বিশ্বদীপ দে: পিগমি (Pygmy) বললে প্রথমেই কী মনে পড়ে? যারা সাত-আটের দশকে ছেলেবেলা কাটিয়েছেন, তাঁদের বোধহয় গুরানকেই সবচেয়ে আগে মনে পড়বে। পিগমি সর্দার গুরান। খুলিগুহায় অবাধ যাতায়াত ছিল তার। এই পিগমিরাই জানত বেতালের আসল পরিচয়। অথবা সিংহদমন গাটুলা সর্দার। হেমেন্দ্রকুমার রায়ের ‘আবার যখের ধন’-এর সেই দুর্দান্ত যোদ্ধা। তার কথাও মনে পড়তে পারে। কিন্তু যদি বলা হয় ওটা বেঙ্গার (Ota Benga) কথা? তাহলে?
তাঁকে কেউ মনে রাখেনি সেভাবে। তবে ইতিহাসের চর্চাকারীদের কাছে নামটার অসীম গুরুত্ব। কেননা ওটা বেঙ্গা নিছক রক্তমাংসের এক মানুষই নন। বরং সভ্যতার বুকে তিনি এক প্রতীক। তিনি প্রতীক মানুষের নির্লজ্জ বৈষম্যের। সাদা চামড়ার অশ্লীল অহং-এর। তিনি প্রতীক ইতিহাসের বুকে এমন এক অধ্যায়ের, যা স্মরণ করলে সভ্য মানুষের মাথা নুয়ে পড়তে বাধ্য।
[আরও পড়ুন: কৈলাস-মুকুল-অর্জুনের বিরুদ্ধে এখনই করা যাবে না কঠোর পদক্ষেপ, রাজ্যকে নির্দেশ সুপ্রিম কোর্টের]
ধরা যাক, একটা টাইম মেশিনে করে পৌঁছে যাওয়া গেল ১৯০৬ সালে, নিউইয়র্কের (New York) ব্রঙ্কস চিড়িয়াখানায়। তাহলেই দেখা মিলবে ওটা বেঙ্গার। তবে তিনি ওই চিড়িয়াখানার কোনও কর্মী ছিলেন না। তিনি ছিলেন এক ‘আইটেম’। যাকে দেখার জন্য ভিড় উপচে পড়ত বানরদের খাঁচার সামনে। হ্যাঁ, ‘সভ্য’ মানুষের খেয়ালে তাঁর জায়গা হয়েছিল সেখানেই। দেখতে ছোটখাটো। গায়ের রং মিশমিশে কালো। তার উপরে দাঁতগুলো অদ্ভুত তীক্ষ্ণ। ঠিক যেন ছুরির ফলা। ওই দাঁতের আলাদা আকর্ষণ ছিল দর্শকদের কাছে। এমনও শোনা যায়, কোনও কোনও দিন ওটা বেঙ্গার খাঁচার সামনে জড়ো হয়ে যেতেন শ’পাঁচেক লোক! সেই কারণেই প্রথমে ছোট খাঁচায় রাখা হলেও পরে তাঁকে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় বড় খাঁচায়। কেবল তাঁর জন্যই রাতারাতি দর্শকসংখ্যা বেড়ে দ্বিগুণ হয়ে যায়। এমন ‘আমোদ’ কি সহজে মেলে? দর্শকরা তাঁর দিকে নানা কুৎসিত অঙ্গভঙ্গি করতেন। প্রথম প্রথম ততটা না হলেও অচিরেই ধৈর্যের বাঁধ ভাঙে তাঁর। ক্রমশ হিংস্র হয়ে উঠতে থাকেন ওটা বেঙ্গা।
শেষ পর্যন্ত কী হয়েছিল আফ্রিকার অরণ্য থেকে শহরের বুকে পৌঁছে যাওয়া সেই মানুষটির? সেকথা বলার আগে জানানো দরকার, তিনি কী করে পৌঁছেছিলেন ওই তথাকথিত বুট-হ্যাট পরা সভ্যদের মাঝখানে! ১৮৮৩ সালে মধ্য আফ্রিকার কঙ্গোতে (Congo) জন্ম ওটা বেঙ্গার। ক্রমে সে জায়গাটা হয়ে ওঠে রাজা দ্বিতীয় লিওপোল্ডের শাসনাধীন বেলজিয়ামের উপনিবেশ। অরণ্যের নিয়ম মেনে অল্প বয়সেই বিয়ে হয়ে যায় ওটা বেঙ্গার। সন্তানও হয়। কিন্তু কে জানত সামনের দিনগুলোর উপরে নেমে আসতে চলেছে অন্ধকার পর্দা!
[আরও পড়ুন: খারিজ যোগী সরকারের দাবি! হাথরাস কাণ্ডে সিবিআইয়ের চার্জশিটে গণধর্ষণের উল্লেখ]
শিকার করে গিয়েছিলেন বেঙ্গা। ফিরে আসতেই দেখেন গ্রাম হয়ে গিয়েছে শ্মশান! তাঁর পরিবারের সকলেই মারা গিয়েছেন রাজার সেনার অতর্কিত আক্রমণে। সেই ভয়ঙ্কর আঘাত সইতে না সইতেই অচিরে ধরা পড়তে হল ক্রীতদাস ব্যবসায়ীদের হাতে।
এদিকে ১৯০৪ সালে আফ্রিকায় এলেন স্যামুয়েল ফিলিপস ভার্নার। লক্ষ্য ‘সেন্ট লুইস ওয়ার্ল্ড ফেয়ার’-এর প্রদর্শনীর জন্য বেশ কয়েকজন পিগমিকে নিয়ে যাওয়ার। খাঁচাবন্দি বেঙ্গাকে দেখে পছন্দ হয়ে গেল তাঁর। কয়েক বস্তা নুন আর কয়েক গোছা পিতলের তারের বিনিময়ে সওদা সম্পূর্ণ হল! যদিও শেষ পর্যন্ত ভার্নারকে ছাড়াই বেঙ্গা ও তাঁর মতো কয়েকজন হতভাগ্যকে আমেরিকায় নিয়ে আসা হয় ১৯০৪ সালের জুনে। ভার্নার সেই সময় ম্যালেরিয়া আক্রান্ত। পরে দেশে ফিরে তিনি বুক ফুলিয়ে গল্প বানিয়ে বলে দেন, ওটা বেঙ্গাকে নাকি নরখাদকদের হাত থেকে উদ্ধার করেছেন তিনি!
