সোম রায়, শ্রীনগর: তৃণমূল কংগ্রেস নয়, দিল্লি থেকে বিজেপিকে সরানোই মূল লক্ষ্য সিপিআই(এম)-এর। কেন্দ্রে সরকার গড়তে তৃণমূল যদি কংগ্রেসের শরিক হয়, তাতেও সমর্থন দিতে পিছপা নয় বামেরা। দলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরি কলকাতায় যা বলতে পারেননি, কাশ্মীরে নিজের খাসতালুকে দাঁড়িয়ে সংবাদ প্রতিদিন-এর কাছে সেটা স্পষ্ট করলেন সিপিআই(এম) কেন্দ্রীয় কমিটির গুরুত্বপূর্ণ সদস্য ও জম্মু-কাশ্মীরের একমাত্র বাম বিধায়ক মহম্মদ ইউসুফ তারিগামি।
এবারের নির্বাচনে কাশ্মীর তো বটেই, গোটা দেশের কাছে ‘৩৭০’ ও ‘৩৫এ’ ধারা একটা বড় ইস্যু। এই বিষয়ে পার্টির বক্তব্য বা নীতি কী?
এটা নিয়ে বিজেপি নোংরা রাজনীতি করছে। ইদানীং ভোট এলেই রামমন্দিরের মতো এই দুই ধারা নিয়ে চর্চা শুরু করে। ওরা বলেছিল শান্তি আনবে। তা হয়ইনি, উলটে ওদের শাসনে রাজ্যের পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়েছে। টুকটাক অশান্তি আগেও ছিল। কিন্তু কেন্দ্রে বিজেপি আর এখানে পিডিপি-র সঙ্গে জোট সরকার হওয়ার পর মৃত্যু অনেক বেড়েছে। সে মিলিট্যান্ট হোক বা জওয়ান, অথবা সাধারণ মানুষ! তাই বিজেপি এই ইস্যু করছে। ২ কোটি চাকরি, কৃষিঋণ মকুব, কিছুই হয়নি। আরে ৩৭০ ধারা তো ভারতেরই অংশ। সংবিধান ঠিক হলে ৩৭০-ও ঠিক। আমাদের পার্টি মনে করে ৩৭০ ধারা অপব্যবহারের কারণেই কাশ্মীরের পরিস্থিতি খারাপ হচ্ছে। উপত্যকায় শান্তি ফেরাতে হলে সংবিধানে যা যা প্রতিশ্রুতি দেওয়া আছে, তা করতে হবে। তখন এত সেনাও লাগবে না। ৩৫এ ধারা কী বলুন তো? বাইরের কেউ এখানে জমি কিনতে পারবে না। এই নিয়ম উত্তর-পূর্ব ভারত ও বিভিন্ন আদিবাসী এলাকাতেও আছে। আরেকটা বিষয় হল, এই নিয়ম বানিয়েছে কে? এখানকার নাগরিকদের নিরাপত্তা দিতে ১৯২৭ সালে মহারাজা হরি সিং কাশ্মীরি সংবিধানে এই ধারা তৈরি করেন। পরে আমাদের সংসদ ৩৫এ ধারাকে ভারতীয় সংবিধানে ৩৭০ ধারার অংশ হিসাবে গ্রহণ করে। তাহলে বিজেপি বলুক যে, হরি সিং ভুল করেছেন। উলটে ওরা তো পুজো করে হরি সিংয়ের। ওঁকে ভুল বললে তো জম্মু হাত থেকে বেরিয়ে যাবে। যত রাজ্যের দু’মুখো নীতি।
[ আরও পড়ুন: কাঁটা উগ্র হিন্দুত্ববাদ! মোদির আবেদনেও সাড়া দিচ্ছেন না কাশ্মীরিরা]
আপনাদের ভোটারকে হঠাৎ করে এনসিকে ভোট দিতে বললেন কেন?
এই মুহূর্তে জম্মু-কাশ্মীরে আমাদের শক্তি কমে গিয়েছে। তার মানে এই নয় যে, আমরা মুছে গিয়েছি বা ‘অপ্রাসঙ্গিক’ হয়ে পড়েছি। তাই পার্টি ঠিক করেছে বিজেপিকে রুখতে যেখানে যে প্রার্থী শক্তিশালী, তাঁকে সাহায্য করা হবে। যেমন বাংলায় আমরা কংগ্রেসের সঙ্গে সমঝোতা করতে চেয়েছিলাম। জম্মুর দুই সিটে কংগ্রেসের প্রার্থী শক্তিশালী। আবার শ্রীনগর আর অনন্তনাগে এনসি। তাই জম্মুতে কংগ্রেস আর কাশ্মীরে এনসিকে ভোট দিতে বলেছি। পিডিপি বিজেপিকে এনেছে। এখনকার পরিস্থিতির জন্য ওরাও সমান দায়ী। এনসি কথা দিয়েছে ওরা ধর্মনিরপেক্ষভাবে চলবে। সাধারণের স্বার্থরক্ষা করবে। তাই এই সিদ্ধান্ত।
কলকাতায় সীতারাম ইয়েচুরিও বলেছেন যে, কেন্দ্রে অ-বিজেপি সরকার আনতে সাহায্য লাগলে দল তৈরি। সেই জোটে যদি তৃণমূল থাকে, তাহলে?
হায়দরাবাদ পার্টি কংগ্রেসে সিদ্ধান্ত হয়েছে যেভাবেই হোক বিজেপিকে সরাতে হবে। যেমন করেই হোক ভারতের সার্বভৌমত্ব, ধর্মনিরপেক্ষতা রক্ষা করতে হবে। তাই আর একদিনও বিজেপিকে ক্ষমতায় রাখা যাবে না। আবার দেশ চালাতে গেলে সরকারও লাগবে। আমরা চাই ধর্মনিরপেক্ষ সরকার। তাই বিজেপি বিরোধী মহাজোট তৈরি হলে তাতে আমরা আছি।
সেক্ষেত্রে বাংলায় পার্টি কর্মীদের অবস্থা তো খারাপ হয়ে যাবে? যে তৃণমূলের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে হচ্ছে, তাদের সঙ্গেই জোট?
সত্যি বলতে কী, এখনই চূড়ান্ত কিছু বলা ঠিক হবে না। পরিস্থিতি অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নিতে হবে। বাংলা বাঁচাতে টিএমসি, আর দেশ বাঁচাতে বিজেপিকে সরাতে হবে। এটাই আমাদের স্লোগান। সংসদে সরকার তৈরি করতে সমীকরণ কী হয়, সেটাও দেখতে হবে। তবে এই নির্বাচনের এক ও একমাত্র লক্ষ্য হল বিজেপি হঠাও, দেশ বাঁচাও।
সরকারে শরিক হলে ইউপিএ সরকারের মতো সময়ে সাধারণ ন্যূনতম কর্মসূচি থাকবে নিশ্চয়ই। থাকবে কিছু দাবিও?
আমাদের প্রধান শর্ত ধর্মনিরপেক্ষ সরকার চাই। সংবিধান বাঁচাতে হবে। প্রতিষ্ঠান বাঁচাতে হবে। যুব, মহিলা, কৃষক, শ্রমিকদের দেখবে এমন সরকার চাই। দাবিদাওয়া কী হবে, এসব নির্বাচন পরবর্তী বিষয়। বিজেপিকে সরিয়ে বামশক্তি জোরদার করতে হবে। সংসদে বাম প্রতিনিধি না বাড়লে সাম্প্রদায়িকতা রক্ষা করা, ভুল অর্থনীতির বিরুদ্ধে লড়াই করা সম্ভব নয়।
[ আরও পড়ুন: আমাদের পরিবার চাইলে ভারতকে ভেঙে দিতে পারত, বেফাঁস মন্তব্য ফারুক আবদুল্লার]
জোটসঙ্গী হলে ক্যাবিনেটে থাকবেন, না মনমোহন সরকারের মতো বাইরে থেকে সমর্থন দেবেন?
