ষাটের আশপাশে থাকা বয়সটায় অনেকেই কীরকম জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছেন। ভালো লাগছে না কিছুই। আশপাশে লোকজন থাকলেও কথা বলতে ইচ্ছে করে না। বলতে গেলেও কেমন ছন্নছাড়া, ছেঁড়া ছেঁড়া কথাবার্তা। এই যে শব্দ খুঁজে না পাওয়া এটা কি বড় কোনও সমস্যার লক্ষণ? জানালেন আইএলএস হাসপাতালের নিউরোলজিস্ট ডা. নদী চৌধুরি। তাঁর কথা এই প্রতিবেদনে লিপিবদ্ধ করলেন সুমিতা ভাস্কর।
বছর পঁয়ষট্টির চন্দ্রা দেবী একাই থাকেন। কাজের সূত্রে দূরে থাকা ছেলে-মেয়েরা রোজ ফোনে খবর নেয়। সারা দিন ভেবে রাখেন, ফোন এলে কী কী বলবেন। কিন্তু ফোন এলে কিছুতেই মনে করতে পারেন না জরুরি কথাগুলো।
নমিতা সেনের বয়স বছর পঞ্চান্ন। বিবাহবিচ্ছিন্না নমিতার সুগার ধরা পড়েছে বেশ কিছুদিন। ডাক্তার বলেছে সকালে হাঁটতে। কিন্তু তাঁর অফিস যাওয়ার আগে আর হাঁটতে ভালো লাগে না। আলস্যের কারণে সুগারও নিয়ন্ত্রণে আসছে না কিছুতেই। অবসাদ ঘিরে ধরে তাঁকে।
বিপত্নীক দেবেন্দ্রবাবু অবসরজীবনে সারাদিন ঘরেই বন্দি। বিকেলে পাড়ার বন্ধুরা ডাক দেন প্রায় রোজই। কেউ প্রস্তাব দেন হেঁটে আসার। কেউ বলেন বাড়িতে জমিয়ে চা খেতে খেতে আড্ডা দেওয়ার। কিন্তু দেবেনবাবু কোনও কথা খুঁজে পান না আড্ডার আসরে। মনটাও বসে না সেই জন্য।
সত্তর পার করা গোবিন্দবাবু অবশ্য রোজই বাজার-দোকান করেন। কিন্তু স্ত্রীর কারণে বাধ্য হয়েই সন্ধ্যা থেকে সিরিয়াল দেখতে বাধ্য হন। তবে রোজ দেখলেও কোনও গল্পই মনে থাকে না। স্ত্রী পাশে বসে থাকলেও, কথা থাকে না দুজনেরই। টিভিতেই দুনিয়া।
এঁদের জন্যই কি অপেক্ষা করছে বড় কোনও সমস্যা?
২০০৫ সালে অমিতাভ বচ্চন-রানি মুখোপাধ্যায়ের ‘ব্ল্যাক’ ছবিটা হেলেন কেলারের জীবনের অনুপ্রেরণায় তৈরি হলেও সেই ছবির হাত ধরেই একটি অসুখের নাম দেশবাসীর বেশ পরিচিত হয়ে উঠেছিল— অ্যালঝাইমার্স (Alzheimer’s disease)। যে রোগে অমিতাভ বচ্চন মানে দেবরাজ সহায় আক্রান্ত হয়েছিলেন। যাঁর স্মৃতির ব্ল্যাকবোর্ডে লেখা প্রতিটি অক্ষর ডাস্টার দিয়ে কেউ মুছে দিয়েছিল। মানুষ সহজেই পরিচিত স্মৃতি হারিয়ে ফেলা এই অসুখের সঙ্গে – ডিমেনশিয়া। যদিও এই অসুখ মানব সমাজে অতিপরিচিত।
ভুলে যাওয়ার মাস
এই সেপ্টেম্বরেই পালিত হচ্ছে ‘অ্যালঝাইমার্স সচেতনতা মাস’। আমাদের চারপাশে
ছড়িয়ে থাকা বহু মানুষ যে নানা জিনিস ভুলে যাচ্ছেন। তা কিন্তু মোটেই হেলফেলা করার মতো বিষয় নয়। নানা কারণে এই ভুলে যাওয়ার সমস্যা দেখা দিতে পারে। কখনও কোনও শারীরিক অসুস্থতা যেমন, সুগার হোক বা স্ট্রোক বা অন্য কোনও জটিল অসুস্থতার কারণে যেমন মানুষ স্মৃতি হারিয়ে ফেলতে পারেন আবার তেমনই অবসাদ অর্থাৎ যাকে আমরা ডিপ্রেশন বলে চিনি, তার থেকেও হতে পারে ডিমেনশিয়া।
বয়স শুধুই নম্বর
শুধু যে বয়স বাড়লেই স্মৃতি হারিয়ে যেতে পারে এটা ভাবার কারণ নেই। কারণ অনেকের ক্ষেত্রেই অনেক অল্প বয়সে এই রোগ দেখা দেয়। তাই সতর্ক হতে হবে আগে থেকেই। বিশেষত যাঁদের কোমর্বিডিটি রয়েছে, তাঁদের অনেক বেশি সতর্ক থাকা প্রয়োজন। আবার অনেক সময় নানা ধরনের সংক্রমণ থেকেও হতে পারে ডিমেনশিয়া। প্রেশার
কিংবা সুগার থেকে কিছু এমন প্রোটিন মস্তিষ্কের মেমোরি সেন্টারে জমা হতে পারে যার প্রভাব মারাত্মক, যা মানুষের স্মৃতিকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। ফলে নতুন স্মৃতি স্টোর করার ক্ষমতায় যায় হারিয়ে। পরিণতি হতে পারে ডিমেনশিয়া।
কতটা মারাত্মক?
