সুমিত বিশ্বাস, বাঘমুন্ডি (পুরুলিয়া): ভারত সরকারের জনগণনাতেই বোঝা যায় তারা ক্রমশ কোণঠাসা হয়ে পড়ছে। সেই অবলুপ্ত, বিচ্ছিন্ন এক পাহাড়িয়া জনজাতির সদস্য এবার ভোটের ময়দানে। যা বাংলার নির্বাচনের ইতিহাসে এই প্রথম! আর এর থেকেই বোঝা যায়, আদিবাসী সম্প্রদায়ের পিছিয়ে পড়া ওই ‘বনচারী’ জনজাতি উন্নয়নের হাত ধরেই সমাজের মূল স্রোতে ফেরার চেষ্টা করছে।
পুরুলিয়ার বাঘমুন্ডি ব্লকের অযোধ্যা গ্রাম পঞ্চায়েত। ওই এলাকার প্রায় এক হাজার ফুট উঁচুতে বড়গোড়া। সেই পাহাড়-জঙ্গলে ঘেরা জনপদের বাসিন্দা সুমিত্রা পাহাড়িয়া গ্রাম পঞ্চায়েতের (WB Panchayat Polls 2023) প্রার্থী। অযোধ্যা গ্রাম পঞ্চায়েতের এক নম্বর আসন থেকে তিনি ফরওয়ার্ড ব্লকের সিংহ ছাপে লড়াই করছেন। তার স্ক্রুটিনি নিজহাতে করেছেন বাঘমুন্ডি ব্লকের বিডিও দেবরাজ ঘোষ। তিনি বলেন, “ওই দুর্গম এলাকায় পিছিয়ে পড়া জনজাতির প্রতিনিধি গণতন্ত্রের প্রতি আস্থা রেখে নিজেই নির্বাচনে লড়াই করছেন, এটা উন্নয়নেরই সুফল।” সেই কারণেই সুমিত্রা পাহাড়িয়ার প্রার্থীতে খুশি প্রশাসন। খুশি নির্বাচন কমিশন থেকে রাজনৈতিক দলগুলিও।
ফরওয়ার্ড ব্লকের রাজ্য সম্পাদক মণ্ডলীর সদস্য অসীম সিনহা বলেন, “অযোধ্যা গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রার্থী নির্বাচনে আমরা জনজাতির মানুষজনদেরকে বেশি প্রাধান্য দিয়েছি। কারণ জনজাতি অধ্যুষিত এই এলাকায় ওই সমাজের মানুষই প্রতিনিধিত্ব করুক সেটা মাথায় রেখেই একেবারে বুথ থেকে উঠে আসা নামে আমরা মান্যতা দিই।” এদের জীবন-জীবিকা সবই পাহাড় কেন্দ্রিক। তাই বনজ সম্পদ সংগ্রহ করে যেমন হাটে-বাজারে বিক্রি করেন। তেমনই ফল-মূল, বাঁওলা (আলু জাতীয়), শাক পাতা খেয়ে আজও জীবন ধারণ করেন। ঝাড়খণ্ডের রাজমহল এদের আদি বাসস্থান। ওই রাজ্য, বাংলা-সহ বিহারেও একেবারে স্বল্পসংখ্যক এই জনজাতি রয়েছে। সমাজের মূল স্রোতে যেন অভিযোজনই করতে পারছে না। তাই নগর সভ্যতা থেকে অনেকটাই দূরে। বনের রসদ, বনের উপকরণকেই আঁকড়ে ধরে রয়েছে।
[আরও পড়ুন: মানুষের সঙ্গে রাজনীতির খেলা খেলছেন রাজ্যপাল! ‘পশ্চিমবঙ্গ দিবস’ পালন নিয়ে তোপ মমতার]
