কিংশুক বন্দ্যোপাধ্যায়: সবার নজরে এখন প্রস্তাবিত ভারতীয় ডিজিটাল আইন (Draft Digital Law), যার খসড়া শীঘ্রই সংসদে পেশ হতে চলেছে। নতুন বছর বিশ্বব্যাপী তথ্যপ্রযুক্তি শিল্পের জন্য খুব যে আশার খবর এনেছে, তা নয়। বরং ‘গুগল’-এর মতো অতিকায় বহুজাতিক তথ্যপ্রযুক্তি (IT) সংস্থায় কর্মী সংকোচন শঙ্কার কালো মেঘ আরও বাড়িয়েই চলেছে। ইউরোপ যখন বিধ্বংসী যুদ্ধের আগুনে জ্বলছে তখন পূর্ব-এশিয়ার তাইওয়ান প্রণালীতেও রণদামামা বাজতে শুরু করেছে। আর এর সরাসরি প্রভাব এসে পড়েছে দুনিয়ার সেমিকন্ডাক্টর বাজারে।
বিশ্বব্যাপী আর্থিক মন্দার এই অশনি সংকেতে নতুন বছরে দিল্লির প্রস্তাবিত ডিজিটাল আইন অন্য গুরুত্ব পেতে চলেছে। শুধু তথ্যপ্রযুক্তি শিল্পেরই নয়, আমজনতারও যথেষ্ট কৌতূহল রয়েছে এই প্রস্তাবিত আইনকে ঘিরে। কারণ এই প্রথম সোশ্যাল মিডিয়া (Social Media) নিয়ে ওঠা হাজারও প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টাও করা হয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। তথ্যপ্রযুক্তি শিল্পের আগ্রহের মূল কারণ বর্তমানে দেশে যে তথ্যপ্রযুক্তি আইন চালু রয়েছে, তা নয়-নয় করে ২২ বছরের পুরনো। যখন এই আইন রচনা হয়েছিল, তখন না ছিল সোশ্যাল মিডিয়ার এই রমরমা, না ছিল অ্যাপের এই ভুবনজোড়া দিগ্বিজয় যাত্রা। ফলে শিল্পের বাতাবরণ, সমস্যা সবকিছুই ছিল ভিন্ন।
কেন নয়া আইন?
কবি বলেছেন, সময়ের প্রয়োজনে জীর্ণ বস্ত্র ত্যাগ করে নতুন বস্ত্র পরিধান করতে হয়। শতাব্দীর প্রারম্ভের আইনের জায়গায় এই নতুন প্রস্তাবিত আইন সেই সময়েরই ডাক। ২০০০ সালে তৎকালীন অটলবিহারী বাজপেয়ী সরকার উন্মুক্ত অর্থনীতির সুবিধা, যাতে দেশের নবজাতক তথ্যপ্রযুক্তি শিল্প যথাযথভাবে নিতে পারে, তার জন্য আইন প্রণয়ণ করলেন। দেশের সামগ্রিক অভ্যন্তরীণ পণ্য ও পরিষেবার (পরিভাষায় যাকে ‘গ্রস ডোমেস্টিক প্রোডাক্ট’ বা ‘জিডিপি’ বলে) মাত্র ১.২ শতাংশ আয় তখন এই ক্ষেত্র থেকে আসে। ২০২২-এ এসে সেটা ৭.৪ শতাংশ হয়েছে। ২০২১ সালে যেখানে দেশের তথ্যপ্রযুক্তি ক্ষেত্রে আয় ছিল ১৯৬০০ কোটি ডলার, পরের বছরই তা বেড়ে ২৩৩০০ কোটি ডলারে দাঁড়িয়েছে। কর্মীসংখ্যা দিয়েও তফাতটা মালুম হয়। পরিসংখ্যান বলছে, দেশে তথ্যপ্রযুক্তি ক্ষেত্রে ২০০৯ সালে যেখানে প্রায় ১২ লক্ষ কর্মী কর্মরত ছিলেন, ২০২২-এর শেষে তা চারগুণ বেড়ে সাড়ে ৪৮ লক্ষে দাঁড়িয়েছে। এই শেষ নয়। সব ঠিকঠাক চললে ২০৩০ নাগাদ এই শিল্পের ব্যবসা ১ লক্ষ কোটি ডলারই শুধু ছোঁবে না, আরও লাখ পাঁচেক মানুষের কর্মসংস্থান হবে।
[আরও পড়ুন: ত্রিপুরা বিধানসভা ভোট: বিজেপিতে ফিরলেন সুবল ভৌমিক, টিকিট না পেয়ে দলবদল CPM বিধায়কের]
এখানেই শেষ নয়। দেশের তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থাগুলোর সংগঠন ‘ন্যাসকম’ যে ভবিষ্যতের চিত্রটা সামনে এনেছে, তাতেও স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে, বিপুল ব্যবসার জন্য চলতি আইনের জায়গায় নতুন প্রয়োজনীয় আইনকানুন প্রয়োজন। যেমন ন্যাসকম জানাচ্ছে, অ্যাপের মাপকাঠিতে ভারত এখনই বিশ্বে চতুর্থ স্থানে। ২০১৭ সালে জিডিপি-র ৫ শতাংশ হত অনলাইনে লেনদেন। ২০২৭ সাল নাগাদ সেটাই হয়ে দাঁড়াবে ২০ শতাংশ। একই সঙ্গে লাফিয়ে বাড়বে মোবাইলে লেনদেন। ২০১৬ সালে মোবাইলের অ্যাপের মাধ্যমে যেখানে ২০০ কোটি টাকার লেনদেন হয়, ২০১৯ সালে তা অবিশ্বাস্যভাবে ৯১৭ গুণ বেড়ে ১ লক্ষ ৮৩ হাজার কোটি টাকা ছুঁয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই তথ্যপ্রযুক্তির হাত ধরে অনলাইনে কেনাবেচাও গগনচুম্বী। পরিসংখ্যান বলছে, ২০১৪ সালে যেখানে ১৪০০ কোটি ডলারের ই-কমার্স হয় দেশে, ২০২২ সালে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭৫০০ কোটি ডলারে। ২০৩০ সালে তা ৩৫ হাজার কোটি ডলার ছোঁবে মনে করা হচ্ছে।
দেশের ডিজিটাল দুনিয়ার ভোলও গত ২২ বছরে পাল্টে গিয়েছে। টেলিকম যোগাযোগ ক্ষেত্রের নিয়ন্ত্রক সংস্থা ‘টেলিকম রেগুলেটরি অথরিটি অফ ইন্ডিয়া’ বা ট্রাই-এর পরিসংখ্যান বলছে, ২০২২ সালের অক্টোবর মাসের শেষে দেশে ১১৭ কোটি মোবাইল গ্রাহকের মধ্যে ৭৯ কোটি নেটদুনিয়ায় ঘোরাফেরা করে।
সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারকারীর সংখ্যা তো কপালে চোখ তুলে দেওয়ার মতো! পরিসংখ্যান বলছে, ২০২২ সালে বিশ্বের ৪৭০ কোটি ফেসবুক (Facebook), ইনস্টাগ্রাম (Instagram), টুইটার (Twitter), স্ন্যাপচ্যাট ও হোয়াটসঅ্যাপের ব্যবহারকারীর মধ্যে ৪৬ কোটি ভারতীয়। দেশে ২০২২ সালেই সোশ্যাল মিডিয়ার দুনিয়ায় প্রায় কোটিদুয়েক নতুন ব্যবহারকারী যোগ হয়েছে। বলা হচ্ছে, ২০৪০ সালের মধ্যে দেশে সোশ্যাল মিডিয়া দুনিয়ায় ১৫৩ কোটি ব্যবহারকারী থাকতে পারে। মোদ্দা কথা, ২০০০ সালের তথ্যপ্রযুক্তি আইন নিয়ে আর সমসাময়িক কালের সঙ্গে তাল মেলানো সম্ভব নয়। কারণ সোশ্যাল মিডিয়ায় ব্যক্তিগত তথ্যের সুরক্ষা, আর্থিক লেনদেন, সংবাদমাধ্যমের খবর ও তথ্য সোশ্যাল মিডিয়াতে শেয়ার করার মতো বিষয়গুলো এখন সামনে এসেছে। তাই ২০০০ সালের আইনটারই খোলনলচে পাল্টানো দরকার হয়ে পড়েছে। ভারতীয় ডিজিটাল আইন ঠিক এই কাজটাই করবে বলে মনে করা হচ্ছে।