শুধু কথা বলতে ভুলে যাওয়ার মতো বিষয়কে ‘তুচ্ছ’ ভাবলে সমস্যা বাড়বে বই কমবে না। কারণ এই রোগ ধাপে ধাপে এগিয়ে এমন জায়গাতেও নিয়ে যায় মানুষকে, যখন রোজ চলাফেরার রাস্তাও মনে রাখতে পারে না সে। প্রতিদিনের যে স্নান-খাওয়ার মতো বিষয়, সেই কাজটাও ভুলে যেতে পারেন একজন স্মৃতিভ্রষ্ট মানুষ। ঠিক যেমনটা হয়েছিল ‘ব্ল্যাক’ ছবির দেবরাজ সহায়ের। তাই ডিমেনশিয়া কিংবা অ্যালঝাইমার্স আক্রান্ত রোগীকে সারাক্ষণ চোখে চোখে রাখা অত্যন্ত দরকারি। রাস্তায় বেরিয়ে পথ ভুলে চিরকালের মতো হারিয়ে যেতে পারেন মানুষটি। পথেঘাটে ঘুরে বেড়ানো এমন অনেক মানুষকেই তো আমরা ‘পাগল’ ভেবে এড়িয়ে যাই। কিন্তু আসলে মানুষটি হারিয়ে ফেলেছেন তাঁর স্মৃতি।
[আরও পড়ুন: ডেঙ্গুর সঙ্গে অন্য সংক্রমণের জোটই কাল! একটা সামলাতে গিয়ে অন্যটা অবহেলা করবেন না]
বুঝবেন কী করে?
হঠাৎ করেই যদি পুরনো অভ্যাস বদলে যায়। হঠাৎই যদি শান্ত মানুষটা অ্যাগ্রেসিভ হয়ে ওঠেন কিংবা হাসিখুশি মানুষটা গম্ভীর, সেটা কিন্তু চিন্তার কারণ। ব্যবহারে বদলই অ্যালঝাইমার্স কিংবা ডিমেনশিয়ার একটা প্রধান উপসর্গ। ডিপ্রেশনও কিন্তু আরেকটা প্রধান লক্ষণ হতে পারে। কিছুই ভালো লাগছে না— খেতে, ঘুমোতে কিংবা কথা বলতে, এটাই যদি রোজকার কথা হয়ে দাঁড়ায়, তাহলে কিন্তু সতর্ক হবেন।
উত্তরাধিকার
পরিবারের বড়দের থেকে শুধু যে সোনাদানা বাড়ি জমির মতো সম্পত্তি পাবেন এটা ভেবে খুশি থাকবেন না। উত্তরাধিকারে নানা রোগও পাবেন কিন্তু। হার্ট কিংবা লাংয়ের অসুখের মতোই ডিমেনশিয়া আর অ্যালঝাইমার্স কিন্তু জেনেটিকাল। তাই পরিবারে কারও এই অসুখ থাকলে
পরবর্তী প্রজন্মেরও তা হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে। অতএবং সাবধান আগে থেকেই।
যত আগে তত ভালো
এর থেকে বাঁচার সেরা উপায় হল, যত আগে এই রোগটির উপসর্গকে চিহ্নিত করা যাবে সেটাই এর সেরা ওষুধ। কারণ লক্ষণ দেখে যদি দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া যায় তাহলে অনেক আগে থেকেই তাকে আটকে দেওয়া সম্ভব। ফলে যাঁরা কাছের মানুষ, তাঁরা সচেতন থাকবেন শুরু থেকেই আশপাশের বয়স্ক মানুষগুলো চেনা ছন্দের বাইরে পা রাখলেই কথা বলুন ডাক্তারের সঙ্গে। ওষুধ এবং মানসিক কসরত বাড়তে দেবে না রোগ।
করোনা প্রভাব
করোনার আক্রান্ত হওয়ার পর বহু মানুষের স্মৃতি প্রভাবিত হয়েছে। তবে সরাসরি ডিমেনশিয়া বা অ্যালঝাইমার্সের সঙ্গে এর যোগ রয়েছে কি না তা বোঝা যায়নি কারণ করোনা নতুন রোগ। কিন্তু সচেতন থাকতে তো বাধা নেই! করোনা থেকে সেরে ওঠা বয়স্কদের তাই একটু বাড়তি যত্ন নিন। শরীরের পাশাপাশি মনেরও। কথা বলা, নানা কাজে ব্যস্ত রাখার চেষ্টা, খুশি রাখার চেষ্টা করলে লাভ হবে। তবে দুশ্চিন্তার কারণ নেই। অন্য অনেক অসুস্থতার মতোই ডিমেনশিয়া বা অ্যালঝাইমার্সও কিন্তু সতর্ক হলে রুখে দেওয়া সম্ভব। সচেতনতার মাস তো সেই কথাই মনে করিয়ে দিচ্ছে।
।। প্রয়োজনে ফোন করতে পারেন ৪০৮৮ ০০০০ নম্বরে ।।