সবুজ অরণ্যে ঢাকা একদা মাওবাদী উপদ্রুত বড়গোড়া তাদের জনজাতির প্রার্থীকে ‘সুমিত্রা দি’ হিসাবে জানে। তারা জানে, এই ‘সুমিত্রা দি’র লড়াইয়ের জন্যই প্রশাসনের সহযোগিতায় এই দুর্গম গ্রামে উন্নয়নের আলো পড়তে শুরু করেছে। তাই এই গ্রামের বাসিন্দা নাগর পাহাড়িয়া বলেন, “এতদিন তো অনেককেই ভোট দিয়েছি। কোনও কাজ হয়নি। তাই আমরা গ্রামের সবাই মিলে ওই ‘সুমিত্রা দি’কে গ্রামসভার প্রার্থী করেছি। ভোট আমরা তাকেই দেব।” এই প্রখর দাবদাহেও বড়গোড়া একেবারে সবুজ উপত্যকা। যেন ক্যানভাসে আঁকা ছবি। বাঘমুন্ডির ছাতরাজেরা বা বলরামপুরের তিলাগোড়া থেকে আমকোচা হয়ে পাহাড়ের ওই গ্রাম তিন কিমি। চড়াই-উতরাই দুর্গম পথে বন্যপ্রাণের ভয়ও।
তাই হয়তো আজও উপেক্ষিত। বঞ্চিত। পানীয় জলের সুবিধাটুকুও নেই এই জনপদে। প্রায় তিন কিমি দূরে পাহাড় বেয়ে আসা কুমারী নদীর বাঁকাদবেড়া ঝরনা থেকে তাদের পানীয় জল নিতে হয়। সেই জল থেকে গৃহস্থালী কাজ ও স্নান। কারণ গ্রামে কুয়ো থাকলেও তা শুকিয়ে গিয়েছে। আজও ঢালাই রাস্তা সম্পূর্ণ না হওয়ায় নলকূপের গাড়ি ঢোকে না গাঁয়ে। তাই নেই একটা টিউবওয়েলও। খানিকটা সমতল থেকে গ্রামের মানুষজনই মাথায় করে স্তম্ভ নিয়ে এসে বিদ্যুৎ এসেছে।
প্রাথমিক বিদ্যালয় থাকলেও অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্র নেই। দুয়ারে রেশন থাকলেও তিন কিমি দূরে খানিকটা সমতলে থাকা ছাতরাজেরা থেকে রেশন পণ্য নিয়ে আসতে হয়। এই বঞ্চনার জন্যই লড়াই ‘সুমিত্রা দি’র। তাঁর কথায়, “প্রশাসনকে বলে বলে ঢালাই রাস্তার কাজটা শুরু করিয়েছি। কিন্তু এখনও সম্পূর্ণ হয়নি। ২১০ ফুট হয়েই থমকে গিয়েছে। পানীয় জলের সুবিধা পর্যন্ত গ্রামে নেই। রাস্তা না থাকায় অ্যাম্বুল্যান্স ঢোকে না। রোগীদেরকে খাটিয়ায় শুয়ে কাঁধে করে ডুলির মতো করে নিয়ে যেতে হয়। গ্রামের মানুষ যদি আমাকে জিতিয়ে দেন বড়গোড়ার জীবন আমি বদলাবই।”
[আরও পড়ুন: জেলাপ্রতি ১ কোম্পানি কেন্দ্রীয় বাহিনী চাওয়া হবে, সুপ্রিম রায়ের পর সিদ্ধান্ত কমিশনের]
গ্রামে মোট ১৭ টা ঘর। শতাধিক মানুষের বাস। ভোটার ৫৭। তবে ‘সুমিত্রা দি’ যে সংসদের প্রার্থী সেই এলাকা হল শিমূলবেড়া, ছাতরাজেরা, টুডু পাড়া, মাঝডুঙরি, হরটোকা, কালীঝরনা আর বড়গোড়া। প্রায় ৩৫০ ভোটার। বিরহোড় ও পাহাড়িয়া জনজাতি নিয়ে কাজ করা লোকসংস্কৃতি গবেষক জলধর কর্মকার বলেন, “এই প্রথম পাহাড়িয়া জনজাতির কেউ ভোটে দাঁড়ালেন। এঁদের পাহাড়ের সাথে নাড়ির যোগ। তাই এঁরা পাহাড়িয়া। এঁরা প্রকৃতির পূজারি। ভীষণই কষ্ট সহিষ্ণু জাতি। এখনও জঙ্গল ছেড়ে সম্পূর্ণভাবে বার হয়ে আসতে পারেননি। তবে নির্বাচনে লড়াই করা থেকে পরিষ্কার তাঁরা সচেতন হচ্ছেন। তাই প্রতিবেশী হিসেবে আমরা গর্বিত।”
দেখুন ভিডিও: