দুই জার্মান অভিযাত্রী বরফাবৃত আল্পস পর্বতের সাড়ে ১০,০০০ ফুটের অজানা খাঁজে ক্লান্তি পিঠে নিয়ে ধীর লয়ে এগনোর সময় হঠাৎই দেখেন উপুড় হয়ে থাকা বরফচাপা মানব শরীর। প্রথমে ভেবেছিলেন, অচেনা কোনও অভিযাত্রীর দেহ। পরে জানা যায়, সেটির বয়স ৫,৩০০ বছর, পৃথিবীর ইতিহাসে অবিকৃত ও সর্বাধিক সুরক্ষিত প্রকৃতির ফ্রিজে লুকনো এক মমি! তারই নাম দেওয়া হল ‘ওটজি’। এরপর শুরু হয় গবেষণা। বেরিয়ে আসে নানা তথ্য! লিখলেন সুমন প্রতিহার।
১৯৯১ সালের সেপ্টেম্বর মাস। দুই জার্মান অভিযাত্রী বরফাবৃত ইটালি (Italy) আর অস্ট্রিয়ার (Austria) আল্পস পর্বতের সাড়ে ১০,০০০ ফুটের অজানা খঁাজে ক্লান্তি পিঠে নিয়ে ধীর লয়ে এগনোর সময় হঠাৎই দেখেন উপুড় হয়ে থাকা বরফচাপা মানব শরীর। প্রথমে ভেবেছিলেন, অচেনা কোনও অভিযাত্রীর দেহ। পরে জানা যায়, সেটির বয়স ৫,৩০০ বছর, পৃথিবীর ইতিহাসে অবিকৃত ও সর্বাধিক সুরক্ষিত প্রকৃতির ফ্রিজে লুকনো এক মমি!
বিজ্ঞানীরা দিয়েছিলেন বরফ মমির আদুরে নাম ‘ওটজি’। মৃত্যুর কারণ জানতে গিয়ে বোঝা গেল, বাম কাঁধে বেঁধে রয়েছে তীক্ষ্ণ শলাকার খণ্ড, যা হৃৎপিণ্ডের সাবক্লেভিয়ান ধমনীতে তৈরি করেছিল গভীর ক্ষত। অজ্ঞাতসারে পিছন থেকে অতর্কিত আঘাতে ডানহাতের উপর ভর করে মুখ থুবড়ে পড়ে ওটজি। বছর ৪৬-এর এই মানুষটির সঙ্গে পাওয়া গিয়েছিল অসমাপ্ত তির আর ধারালো ছুরি। ছুরিটি ধরা ছিল তার ডান হাতে, সেই সঙ্গে ডান কবজিতে এলোমেলো গভীর ক্ষত। পাকস্থলী পরীক্ষা করে বোঝা গেল, মৃত্যুর আগে শেষ খাবারই বা কী ছিল।
তবে ওটজির মৃত্যুর সময় ও কারণ নিয়ে বিজ্ঞানীদের সহমত নেই। আল্পসের প্রকৃতির সেই ফ্রিজ অ্যালবার্ট জিংক খুঁটিয়ে দেখেই অনুভব করেন, অনেকটা ক্রাইম সিন পরিদর্শন করার মতোই। ইউরোপীয় অ্যাকাডেমির নৃতত্ত্ববিদ অ্যালবার্ট জিংক মনে করেন, ওটজিকে খুন করা হয়েছিল! অত্যাধুনিক বিজ্ঞানের সাহায্যে ওটজির রক্তবিন্দু পর্যন্ত পাওয়া গিয়েছে।
[আরও পড়ুন: ‘ব্যর্থতা মানতে পারছি না’, লুনা-২৫ ভাঙার পরেই অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে রুশ বিজ্ঞানী]
মানবেতিহাস অন্বেষণে মমির রক্তবিন্দু অকল্পনীয়। সেই বিন্দু জানান দেয়, ওটজির শরীরের স্থিতি, সেই সঙ্গে কোমরের হাড় থেকে নিষ্কাশিত ডিএনএ থেকে পড়ে ফেলা গিয়েছিল ওটজির জিন মানচিত্র। ওটজির মমি বিজ্ঞানের মাইলস্টোন, তাম্র যুগের জীবন্ত দলিল ওটজি। সে-সময়ের জীবনযাত্রা, চলাফেরা, হাবভাব বুঝতে ওটজি বিজ্ঞানের সম্বল। তাই বারংবার বিজ্ঞানীরা ওটজির মমি ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখার চেষ্টা করেছেন। প্রতিবারই পেয়েছেন নতুন কিছু না কিছু।
