shono
Advertisement

Breaking News

কাঁচা মাংস খেতেন মারাদোনা? একান্ত সাক্ষাৎকারে স্মৃতির পাতা ওলটালেন এককালের সতীর্থ বুরুচাগা

ম্যাচের আগে প্রস্তুতি কীভাবে নিতেন মারাদোনা? জানালেন বুরুচাগা।
Posted: 05:49 PM Jan 25, 2021Updated: 10:30 PM Jan 25, 2021

গত বছরের ২৫ নভেম্বর ফুটবল বিশ্ব হারিয়েছে ‘সোনার ছেলে’ দিয়েগো মারাদোনাকে। ফুটবলের রাজপুত্র নেই আজ ঠিক ২ মাস হল। সংবাদ প্রতিদিন ডিজিটাল-এর কাছে বন্ধু মারাদোনার স্মৃতিচারণ করতে বসে হর্হে বুরুচাগা (Jorge Burruchaga) ফিরে গেলেন ফেলে আসা সোনালি দিনে। শুনলেন কৃশানু মজুমদার

Advertisement

দিয়েগো মারাদোনার সঙ্গে আপনার প্রথম আলাপ কীভাবে?

বুরুচাগা: ১৯৮৩ সাল থেকে আমি দিয়েগো মারাদোনাকে (Diego Maradona) চিনি। সে বছর আমরা কোপা আমেরিকা (Copa America) খেলছিলাম।  সেবারের কোপা আমেরিকার ম্যাচগুলোর আগে মারাদোনা খেলেনি। আমাদের কোচ ছিলেন কার্লোস বিলার্দো। জাতীয় দলের কোচ হিসেবে বিলার্দো শুরু করেন ১৯৮৩ সালের মার্চে। সেবার আমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ ছিল দিয়েগোকে সতীর্থ হিসেবে দলে পাওয়া। কারণ তার আগে আমরা দিয়েগোর খেলা কেবল টিভিতেই দেখেছি। কোপা আমেরিকা খেলতে গিয়ে দিয়েগোকে আমরা সতীর্থ হিসেবে পাই। খুব কাছ থেকে তখন ওকে দেখার সুযোগ হয়। সেই সময় থেকেই আমরা সবাই দিয়েগোকে ভালবেসে ফেলেছিলাম।

প্রথম দেখার কথা বললেন। শেষের দিকে ক্যাপ্টেনের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল আপনার?

বুরুচাগা: খেলা ছাড়ার পরে মারাদোনার সঙ্গে কয়েকটা ইভেন্টে দেখা হয়েছিল। খুব যে বেশি দেখাসাক্ষাৎ হয়েছিল তা নয়। মারাদোনা রেসিং ক্লাবে যখন কোচিং করাচ্ছিল, আমি তখন ইন্ডিপিয়েনডিয়েন্টেতে খেলতাম। ও যে আবার মাঠে ফিরে এসেছিল, সেটা আমার খুব ভাল লেগেছিল। কারণ ফিফা ওকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছিল। তার পরেও যে দিয়েগো আবার মাঠে ফেরে, তাতে আমি দারুণ খুশি হয়েছিলাম।

মারাদোনা নাম উচ্চারণ করলেই আপনার কোন কথাটা সব চেয়ে বেশি মনে পড়ে?

বুরুচাগা: মারাদোনা নামটা উচ্চারিত হলেই আমার চোখে ভিড় করে আসে অজস্র স্মৃতি। খুব বেশি করে মনে পড়ে ১৯৮৬ সালের মেক্সিকো বিশ্বকাপের কথা। বিশ্বকাপ শুরুর ঠিক এক মাস আগে আমরা মেক্সিকোয় পৌঁছে গিযেছিলাম। আবার বিশ্বকাপ শেষ হওয়ার এক মাস পরে আমরা মেক্সিকো ছেড়েছিলাম। মেক্সিকোয় দিয়েগো আর আমাকে একসঙ্গে প্র্যাকটিস করাতেন কোচ কার্লোস বিলার্দো। মাঠের মধ্যে বোঝাপড়া যাতে ভাল হয়, সেই কারণেই দিয়েগোর সঙ্গে আমাকে প্র্যাকটিস করতে বলতেন বিলার্দো। প্র্যাকটিসের সময়েই দেখতাম ওর চোখজুড়নো স্কিল। অদ্ভুত ধরনের একটা প্র্যাকটিস করতো দিয়েগো। তিরিশ মিটার উপরে বল মারত। বলটা যখন নীচে নেমে আসত তখন আবার মারত। বলটা কিছুতেই মাটিতে পরতো না। আমরাও ওর মতো বল নিয়ে ওই একই জিনিস করার চেষ্টা করতাম। কিন্তু আমার কাছে তা অসম্ভব ছিল।