আমেরিকায় এসেই জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন ওটা বেঙ্গা। সবচেয়ে বড় আকর্ষণ ছিল তাঁর ওই তীক্ষ্ণ দাঁত। আসলের জঙ্গলের এক প্রথা মেনে ছোটবেলাতেই ওইভাবে দাঁতগুলোকে বল্লমের ফলার মতো বানিয়ে দেওয়া হয়েছিল। যা দেখে সভ্য মানুষদের গা শিরশির করত। সেই সময়কার এক কাগজে দাবি করা হয়, বেঙ্গা নাকি তাঁর দাঁত দর্শকদের একবার দেখানোর জন্য ৫ সেন্ট দাবি করেন! এমনকী, ছবি তুলতে বা কসরত দেখাতেও পয়সা নেন। বলাই বাহুল্য, এসবই রঙিন গল্প।
প্রদর্শনীর শেষে অবশ্য একবার বাড়ি ফেরার সুযোগ হয়েছিল বেঙ্গার। কিন্তু কোথায় যাবেন তিনি? তাঁর গ্রামটাই যে নিশ্চিহ্ন। তাঁর সঙ্গে যাঁদের নিয়ে আসা হয়েছিল, তারা কেউ পিগমি নয়, বাটোয়া উপজাতির। শোনা যায়, এই সময় এক বাটোয়া মহিলাকে নাকি বিয়ে করেছিলেন বেঙ্গা। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই সেই মহিলা মারা যান সাপের কামড়ে। এরপরই ফের আমেরিকা ফেরার সিদ্ধান্ত। গিয়ে পড়া সেই চিড়িয়াখানায়, যার কথা আগেই বলা হয়েছে।
তবে ওই চিড়িয়াখানায় বেঙ্গার দুর্ভোগ বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। সৌজন্যে ডারউইন! আসলে ডারউইনের বিবর্তনবাদ খ্রিস্টীয় বিশ্বাসের পুরো উলটো। তাই খ্রিস্টান নেতারা সমালোচনা করে বলতে থাকেন, বেঙ্গাকে যেভাবে মানুষ ও পশুর মিসিং লিঙ্ক বানানো হচ্ছে তা অন্যায়। তাঁদের ক্ষোভের মুখে পড়ে ছেড়ে দেওয়া হয় তাঁকে।
প্রথমে নিউ ইয়র্কের এক অনাথ আশ্রম। পরে ভার্জিনিয়ায় কৃষ্ণাঙ্গ শিক্ষার্থীদের জন্য এক কলেজে। সেখানেই আশ্রয় জুটেছিল। ততদিনে দাঁতে ক্যাপ পরিয়ে, সাহেবদের পোশাক আশাকে বেঙ্গার ভোল কিছুটা বদলেছে। কিন্তু মনের মধ্যে জেগে থাকা অরণ্যের সবুজকে কে বদলাবে? বাড়ি ফেরার জন্য মনকেমন করতে থাকে বেঙ্গার। রাতের খোলা আকাশের তলায় আগুন জ্বালিয়ে তার চারপাশে বৃত্তাকারে ঘুরে ঘুরে নাচগান করতেন তিনি। স্যান্ডউইচ আর রুট বিয়ারের বিনিময়ে সকলকে তাঁর অরণ্যচারী জীবনের গল্প শোনাতেন।
না, আর ফিরতে পারেননি বেঙ্গা। ততদিনে শুরু হয়ে গিয়েছে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ। আফ্রিকা যাওয়ার সব জাহাজ বন্ধ। ক্রমে বিষণ্ণতা গ্রাস করে তাঁকে। একদিন লুকিয়ে রাখা একটা বন্দুক দিয়ে আত্মহত্যা করে বসলেন অসহায় মানুষটি। তিনি চলে গেলেন। কিন্তু তাঁর প্রতি করা অন্যায় যেন বুকের উপর চেপে বসে রইল সভ্যতার। বারবার চেষ্টা হয়েছে, ‘ওসব বানানো কথা’ বলে উড়িয়ে দেওয়ার। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এবছরের আগস্ট মাসে ক্ষমা চেয়েছে ব্রঙ্কস চিড়িয়াখানা। জানিয়েছে, ওভাবে একটা মানুষকে পশুদের মধ্যে রেখে দিয়ে ভাল কাজ করেনি তারা। বেশ তাড়াতাড়িই ক্ষমা চেয়েছে। মাঝে তো মাত্র ১১৪টা বছর! এই না হলে সভ্যতা! ওটা বেঙ্গার এই অসহায় ও ট্র্যাজিক জীবনের সামনে দাঁড়ালে প্রতিটা তথাকথিত ‘সভ্য’ মানুষেরই অস্বস্তি হবে। রবীন্দ্রনাথের কলম ছুঁয়ে বলতে ইচ্ছে করে, ‘এ আমার এ তোমার পাপ’।