বাবুল হক, মালদহ: করোনা (Coronavirus) আবহে দ্বার বন্ধ রেখেই কি দুর্গা আরাধনা হবে চাঁচোল রাজবাড়িতে( Chanchal Rajbari) ? অনেকের মনেই ঘুরপাক খাচ্ছিল এই প্রশ্ন। মিলল উত্তর। জানা গিয়েছে, জনসাধারণের আবেগের কথা মাথায় রেখে মহামারীকালেও খোলাই থাকবে রাজমন্দিরের দরজা। তবে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে বাঁশের ব্যারিকেড দিয়ে এবার ঘিরে ফেলা হবে সেই দ্বার। স্বাস্থ্যবিধি মেনে একসঙ্গে দশজন করে প্রবেশের অনুমতি পাবেন। মাস্ক ব্যবহার বাধ্যতামূলক। রাজ-দরজায় থাকবে স্যানিটাইজার।
রাজা নেই, রানিও নেই। রাজপাটও নেই। রাজবাড়ির কোনও সদস্যও নেই। রাজবাড়িটাও বদলে গিয়েছে মহকুমা আদালতে। স্মৃতি বলতে রয়ে গিয়েছে রাজমন্দিরটুকু। তবু বন্ধ হয়ে যায়নি সাড়ে তিনশো বছরের প্রাচীন পুজো। বাপ-ঠাকুরদার প্রথা কী সহজে বন্ধ করে দেওয়া চলে! আয়োজন ক্ষুদ্র হলেও ফি বছর স্থানীয়রা কোমর বেঁধে শামিল হয় এই পুজোয়। অর্থ জোগায় ট্রাস্টি বোর্ড ও এলাকার কিছু মানুষ। এবারও তাঁদের সহযোগিতায় পুজোর তোড়জোড় শুরু হয়ে গিয়েছে। তবে প্রতিবারের তুলনায় এবার অনেক কিছুতেই কাটছাঁট করা হবে।
প্রায় ৩৫০ বছর আগে চাঁচোল রাজবাড়িতে এই পুজোর সূচনা হলেও এখন আর রাজবাড়িতে দেবী আরাধনা হয় না। পুজো হয় রাজবাড়ি থেকে প্রায় আড়াই কিলোমিটার দূরে পাহাড়পুরের দুর্গামন্দিরে। মূল পুজোর ১২ দিন আগেই কৃষ্ণা নবমী তিথিতে তামার ঘট ভরে পুজো শুরু হয় সেখানে। মৃন্ময়ী রূপে মাটির প্রতিমার পুজো হয় সেখানে। এখানে দেবী দশভুজাও নন, চতুর্ভুজা। প্রতিমার সঙ্গেই পুজোর তিনদিন অষ্টধাতুর সিংহবাহিনী মূর্তির পুজো হয় সেখানে। সপ্তমীর দিন রাজবাড়ি থেকে পাহাড়পুরের মন্দিরে সিংহবাহিনী মাকে পায়ে হেঁটে নিয়ে যান রাজবাড়ির পুরোহিত। অষ্টাদশ শতকের প্রথম দিকে চাঁচোলের রাজা রামচন্দ্র রায়চৌধুরি যখন এই পুজো শুরু করেন, সেই সময় গোটা এলাকা ছিল জঙ্গলে ভরতি। রাজ পরিবারের লোকজন হাতির পিঠে চেপে পাহাড়পুরে মহানন্দা নদীর সতীঘাটে স্নান করতে যেতেন। একদিন রামচন্দ্র রায়চৌধুরি সেই সতীঘাট থেকে অষ্টধাতুর সিংহবাহিনী মূর্তি পান। পরে দেবীর স্বপ্নাদেশ পেয়ে তিনি সেই বিগ্রহ রাজবাড়ির ঠাকুরবাড়িতে প্রতিষ্ঠা করেন। তখন থেকেই প্রতিদিন সকাল-সন্ধেয় ঠাকুরবাড়িতে সিংহবাহিনী পুজিতা হন। একসময় শারোদৎসবের সময় সতীঘাটে একটি খড়ের কুঁড়েঘর তৈরি করে মাটির প্রতিমার সঙ্গে কূলদেবীরও পুজো করা হত। কাশীধাম থেকে পুরোহিত দুর্গাপুজো করতে আসতেন। পরবর্তীতে রামচন্দ্রের নাতি রাজা শরৎচন্দ্র রায়চৌধুরি পাহাড়পুরে স্থায়ী দুর্গামন্দির নির্মাণ করেন। তখনও পুজোয় খুব জাঁকজমক ছিল।
[আরও পড়ুন: করোনা কালে কমেছে প্রতিমার বরাদ্দ, লাভ কমলেও নিষ্ঠায় কমতি নেই তেহট্টের মৃৎশিল্পী বধূর]
পুজো প্রসঙ্গে ট্রাস্টি বোর্ডে সদস্য পিনাকীজয় ভট্টাচার্য জানান, “চাঁচোল রাজবাড়ির মন্দিরগৃহ ছাড়া বাকি অংশটুকু সরকার কিনে নিয়েছে। এখন রয়েছে শুধু রাজমন্দির অর্থাৎ ঠাকুরদালান। মন্দিরগৃহে রয়েছে অষ্টধাতুর সিংহবাহিনী দুর্গামূর্তি। প্রত্যহ পুজো ও সন্ধ্যারতি হয়। পাহাড়পুরের মন্দিরে রাজবাড়ির পুজোয় মৃণ্ময়ী মুর্তির পাশে অষ্টধাতুর সিংহবাহিনী মূর্তিও পূজিত হন। ষষ্ঠীতে দেবীর বোধন এবং সপ্তমীতে শুরু হয় পুজো। সপ্তমীর সকালে ঢাক, সানাই আর কাঁসর ঘন্টা বাজিয়ে শোভাযাত্রার মাধ্যমে রাজবাড়ির মন্দির থেকে মূলদেবতা সিংহবাহিনীকে পাহাড়পুরের মন্দিরে নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু এবার করোনার কারণে শোভাযাত্রায় ভিড় যাতে না হয় সেদিকে নজর দেওয়া হবে।” এই পুজোর বিসর্জনের নিয়মও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বার্তা দেয়। বিসর্জনের সময় সতীঘাট লাগোয়া গ্রামগুলিতে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মহিলারা হাতে জ্বলন্ত হ্যারিকেন, মোমবাতি, মশাল নিয়ে মাকে বিদায় জানান। বিসর্জনের পর অষ্টধাতুর সিংহবাহিনী মূর্তি ফের নিয়ে যাওয়া হয় রাজমন্দিরে।