সবার আগে পোশাকের ব্যাপারে চোখ ধঁাধিয়ে দেয় ওটজি। ওটজির পোশাক তৈরিতে ব্যবহার হয়েছিল পঁাচ ধরনের প্রাণীর চামড়া। ভেড়ার চামড়া কাজে লাগিয়ে তৈরি করা হয়েছিল ক’টি বস্ত্র, ছাগলের চামড়া কাজে লাগিয়ে প্যান্ট, হরিণের চামড়া ব্যবহার করে তির রাখার ডালি, ভল্লুকের চামড়া দিয়ে টুপি, গরুর চামড়া দিয়ে জুতোর ফিতে, ছাগলের চামড়া দিয়ে প্রস্তুত ঝোলা কোট যা এলোমেলোভাবে ভেড়ার সরু চামড়া দিয়ে তাড়াতাড়িতে বোনা। বিজ্ঞানীরা আরও গভীরে গিয়ে দেখেছিলেন, ওটজির পোশাকের জন্য চারটি ভেড়া ও দু’টি ছাগলের চামড়া ব্যবহার হয়েছিল।
[আরও পড়ুন: জাতীয় সংগীতের মতো রাজ্যের জন্য তৈরি হোক ‘রাজ্য সংগীত’, প্রস্তাব স্পিকারের]
প্রথম দেখায় ওটজির শরীরে ৪৯টি ট্যাটু লক্ষ করা গিয়েছিল, পরে আরও ১০টি, সবশেষে সংখ্যাটি দঁাড়ায় ৬১। কিছু ট্যাটু লম্বা কিছু আড়ে, ‘ট্যাটু’ বলতে বেশ কয়েকটি দাগ। বাম কবজি, পায়ের নিম্নভাগে, কোমর-সহ ওটজির বুকেও রয়েছে ট্যাটু। চামড়ার উপরের অংশ চিরে তার মধ্যে চারকোল ঘষে তৈরি করা হয়েছিল আদিম ট্যাটুগুলো। রহস্যময় ট্যাটুগুলো নিয়ে চাপা বিতর্কের স্রোত এখনও। ভাবা হয়, ট্যাটুগুলোয় দক্ষিণ আমেরিকার চিনচোরো সংস্কৃতির প্রভাব। চিনচোরো মূলত মৎস্যজীবী। তারা চিলি, পেরুর প্রান্তে বসবাস করত।
তাদের ছয় হাজার বছর পুরনো মমি থেকে পৃথিবীর আদিমতম ট্যাটুর খোঁজ মিলেছিল। তবে মমির এই বয়স বিতর্কিত, সেক্ষেত্রে বরফ মানব ওটজির ট্যাটুগুলোই প্রাচীনতম। ওটজির শেষ খাবার কী ছিল? মৃত্যুর আগে বিজ্ঞান দেখল, ওটজি ৩০০ গ্রাম খাবার নিয়েছিল। কী ছিল তাতে। লম্বা সিং হরিণের মাংস, গম আর অল্প পরিমাণে বিষাক্ত ফার্ন। এই বিষাক্ত ফার্ন বেশি পরিমাণে খেলে গরুদের অ্যানিমিয়া হয় এবং ছাগলগুলো অন্ধ হয়ে পড়ে। হরিণের চর্বির স্বাদ নাকি ভয়ংকর, তবুও পাহাড়ে যাবতীয় শক্তির উৎস চর্বি থেকে পাওয়া শক্তি।
ওটজির মমি আবিষ্কারের পরে প্রথমে খুঁজে পাওয়া যায়নি পাকস্থলী। ২০০৯-এ রেডিওগ্রাফিক স্ক্যানে ধরা পড়েছিল, তার পাকস্থলী ঠেলা হয়ে উপরে উঠেছে বেশ খানিকটা, রয়েছে, যেখানে বাম ফুসফুস থাকে। পাকস্থলীতে খাবার পরীক্ষা করে এও জানা যায়, ওটজি মৃত্যুর একদিন আগে হরিণ-সহ ছাগলের মাংসও খেয়েছিল। গবেষকরা উৎসাহী– ওটজির খাওয়া মাংস কী ধরনের ছিল তা নিয়ে, তারা দেখল ওটজির পাকস্থলীতে পাওয়া মাংস সামান্য ঝলসিয়ে শুকিয়ে নেওয়া হয়েছিল, ঝলসানোটিও নাকি ১৪০ ডিগ্রি ফারেনহাইটের উপরে হয়নি।