সংবাদ থেকে আয়ের ভাগ ও কিছু প্রশ্ন
নয়া আইনে মূল নজর থাকবে, সোশ্যাল মিডিয়া সংবাদমাধ্যম থেকে নিয়ে যে-সংবাদ ও তথ্য পরিবেশন করছে, তার বিজ্ঞাপন থেকে প্রাপ্য আয় কীভাবে সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে ভাগ করে নেবে।
এখানেই হাজারও প্রশ্ন। যেমন যদি কোনও বহুজাতিক সোশ্যাল মিডিয়া সংস্থা বড় কোনও সংবাদ সংস্থার সঙ্গে সংবাদ নেওয়ার ব্যাপারে একতরফা দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি করে (যেটা অস্ট্রেলিয়াতে হয়েছে রুপার্ট মার্ডক পরিচালিত সংবাদগোষ্ঠীর সঙ্গে ‘গুগ্ল’-এর), তাহলে ছোট ও মাঝারি সংবাদমাধ্যমগুলো যায় কোথায়? সেই তো তথ্য ও সংবাদ বিক্রির অর্থ বৃহৎ শিল্পের হাতেই চলে গেল! অথচ ‘সোশ্যাল মিডিয়া’ হল সারা বিশ্বের কোটি-কোটি মানুষের কথা বলার জায়গা। আর সেখানে মাঝারি ও ছোট সংবাদমাধ্যম বহু গুরুত্বপূর্ণ খবর পরিবেশন করেও থাকে।
[আরও পড়ুন: সিঙ্গাপুরের বুকের মাঝে আজও নেতাজি, স্মারক স্তম্ভ সাক্ষ্য দিচ্ছে ইতিহাসের]
সোশ্যাল মিডিয়া যদি একতরফা বৃহৎ সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে চুক্তি করে, তাহলে এদের খবরের লিঙ্ক আর পাওয়া যাবে কি না, তা নিয়েই সংশয় দেখা দেবে! বহু সময় দেখা যায়, স্থানীয় পর্যায়ের খবর যে গুরুত্বের সঙ্গে মাঝারি ও ছোট সংবাদমাধ্যম পরিবেশন করে থাকে, তা বৃহৎ সংবাদমাধ্যম নানা কারণে হয়তো করে না। যেমন, কলকাতায় গড়িয়াহাটের যানজটের যে-খবর দক্ষিণ কলকাতার মানুষের কাছে গুরুত্বপূর্ণ, সেটা হয়তো বড় সংবাদমাধ্যমের র্যাডারেই এল না। আবার অনেক সময় কোনও বিষয়কে সামগ্রিকভাবে বিশ্লেষণ একমাত্র বৃহৎ সংবাদমাধ্যমই করতে পারে। তা-ই সব ধরনের তথ্য ও সংবাদের মিশেল সোশ্যাল মিডিয়ায় থাকা জরুরিও।
প্রশ্ন আরও রয়েছে। বড়, মাঝারি ও ছোট সংবাদমাধ্যম সমহারে চুক্তি করতে পারবে তো সোশ্যাল মিডিয়া সংস্থার সঙ্গে? কে দেখবে এসব বিষয়? কোনও বিবাদ হলে দু’-পক্ষর কথা শুনে ব্যবস্থা নেবে কে? সেক্ষেত্রে কি ট্রাইয়ের মতো কোনও নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষ থাকবে সোশ্যাল মিডিয়া সংস্থাগুলোর মাথার উপর। মোদ্দা কথা, ভারতে ব্যবসা করতে গেলে নিয়ন্ত্রক সংস্থার অধীনে দেশের নিয়মকানুন মেনে চলতে হবে কি না।