ওই যে বললাম। এগুলো নির্বাচন পরবর্তী বিষয়। এখনই বলার মতো নয়।
বাংলায় আসন সমঝোতা না হওয়ায় কী সমস্যা হল বলে মনে হয়?
এটা দুর্ভাগ্য। তৃণমূলের গুন্ডাগিরি আর বিজেপির তানাশাহি শেষ করতে চেয়েছিলাম। কংগ্রেসের সঙ্গে আসন রফার আলোচনা হয়। দীপা দাশমুন্সির মতো কয়েকজনের জন্য সেটা হল না।
বাংলা, ত্রিপুরা, কেরল। সব জায়গাতেই বামেরা দুর্বল হয়ে যাচ্ছে। ভারতে বামপন্থার ভবিষ্যৎ কী?
সংসদীয় রাজনীতিতে কার ক’জন সাংসদ, তার একটা গুরুত্ব তো আছেই। কিন্তু বামেদের আসল লক্ষ্য কিন্তু শাসন করা নয়। দেশের অর্থনৈতিক কাঠামোয় বদল আনা। যুব, মহিলা, কৃষক, শ্রমিককে একসঙ্গে এনে লড়াই, সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে নতুন হিন্দুস্থান, নতুন ভবিষ্যৎ তৈরি করা আমাদের লক্ষ্য। এই লড়াইয়ে ধাক্কা আসবে। সমস্যা আসবে। কিন্তু হতাশ হলে চলবে না। অন্ধকার কাটাতে কিন্তু দেশলাইয়ের সামান্য আলোই যথেষ্ট।
বামেদের অন্ধকার ভবিষ্যতে মহারাষ্ট্র কি সেই আলোই দেখাচ্ছে?
মহারাষ্ট্র, রাজস্থানে আমাদের সংগঠন বৃদ্ধি পাচ্ছে। সত্যিই ওরা গোটা দেশের কমরেডদের অনুপ্রাণিত করছে। কাশ্মীরেও দেখুন না। এত সমস্যার মধ্যেও কিন্তু ঠিক লালঝান্ডা আঁকড়ে বসে আছি। দুর্বল হয়েছি, শেষ হয়ে যাইনি। বাংলায় ব্রিগেড সমাবেশ দেখুন। টাকা দিয়ে লোক আনা হয়নি। পুলিশ, টিএমসির গুন্ডাগিরির মধ্যেও সবাই মনে জোর নিয়ে এসেছে। বাংলার কমরেডদের লাল সেলাম। ওরাই ঘুরে দাঁড়ানোর পথ দেখাবে।
[ আরও পড়ুন: রাহুল-সোনিয়া সম্পর্কে অশালীন মন্তব্য, বিতর্কে হিমাচলের বিজেপি সভাপতি]
দলের এই কঠিন সময়ে জ্যোতি বসু, হরকিষেন সিং সুরজিতের মতো নেতাদের মিস করছেন?
অবশ্যই। কিন্তু কিছু তো করার নেই। এটা তো প্রকৃতির নিয়ম।
বাংলায় ঘুরে দাঁড়াতে হলে পার্টির কী করা উচিত?
এখানে বসে এই নিয়ে জ্ঞান দেওয়া ঠিক না। বাংলার কমরেডরা অনেক অভিজ্ঞ। প্রচুর লড়াই-সংগ্রামের সাক্ষী। যে সন্ত্রাস ওরা দেখেছে কল্পনা করা যায় না। আমার বিশ্বাস, দলকে ঘুরে দাঁড়াতে বাংলাই পথ দেখাবে।
The post বিজেপিকে হঠাতে কী পরিকল্পনা বামেদের? অকপট কাশ্মীরের বিধায়ক appeared first on Sangbad Pratidin.