মেক্সিকো বিশ্বকাপের সেরা মুহূর্ত ছিল ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে সেই দুরন্ত গোল। আমি ওর বাঁ দিক দিয়ে দৌড়চ্ছিলাম। আর দিয়েগো ইংল্যান্ডের ফুটবলারদের ড্রিবল করতে করতে এগোচ্ছিল। ফুটবল ইতিহাসের সেরা গোল ওটাই। ওই অবিশ্বাস্য গোলটার পরে আমি ওকে জড়িয়ে ধরে চিৎকার করছিলাম। আমরা সবাই খুশিতে ফুটছিলাম। খুব কাছ থেকে ওরকম দুর্দান্ত একটা গোল দেখার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল। মারাদোনার করা ওই গোল কেউ কোনওদিন ভুলতে পারবে না। আমি তো পারবই না।

[আরও পড়ুন: ফের বিমান দুর্ঘটনার কবলে ব্রাজিলের ফুটবলাররা, প্রাণ হারালেন ক্লাব প্রেসিডেন্ট-সহ ৫]

বিশ্বকাপ ফাইনালে আপনার গোলেই চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল আর্জেন্তিনা। গোলের গন্ধ মাখা পাসটা বাড়িয়েছিলেন আপনার বন্ধুই।

বুরুচাগা: অস্কার রুগেরি যখন বলটা মারল আর এনরিকে ধরল, তখনই আমি বুঝে ফেলেছিলাম, বলটা দিয়েগোর কাছেই আসবে। আমি তৈরিই ছিলাম। বাঁ দিক থেকে আমি ডান দিকে দৌড়তে শুরু করে দিই। আমি জানতাম জার্মানি অফসাইড ট্র্যাপে ফেলার চেষ্টা করবে। দিয়েগোকে উদ্দেশ্য করে আমি সেটাই বলার চেষ্টা করি। কিন্তু দিয়েগো আমার কথা শুনতে পায়নি। কারণ স্টেডিয়ামে উপস্থিত দর্শকরা তখন এত চিৎকার করছিল যে আমার কথা শুনতেই পায়নি দিয়েগো। তাতে অবশ্য ক্ষতি কিছু হয়নি। না দেখেই দিয়েগো ওই পাসটা বাড়িয়েছিল। আর ওরকম পাস একমাত্র দিয়েগোর পক্ষেই দেওয়া সম্ভব। ম্যাচের দারুণ এক মুহূর্ত ছিল ওটা। ওই পাস থেকেই আমি গোল করে দেশকে বিশ্বকাপ এনে দিয়েছিলাম। আমার জন্য দারুণ এক মুহূর্ত ছিল।

আপনাদের ১৯৮৬ বিশ্বকাপের স্কোয়াডের হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ নিশ্চয় রয়েছে। সেই গ্রুপে মারাদোনা কি অ্যাকটিভ থাকতেন? এখন নিশ্চয় গ্রুপের ডিসপ্লে পিকচারে মারাদোনা।

বুরুচাগা: আমাদের একটা হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ আছে। সেই গ্রুপে দিয়েগোও ছিল। ও গ্রুপ থেকে মাঝেমধ্যেই বেরিয়ে যেত। আবার গ্রুপে ঢুকে পড়ত। আমরা সবাই জানতাম, দিয়েগো বেস্ট। গ্রুপে ও বেশ অ্যাক্টিভই ছিল।