পিঠে রাখা তিরডালিতে তিরগুলোর সংখ্যা দেখে বিজ্ঞানীদের আন্দাজ, ওটজির খাওয়া শেষ মাংস টাটকা ছিল না। গবেষকরা বললেন, বিশাল আকৃতির লালচে হরিণগুলোর লিভার বা প্লিহা ওটজি সম্ভবত খেয়েছিল, তবে এ নিয়ে বিজ্ঞানীরা বিশেষ ভাবিত নন। ওটজির খাওয়া থেকে জানা গিয়েছিল তাম্রযুগের মেনু, যেখানে শস্য ও মাংসর চমৎকার মিশ্রণ ছিল। তাম্রযুগ, যে-সময়ের প্রতিনিধি ওটজি, সে-সময়ের তথ্য অপ্রতুল, তাই পাকস্থলীর খাদ্য বিশ্লেষণ মানব ইতিহাসের ক্রমবিবর্তনের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ। ওটজির চামড়ার রং নিয়েও গবেষকদের বনিবনা নেই। ২০২৩-এর আগস্ট মাসে ‘সেল জিনোমিক্স’ জার্নালে ওটজির উপর নতুন গবেষণায় বদলে গেল তার গায়ের রং।
প্রথম ঝলকে ভাবা হয়েছিল, ওটজির গায়ের রং ইউরোপীয়দের তুলনায় চাপা। ইউরোপীয়রা মূলত তিনটি অঞ্চল থেকে পরিযান করেছে। পশ্চিম থেকে আসা জোগাড়ে শিকারি দল, ৮০০০ বছর আগে তুরস্ক থেকে আসা চাষির দল, পূর্ব ইউরোপের তৃণভূমি থেকে আসা পশুপালকের দল। ৪,৯০০ বছর আগে তিনটি আদিম জনগোষ্ঠী মিলেমিশে যায়। প্রাথমিকভাবে ওটজির জিন-মানচিত্র পড়ে জানা গিয়েছিল, তারা স্টেপি পশুপালকের জনগোষ্ঠীর জিন বহন করছে। গায়ের লোম যথেষ্ট কম ছিল, মাথায় টাক পড়ার উপক্রম, সেই সঙ্গে ওটজি দুধ হজমে অক্ষম ছিল। আধুনিকতম গবেষণায় দেখা গেল, ওটজি বিচ্ছিন্ন ছোট কোনও জনগোষ্ঠীর সদস্য, যাদের সঙ্গে ইউরোপীয়দের বিশেষ সাক্ষাৎ ঘটেনি। জন্মসূত্র উদ্ঘাটন শেষে রইল বাকি ওটজি হত্যা-রহস্য।
গবেষকের একটা দলের দাবি, ওটজির মমি যেখানে পাওয়া গিয়েছে, মৃত্যু হয়েছে অন্যত্র। আশপাশ থেকে পাওয়া উদ্ভিজ অংশ– ঘাস, প্রাণী মল, মসগুলো বিচার্যে আনলে– ওটজির মৃত্যুর সময়টা সম্ভবত বসন্তকালে। গবেষকদের এমনটাও ধারণা, বহু সময় যাবৎ মৃতদেহ খোলা আকাশের তলায় বরফ বিনা ছিল। আবহাওয়ার পরিবর্তনে ওটজির মৃতদেহ নতুন স্থানে সংকীর্ণ এক বরফ খঁাজে আটকে পড়ে, যেখানে দুই জার্মান অভিযাত্রীর নজরে আসে।
ক্রমশ গরম হচ্ছে পৃথিবী, গলছে বরফ, চাপা অতীতের ইতিহাস নজরে আসছে। ওটজিকে কে হত্যা করেছিল, কেনই বা হত্যা? প্রাথমিক একটা ধারণা ছিল, ওটজি কোনও জনগোষ্ঠীর বিশেষ রীতির বলি। ওটজির বাম কঁাধে যে গঁাথা শলাকার ফলা। ওটজির হত্যার দু’দিন আগে তৈরি হয়েছিল ডান কবজিতে মারাত্মক জখম, যা সম্ভবত ধারালো অস্ত্রের আঘাত হাত দিয়ে প্রতিরোধে তৈরি হয়েছিল। হয়তো-বা শিকারি ওটজি অজ্ঞাতে অচেনা জনগোষ্ঠী অঞ্চলে ঢুকে পড়ে। ফলে হত্যা। ওটজির মৃত্যু কি গোষ্ঠী-যুদ্ধে, না কি নিজ গোষ্ঠীর পরিচিত প্রিয়জনের পিছন থেকে চালানো তিরে? জার্মান পুলিশের দুঁদে গোয়েন্দা আলেকজান্ডার হর্ন, সবদিক বিচার করে বলছেন খুনি তো ওটজির কোনও সামগ্রী চুরি করেনি, ব্যক্তিগত আক্রোশ থেকেই হত্যা। তা-ও ওটজির খুনি কে, জানা যায়নি।