প্রশ্ন আরও: সংবাদ সংস্থার বদলে যদি কোনও ব্যক্তির কাছ থেকে সংবাদ সংগ্রহ করে সোশ্যাল মিডিয়া, তাহলে তার থেকে আয়ের ভাগ-বাঁটোয়ারা কীভাবে হবে? কারণ স্থানীয় অভাব-অভিযোগ নিয়ে সিটিজেন রিপোর্টিং আজকাল বেশ জনপ্রিয় হয়েছে। একই কথা ভ্লগের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। খাওয়াদাওয়া, রান্না, স্বাস্থ্য সচেতনতা, খেলা, বেড়ানো এমনকী, দেশি-বিদেশি সংবাদের বিশ্লেষণ নিয়ে আজকাল শুধু লিখিত নয়, অডিও ও ভিডিও ভ্লগ সোশ্যাল মিডিয়ায় দেওয়া হয় এবং হাজার হাজার ব্যবহারকারী এসব নিয়মিত ‘ফলো’-ও করেন। এসব ক্ষেত্রে সংবাদসংস্থা আর ব্যক্তিকে কি একই মানদণ্ডে মাপা হবে? যদি তা না হয়, তাহলে ব্যক্তিবিশেষকে কোন মানদণ্ডে আয়ের ভাগ দেওয়া হবে? এই মানদণ্ডই বা কে ঠিক করবে?
ব্যক্তির ক্ষেত্রে কপিরাইটের প্রশ্নটিও উঠে আসছে। ধরা যাক, কারওর তোলা ছবি ফেসবুক ব্যবহার করল। তাহলে কপিরাইট-বাবদ সেই আলোকচিত্রীকে কি রয়ালটি দেওয়া হবে? একই কথা কারও লিখিত পোস্টের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। এই দেওয়ার মানদণ্ডই বা কী হবে আর কে-ই বা তা নির্ধারণ করবে।
[আরও পড়ুন: রাতের শহরে হুডখোলা গাড়িতে চুম্বনে মত্ত যুগল! ভাইরাল ভিডিও ঘিরে শোরগোল]
অস্ট্রেলিয়ার (Australia) প্রাক্তন যোগাযোগমন্ত্রী পল ফ্লেচারের (যাঁর ২০২০ থেকে ২০২২ পর্যন্ত মন্ত্রিত্বকালে ‘মিডিয়া বার্গেনিং কোড’ আনা হয় যাতে সোশ্যাল মিডিয়া থেকে কনটেন্ট ডেভলপাররা তাঁদের ন্যায্য রয়ালটি পেতে পারেন) মতে, গুগ্ল-ফেসবুকের উচিত বিজ্ঞাপন থেকে প্রাপ্ত আয় ডিজিটাল কনটেন্ট প্রোভাইডারদের সঙ্গে ভাগ করে নেওয়া। মনে রাখতে হবে, বিজ্ঞাপন আসছে কিন্তু কনটেন্টের জন্যই। ফ্লেচারের কথায়, ‘ভারত, ব্রিটেন, ফ্রান্স, আমেরিকা – সব দেশেই এটা এক জ্বলন্ত সমস্যা। সব দেশের সরকারকেই এর জন্য আইন আনতে হবে। দেখতে হবে যেন এ ব্যাপারে শেষ কথা যেন সরকারই বলে, তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থাগুলো নয়।’ কানাডাও (Canada) এ ব্যপারে নয়া সম্প্রচার আইন আনছে।
তাহলে এদেশে কি সোশ্যাল মিডিয়া নিয়ন্ত্রণকারী কোনও স্বয়ংশাসিত নিরপেক্ষ সংস্থা গড়ার কথা বলবে নয়া আইন? নিন্দুকে অবশ্য এ-পোড়া দেশে কোনও স্বয়ংশাসিত নিরপেক্ষ সংস্থা কাজ করতে পারবে কি না, তা নিয়ে সংশয়ে থাকবেন। তা থাকুন, তবু আমজনতা আশা নিয়েই তাকিয়ে আছে।
(মতামত নিজস্ব)
লেখক-সাংবাদিক
kingshukbanerjee@gmail.com