আমাদের হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ থেকে তিনজন এখন মুছে গিয়েছে। হোসে লুইস কুচুফো এক মর্মান্তিক দুর্ঘটনায় আগেই চলে গিয়েছিল। বছর দুয়েক আগে তিতা ব্রাউন চলে যায়। আর গত বছর তো দিয়েগো আমাদের ছেড়ে চলে গেল। তিনজনই এখন স্বর্গে। তিনবন্ধু চলে যাওয়ার দুঃখ তো আমরা সবাই বয়েই বেড়াচ্ছি। দিয়েগোর মৃত্যু আমাদের অত্যন্ত ব্যথিত করেছে। ওর পরিবারের প্রতি সমবেদনা তো রয়েইছে। দিয়েগোর সঙ্গে অনেক সুন্দর সময় কাটিয়েছি। সেই স্মৃতিগুলোই মনে রাখতে চাই।

বুরুচাগার সঙ্গে মারাদোনা

মারাদোনার মৃত্যু সংবাদ কীভাবে পেলেন? আপনি তখন কোথায় ছিলেন?

বুরুচাগা: আমি তখন উরুগুয়েতে ছিলাম। আমেরিকান কাপ খেলছিলাম আমরা। লাঞ্চের সময় আমরা সবাই টিভি দেখছিলাম। টিভিতে খবর দেখে আমরা হতবাক হয়ে যাই। দিয়েগোর শারীরিক অবস্থার কথা আমরা সবাই জানতাম। তবে এত তাড়াতাড়ি যে মারা যাবে তা কল্পনাও করিনি। মাঠে যেভাবে ও খেলত, ঠিক সেভাবেই নিজের জীবন কাটিয়েছে।

[আরও পড়ুন: সর্বকালের সর্বোচ্চ গোলদাতা নন রোনাল্ডো! চেক ফুটবল সংস্থার টুইটে বিতর্ক]

একবার সেভিয়ার এক খেলোয়াড় বলেছিলেন মারাদোনা নাকি কাঁচা মাংস খান। আপনি তো মারাদোনাকে খুব কাছ থেকে দেখেছেন। মারাদোনা কি সত্যিই কাঁচা মাংস খেতেন? 

বুরুচাগা: না, না, কাঁচা মাংস খেত বলে শুনিনি। ফ্রান্সে থাকার সময়ে আমি শুনেছিলাম আধা সেদ্ধ মাংস খায় সবাই। দিয়েগো ইউরোপে খেলেছে। ও হয়তো সেরকমই কিছু জানত।

মেক্সিকো বিশ্বকাপে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে গোল মারাদোনাকে অবিস্মরণীয় করে রেখেছে। মারাদোনা বললে ওই গোল ছাড়া অন্য কোনও ম্যাচ বা গোলের কথা কি মনে পড়ে আপনার?

বুরুচাগা: দিয়েগো বললেই আমার চোখের সামনে ফুটে ওঠে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে ম্যাচ। বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালের ম্যাচ, তার উপরে চার বছর আগে ইংল্যান্ডের সঙ্গে যুদ্ধ হয়েছিল। ফলে ম্যাচটা নিয়ে উন্মাদনা ছিল। আমরা আর্জেন্তিনার মানুষকে আনন্দ দিতে চেয়েছিলাম। দিয়েগো আমাদের ক্যাপ্টেন। দুটো গোলই ছিল দিয়েগোর। আর দুটো গোলই ছিল সেরা। একটা হাত দিয়ে। সবাই সেটা ধরতেও পারেনি। আমরা মাঠে ছিলাম। আমরাও বুঝতে পারিনি। দ্বিতীয় যে গোলটা করেছিল, তা ইতিহাসের সেরা গোল। একটা গোল সবচেয়ে সুন্দর আর আরেকটা চালাকির মাধ্যমে সেরা।

মেক্সিকো বিশ্বকাপে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে মারাদোনার বিখ্যাত সেই গোলের মুহূর্ত

দিয়েগো আপনাদের বকাবকি করতেন? ড্রেসিংরুমে মেজাজ হারাতেন?

