বিশ্বদীপ দে: ‘এই যন্ত্রের সাহায্যে অতীতে ও ভবিষ্যতে সফর করা সম্ভব।… টাইম মেশিনের সাহায্যে একজন মানুষ পাঁচ হাজার বছর আগের মিশরে গিয়ে নিজের চোখে পিরামিড তৈরির ব্যাপারটা দেখে আসতে পারে। পাঁচ হাজার কেন, পঁচাত্তর লক্ষ বছর আগে গিয়ে দেখে আসতে পারে ডাইনোসর কেমন জীব ছিল।’ যাঁরা সত্যজিৎ রায়ের ভক্ত, প্রফেসর শঙ্কুর অনুগামী তাঁদের বলে দিতে হবে না এটা কোন লেখার অংশ। হ্যাঁ, ‘প্রফেসর রন্ডির টাইম মেশিন’। এইচ জি ওয়েলসের ‘দ্য টাইম মেশিন’ প্রকাশিত হয়েছিল ১৮৯৫ সালে। সেই থেকে সময়যাত্রার কাহিনি পড়ে আসছেন পাঠকরা। এই বাংলাতেও সত্যজিতের পাশাপাশি অনেকেই লিখেছেন সময় ভ্রমণের কথা। এমনকী, সারা পৃথিবীতে তৈরি হওয়া অসংখ্য ছবির মধ্যে সাম্প্রতিক একটি বাংলা ছবিকেও রাখতে হবে। ২০১৫ সালে তৈরি হওয়া ‘অ্যাবি সেন’ বাণিজ্যসফল না হলেও আটের দশকের কলকাতায় সময় ভ্রমণকে দারুণভাবে ফুটিয়েছিল। কিন্তু এতদিনেও মেলেনি যে প্রশ্নের উত্তর, তা হল এখন না হয় সম্ভব হচ্ছে না। কিন্তু আদৌ কি সম্ভব টাইম ট্র্যাভেল (Time Travel)? নাকি এটা নিছকই কল্পনাপ্রবণ মানুষদের মনের চিত্রবিচিত্র আলপনা?
এই নিয়ে কথা বলতে গেলে প্রথমেই মনে পড়ে স্যার অ্যালবার্ট আইনস্টাইনের (Albert Einstein) কথা। তিনি বলেছিলেন, ”আমাদের মতো মানুষরা, যারা পদার্থবিদ্যায় বিশ্বাস করি, তারা জানি অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ কেবলই এক একগুঁয়ে অবিরাম ভ্রম ছাড়া কিছু নয়।” এই কথা থেকে পরিষ্কার একেবারে গোড়া ধরে টান মারার মতোই একেবারে সময়ের অস্তিত্ব নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন তিনি। তাঁর বিখ্যাত আপেক্ষিকতাবাদও তো এই ভাবনারই অনুরণন। সেখানে সময়, স্থান, ভর ও অভিকর্ষের কথা এসেছে। যা বুঝিয়ে দিয়েছিল সময়ের বয়ে যাওয়া মোটেই ধ্রুবক নয়। সময়ের গতি বাড়তে বা কমতে পারে। এর আগে এমন কথা কেউ ভাবতেই পারেনি। এপ্রসঙ্গে গত নভেম্বরে ব্রিটেনের এক জ্যোতির্পদার্থবিদ এমা অসবর্ন বলেছেন, ”এখান থেকেই (আইনস্টাইনের থিয়োরি) সময় ভ্রমণের প্রসঙ্গ আসতে পারে। বিজ্ঞানসম্মত ভাবে এটা সঠিক। এবং বাস্তব পৃথিবীতেও তা প্রতিফলিত হয়।”
[আরও পড়ুন: কলকাতায় ভাগবত, দুর্গাপুরে দত্তাত্রেয়, হিন্দুত্বের হাওয়া তুলতে লোকসভার আগে তৎপর RSS?]
