ দাশগুপ্ত-সহ প্রায় সবার সঙ্গেই কাজ করেছি। সুরকার রণজয় ভট্টাচার্যও চমৎকার কাজ করছেন। ওর সঙ্গেও কাজ হবে আশা করি। এবার দেখা যাক। আসলে সবটা তো আমাদের হাতে থাকে না।
[আরও পড়ুন: উদয়পুরে বিয়েতে গিয়ে অঘটন! অসুস্থ ধর্মেন্দ্র, বাবা কেমন আছেন? জানালেন ববি দেওল]
সঙ্গীত শিক্ষার শুরুটা কীভাবে?
আমার প্রথম সোলো পাবলিক পারফরম্যান্স এগারো বছর বয়সে। অনেকদিন ধরে গান করছি। কলেজ ফেস্টে গেয়েছি, ব্যান্ডও করি। সাম্প্রতিক অতীতে গানের সূত্রে দু’বার ইউকে ট্যুর করেছি। গত বছর পুজোয় USA ট্যুর করেছি। এবারও পুজোয় বিদেশ যাওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে। আর গুরুদের প্রসঙ্গে বলি, চন্দনা চক্রবর্তী ও পণ্ডিত অজয় চক্রবর্তীর কাছে সাড়ে চার বছর বয়স থেকে গান শিখেছি। একসময় ITC সঙ্গীত রিসার্চ অ্যাকাডেমির স্কলার ছিলাম। সেখানে গিরিজাদেবীর কাছে শেখার সুযোগ পাই। প্রায় কুড়ি বছর ক্ল্যাসিকাল মিউজিক শিখছি। তবে আমি সব ধরনের গান গাইতে ভালোবাসি। প্রথমদিকে লুকিয়ে কমার্শিয়াল গান গাইতাম। ২০১২ থেকে পুরোপুরি কমার্শিয়াল মিউজিকে আসি। যদিও ‘ঠুংরি’ আমার স্পেশালাইজেশন। একটা সময় এক-দেড় ঘণ্টার ক্ল্যাসিক্যাল কনসার্ট করতাম। এখন মনে হয়, তখন শিখেছি বলেই আজকে ছাত্রছাত্রীদের শেখাতে পারছি। সায়নী মিউজিক গ্রুমিং ক্লাসের মাধ্যমে অনলাইনে শেখাই আমি।
অনেক প্রতিকূলতা রয়েছে আপনার এই দীর্ঘ জার্নিতে। চোখের সমস্যা অতিক্রম করে আপনি এগিয়ে গিয়েছেন।
এগুলো আমি খুব বেশি সামনে আনতে চাই না। জন্ম থেকে আমার রেটিনা কাজ করছে না। আপনি কেমন দেখতে আমি জানি না তবে আলোর উৎস বলে দিতে পারি। ইমেজ ফরমেশনে সমস্যা। রেটিনার ইনার সেল ঠিকমতো কাজ করে না আমার জন্ম থেকে। সারা পৃথিবীতে এটা নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট চলছে। কিন্তু এখনও কিছু আবিষ্কার হয়নি। যেহেতু আমার সমস্যা জন্মের সঙ্গে সঙ্গেই, হঠাৎ হয়েছে এমন নয়, ফলে বিরাট ভেঙে পড়িনি কখনওই।
পড়াশোনা বা গান শেখার ক্ষেত্রে সমস্যা হয়নি?
এটাকে আমি সমস্যা বলে ভাবিনি। আমার মা-বাবার বিরাট ভূমিকা এক্ষেত্রে। তাঁরা চেয়েছেন আর পাঁচজনের মতো আমাকে বড় করতে, স্পেশাল চাইল্ড হিসাবে নয়। আমি নর্মাল স্কুলে পড়েছি। ব্রেইল ইউজ করিনি, ব্লাইন্ড স্কুলেও যাইনি। প্রথমদিকে মা পড়ে শোনাত আমি মনে রাখতাম। পরে রিডার, রাইটার রেখেছি। রাইটার নিয়ে পরীক্ষা দিতাম আর রিডারের সাহায্যে মেমোরাইজ করতাম। পাঠভবন মন্টেসরি, আদর্শ শিক্ষায়াতন স্কুলে পড়েছি। পরে ক্যালকাটা ইউনিভার্সিটিতে পড়াশোনা। এখন পিএইচডি করছি।
আর কী কী ইচ্ছা?
অবশ্যই আরও প্লেব্যাক করতে চাই। আর ইন্ডিপেনডেন্ট মিউজিক করতে চাই। ‘সায়নী’স মিউজিকোলাব’ নামে ইন্ডিপেনডেন্ট সিরিজ করছি আমি ২০২০ থেকে। সেখানে বিভিন্ন শিল্পীরা কোলাবরেট করেছেন। আমি মিউজিক প্রোডিউসও করছি। আসলে ইন্ডিপেনডেন্ট মিউজিকের বেঁচে থাকা খুব জরুরি (হাসি)।