বুরুচাগা: খেলার মাঠে অনেকেই খারাপ কথা বলে ফেলেন। এটা হয়েই থাকে। দিয়েগো অন্যকে উৎসাহ দেওয়ার চেষ্টা করত। আমাদের সাহস জোগাত। 

আপনার কি মনে হয় বেহিসেবি জীবনযাপনই দিয়েগোকে দ্রুত মৃত্যুর দিকে এগিয়ে দিল?

বুরুচাগা: দিয়েগোর জীবন নিয়ে আমি কিছু বলতে পারি না। আমি বলতেও চাই না। দিয়েগো নিজে স্বীকার করেছিল যে ও ভুল করেছে। তার জন্য ওকে শাস্তিও পেতে হয়েছে। তবে খুব ভাল করে দেখলে মনে হয় দিয়েগোর জীবন খুবই ছোট। অনেক ভাল সময় উপহার দিয়েছে। আবার অনেক কষ্টও পেয়েছে। মারাদোনার মৃত্যুর পরে অনেক কিছু সামনে আসছে। ওর স্ত্রী, পরিবার, মেয়েদের উপরে অনেক খবরাখবর বেরোচ্ছে। আমি তা নিয়ে কথা বলতে চাই না। আমি প্লেয়ার দিয়েগোকে বিচার করতে পারি। ও আমার দেখা সেরা ফুটবলার।

মারাদোনার মতো ব্যক্তিত্বের প্রয়াণের পরে অনেক জিনিস প্রকাশ্যে আসছে। তাঁর সম্পত্তি দখল নিয়ে নানা কথা শোনা যাচ্ছে। মারাদোনার কি এটা প্রাপ্য ছিল?

বুরুচাগা: এককথায় বলতে পারি এটা অত্যন্ত দুঃখজনক। এনিয়ে আমার বলার কিছু নেই। জীবনে বহুবার কঠিন সময়ের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছে মারাদোনাকে। সেই সমস্যাগুলোকে ও ড্রিবল করে বেরিয়ে এসেছে। আমাদের কাছে দিয়েগো ছিল সর্বশক্তিমান এক রাজা। আমরা বিশ্বাস করতাম মৃত্যুকেও চ্যালেঞ্জ জানাতে পারে দিয়েগো। আমরা সবাই জানতাম ওর শারীরিক অবস্থা ভাল নয়। তবে তার জন্য এত তাড়াতাড়ি যে দিয়েগোকে চলে যেতে হবে এটা বুঝতে পারিনি। ঈশ্বর দিয়েগোকে নিজের কাছে ডেকে নিয়েছেন।

[আরও পড়ুন: সিডনিতে অজিদের সঙ্গে লিফটেও উঠতে দেওয়া হয়নি রাহানেদের! বিস্ফোরক অশ্বিন]

চিকিৎসার গাফিলতিতে মারাদোনার মৃত্যু হয়েছে। এরকম অভিযোগ রয়েছে। আপনারও কি তাই মনে হয় চিকিৎসা ঠিকঠাক হলে ক্যাপ্টেনকে এখনও পাশেই পেতেন?

বুরুচাগা: জানি না। এ নিয়ে কিছু বলবো না। এখন তা নিয়ে তদন্তও চলছে। আমরা সবাই চাই সত্যিটা বেরিয়ে আসুক। তাহলেই জানা যাবে চিকিৎসার গাফিলতিতে দিয়েগো সেদিন মারা গিয়েছিল কিনা।

নিন্দুকরা বলে থাকেন ভাল খেলার জন্য মারাদোনা নাকি ড্রাগ নিতেন। আপনি কোনওদিন দিয়েগোকে নিষেধ করেননি?

বুরুচাগা: না, না। ভাল খেলার জন্য দিয়েগো কোনওদিন ড্রাগ নেয়নি। ও যদি ড্রাগ না নিত তাহলে আরও ভাল খেলতে পারত। দিয়েগো নিজেও স্বীকার করেছিল যে ও ভুল করেছে। দিয়েগোর সঙ্গে আমার এ নিয়ে কোনওদিন কথা বলার সুযোগ হয়নি। অনেক শক্তিশালী লোকই ড্রাগ নেয়। তবে তাঁরা গোপনে নেয়। এখন যা হওয়ার হয়েই গিয়েছে। এগুলো এখন আর বলে কোনও লাভ নেই।

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

Advertisement