ব্যাপারটা কী? অর্থাৎ যদি আপনার গতি দ্রুত হয় তাহলে সময় ধীরে বইবে! একেবারে নদীর স্রোতের গতির মতোই তা বাড়তেও পারে, কমতেও পারে। আর এখান থেকেই জন্ম নেয় এক প্যারাডক্স। যমজ প্যারাডক্স। কীরকম সেই ধাঁধা? ধরা যাক, দুই যমজ ভাইয়ের একজনকে আলোর গতিতে (বা তার কাছাকাছি গতিতে) মহাকাশে পাঠানো হল। অন্য ভাই রয়ে গেল পৃথিবীতেই। এক্ষেত্রে কিন্তু অন্তরীক্ষে যে গেল তার বয়স পৃথিবীতে থাকা ভাইয়ের থেকে ধীরে বাড়বে। অর্থাৎ মহাকাশ থেকে পৃথিবীতে ফিরে এলে দেখা যাবে সে তার যমজ ভাইয়ের থেকে ‘তরুণ’ হয়ে গিয়েছে! স্রেফ ‘থিয়োরি’ নয়, একেবারে হাতে গরম পরীক্ষাও হয়েছে এই নিয়ে। স্কট কেলি ও মার্ক কেলি নামে দুই যমজ ভাইয়ের একজনকে মহাকাশে পাঠিয়ে এটা জরিপ করা হয়েছিল। আলোর গতি বা অন্তত তার কাছাকাছি গতিও যেহেতু এখনও মানুষের আয়ত্তে আসেনি, তাই পরীক্ষাটা পুরোপুরি করা যায়নি।
তারও আগে ১৯৭১ সালে এমন এক পরীক্ষা করা হয়েছিল। এখানে ব্যবহৃত হয়েছিল দুটি পারমাণবিক ঘড়ি। আসলে সময়কে একেবারে নিক্তি মেপে অর্থাৎ সূক্ষ্মভাবে মাপতে এমন ঘড়িই লাগে। দুটি ঘড়ির একটিকে বিমানে রাখা হয়। অন্যটা রাখা হয় মাটিতে। দেখা যায়, আকাশপথে থাকা ঘড়ির সময় অন্য ঘড়িটির থেকে পিছিয়ে পড়েছে! এটা ‘হেফিল কিটিং এক্সপেরিমেন্ট’ নামে পরিচিত। সত্যিই কি ঘড়িটা ‘স্লো’ হয়ে গিয়েছিল? তা নয়। আসলে মাটিতে দাঁড়িয়ে দেখলে সেই সাপেক্ষে তাকে ধীর বলে মনে হচ্ছে। এই পরীক্ষা বুঝিয়ে দেয়, আইস্টাইনের বক্তব্যের যাথার্থ- সময় মোটেই ধ্রুবক নয়, তা আপেক্ষিক। এই থিয়োরি অনুসারে ব্ল্যাক হোলের মধ্যে যাওয়া সম্ভব হলে দেখা যাবে সেখানে সময় ধীরে বইছে। এই নিয়ে এক মজার মন্তব্য করেছেন অসবর্ন। তাঁর কথায়, ”আপনার মাথা পায়ের চেয়ে আগে বুড়ো হচ্ছে। কেননা আপনার পায়ের পাতার অভিকর্ষ বল বেশি।”
[আরও পড়ুন: যেন রক্তমাংসের ‘মুকুল ধর’, পুনর্জন্ম নিয়ে নিজের খুনিদের ধরিয়ে দিয়েছিল ছোট্ট বালক!]
তবে এসবই আসলে তত্ত্বকথা। আমাদের দৈনন্দিন জীবনে এই ধরনের সূক্ষ্ম পরিমাপ একেবারেই অসম্ভব ব্যাপার। সে না হয় মেনে নেওয়া গেল, কিন্তু সময় ভ্রমণ ব্যাপারটা কি তাহলে সম্ভব? বিচার করে দেখলে বোঝা যায়, ভবিষ্যতে সত্যিই সফর করা সম্ভব। আর সেজন্য কোনও টাইম মেশিনও লাগবে না। কেবল আলোর গতি বা তার কাছাকাছি গতিতে ছুটতে পারলেই হল। অথবা খুব তীব্র মহাকর্ষীয় ক্ষেত্রে সময় কাটাতে হবে। যা এখনও মানুষের নাগালে আসেনি। তবে একবার চলে এলে সম্ভব। এক্ষেত্রে একজনের কথা বলা যায়। গেনেডি পেডালকা। রুশ নভোচর। তিনি সবচেয় দীর্ঘ সময় মহাকাশে কাটিয়েছেন। ৮৭৯ দিন। আর এই সময়ে ২৮ হাজার প্রতি ঘণ্টার গতিবেগে উড়ে বেড়িয়েছেন তিনি। আর এর ফলে তিনি ভবিষ্য ভ্রমণও করেছেন। তবে তা মাত্র ০.০২ সেকেন্ডের। অর্থাৎ পৃথিবীতে থাকা মানুষদের থেকে তিনি ০.০২ সেকেন্ড তরুণ!
সময় ভ্রমণের ক্ষেত্রে আরও একটা থিয়োরি রয়েছে। আর তাও আপেক্ষিকতাবাদের সঙ্গেই সম্পৃক্ত। এই ছোট লেখায় বিস্তারিত বলার সুযোগ নেই। সহজে বললে এটা ওয়ার্মহোল থিয়োরি। যা সম্ভব করতে গেলে স্পেসটাইমকে বোঝা দরকার। যাঁরা ‘ইন্টারস্টেলার’ ছবিটি দেখেছেন তাঁরা আরও সহজে বুঝতে পারবেন বিষয়টা। ধরা যাক, একটা কাগজের দুই প্রান্তে দুটি বিন্দু আঁকা হল। এবার সেই বিন্দু দুটিতে পৌঁছতে হলে সরলরেখা ধরে গেলেই হবে। কিন্তু কোনও ভাবে যদি কাগজটি ভাঁজ করা যায়, তাহলেই কিন্তু বিন্দুগুলি কাছাকাছি চলে আসবে। তখন হাতের কলমটা দিয়ে সেই দুই বিন্দুকে ফুঁড়ে দিতে পারলেই কেল্লাফতে। সময় ও স্থানের ধারণাকে কাজে লাগিয়ে মহাবিশ্বের ওয়ার্মহোল দিয়ে অন্য সময়বৃত্তে পৌঁছনো সম্ভব। তত্ত্বগতভাবে এটা সম্ভব হলেও, এখনও হাতে কলমে করে দেখা যায়নি। আর বাস্তবে ওয়ার্মহোল আদৌ আছে কিনা তাও বিজ্ঞানীরা হলফ করে বলতে পারছেন না। কেননা প্রমাণ মেলেনি। সুতরাং এটা সিনেমা বা সাহিত্যে আকছাড় ঘটালেও বাস্তবে এর থেকে আমরা এখনও বহু দূরে।
যাই হোক, তাহলে দেখা যাচ্ছে ভবিষ্য়তে যাওয়ার তাও একটা ‘বাস্তবসম্মত’ উপায় রয়েছে । অন্তত তেমনই মনে করা যাচ্ছে। কিন্তু অতীতে যাওয়াটা আরও ঝকমারি। এবং তা আদৌ সম্ভব কিনা তা নিয়ে গাঢ় সংশয় রয়েছে। কানাডার পদার্থবিদ বারাক শশানি বলছেন, ”সম্ভব হতে পারে। আবার না হতে পারে। এখনও পর্যন্ত আমাদের কাছে এবিষয়ে পর্যাপ্ত জ্ঞান তথা থিয়োরিই নেই।” অর্থাৎ এখনও অপেক্ষা করা ছাড়া উপায় নেই। আর এপ্রসঙ্গে মনে পড়ে যায় আরেক বিশ্ববিশ্রুত বিজ্ঞানীর কথা। তিনি স্টিফেন হকিং। তিনি প্রশ্ন তুলেছিলেন, ”যদি সত্যিই সময় ভ্রমণ করা যেত, তাহলে ভবিষ্যৎ থেকে কাউকে আমরা এই সময়ে আসতে দেখলাম না কেন?” তাঁর মতো মানুষের এমন প্রশ্ন আমাদের কল্পনাকে কেমন যেন চুপসে দেয়। তাহলে কি সবটাই নিছক কল্পনা? এমনটা ভাবতে মন চায় না। একদিন মানুষ সময়ের বাধাকে ভেঙে গুঁড়িয়ে দেবে, একথা ভাবতেই বুঝি ভালো লাগে। আসলে আপাতত সবটাই ভবিষ্যতের গর্ভে। তাই পছন্দের সিনেমা, সিরিজ কিংবা গল্প-উপন্য়াসের কাহিনিকে বিশ্বাস করে রোমাঞ্চে ভেসে যেতে মানা নেই।