দুলাল দে, দোহা: রিচার্লিসনের (Richarlison) নয়নাভিরাম গোল আর নেইমারের চোটের পর ব্রাজিল শিবিরে এখন অদ্ভুত এক বৈপরীত্য চোখে পড়ছে। একদিকে প্রবল সমর্থন বাড়ছে। আরেকদিকে, সিরিয়াস চোট পেয়ে মাঠের বাইরে গিয়েও রক্ষা নেই নেইমারের। সোশ্যাল মিডিয়ায় একের পর এক সমালোচনায় ভরিয়ে দেওয়া হচ্ছে তাঁকে। পরিস্থিতি এখন এতটাই খারাপ যে, নেইমারের সমর্থনে বক্তব্য রাখতে হচ্ছে রাফিনহাকে। ব্রাজিলিয়ান সুপারস্টারের সমর্থনে ব্রাজিলিয়ান সমর্থকদের এবার পালটা দিলেন রাফিনহা। কিন্তু তাতেও কি সমস্যা কমল?
বিশ্বকাপ (FIFA World Cup) অভিযান শুরুর আগে ব্রাজিলিয়ান সমর্থকদের কাছে সেভাবে আলোচনাতেই ছিলেন না রিচার্লিসন। সেভাবে প্রভাব ছিল না সোশ্যাল মিডিয়াতেও। তাঁর ফলোয়ারের সংখ্যা ছিল ‘মাত্র’ ১৩.৩ মিলিয়ন। একটা হাফ ভলিতে ‘সিজার কিক’ পুরো পরিস্থিতিটাই বদলে দিয়েছে রিচার্লিসনের জন্য। সেই রাতে সোশ্যাল মিডিয়ায় রিচার্লিসনের ফলোয়ার বেড়ে গিয়ে দাঁড়ায় প্রায় ৭ মিলিয়নের কাছাকাছি। এদিন দেখা যাচ্ছে, সেই ফলোয়ারের সংখ্যা ২০ মিলিয়নের বেশি !
[আরও পড়ুন: মন মজেছে পরপুরুষে! প্রেমিকের সহযোগিতায় স্বামীকে খুনের পর দেহ লোপাট করল স্ত্রী]
কিন্তু নেইমার (Neymar)? আফসোসের বদলে ব্রাজিলিয়ান সমর্থকরা এখন সমালোচনায় ভরিয়ে দিচ্ছেন তারকা স্ট্রাইকারকে। অনেকে তো বলছেন, ‘‘চোটের জন্য খেলতে না পেরে ঠিকই আছে। ওকে ছাড়াই আমরা ট্রফি জিতেছি। তখনও চোটের জন্য ও বাইরে ছিল।’’ ব্রাজিলিয়ান সংবাদমাধ্যমও ইদানীং এতটাই সমালোচনা করে। কাতার বিশ্বকাপে আসার পর থেকে সাংবাদিকদের থেকে মুখ ঘুরিয়ে রেখেছেন তিনি। তাঁর কোনও বক্তব্য থাকলে, সোশ্যাল মিডিয়াতে তাঁর নিজের পেজেই দিয়ে দেন। ব্রাজিলিয়ান সংবাদমাধ্যম কিংবা সমর্থকদের সঙ্গে এতটা দূরত্ব কীভাবে তৈরি হল নেইমারের? ওগ্লোবোর সাংবাদিক এডমার বলছিলেন, “সাম্প্রতিক ব্রাজিলিয়ানদের কাছে নেইমারের জনপ্রিয়তা কমে যাওয়ার মূল কারণটা কিন্তু রাজনৈতিক।”
মানে? তিনি রাজনীতিতে যোগ দিচ্ছেন নাকি? ব্যাপারটা সেরকম নয়। আবার সেরকমও। এরপর এডমার যা বললেন তা হল, কিছুদিন আগে ব্রাজিলের নির্বাচনে বামপন্থী লুলা দ্য সিলভার (Lula Da Silva) বিরুদ্ধে প্রেসিডেন্ট ইলেকশনে জইর বলসোনারোকে সমর্থন দিয়েছিলেন নেইমার। সমর্থন মানে, বলসোনারোকে সমর্থনে জন্য ব্রাজিলের রাস্তায় মিছিল করেছিলেন নাকি? এডমার হেসে বললেন, “না, না। সেরকম কিছু নয়। সেই সময় দেখা যায়, বলসোনারোর সমর্থনে যে ভিডিও প্রকাশিত হয়েছে, তাতে গলা মেলাচ্ছেন নেইমারও। এখানেই শেষ নয়। বলসোনারোকে সমর্থন জানাতে গিয়ে তিনি বলেছিলেন, এবারের বিশ্বকাপে তাঁর প্রথম গোলটা তিনি বলসোনারোকেই উৎসর্গ করবেন।” তাতে ব্রাজিল জনতার নেইমারের দিক থেকে মুখ ঘুরিয়ে নেওয়ার কারণটা কী? ওগ্লোবোর সাংবাদিক বললেন, “কোভিডের সময় কোনও কাজ করেননি বলসোনারো (Jair Bolsonaro )। উলটে প্রচুর দুর্নীতির অভিযোগ পাওয়া যায়। যা নিয়ে দেশের মানুষ প্রচণ্ড বিরক্ত ছিল। ব্রাজিলিয়ানরা যখন খাদ্য-বস্ত্রর লড়াইয়ে বলসোনারোকে সরিয়ে লুলাকে আনতে চাইছেন, তখন দুর্নীতিগ্রস্ত বলসোনারোকে জেতানোর জন্য নেইমারের পাশে দাঁড়িয়ে যাওয়াকে ভালভাবে নিতে পারেননি ব্রাজিলের জনগণ। রাগটা তখন থেকেই।”
রাগটা এখন এমন পর্যায়ে চলে গিয়েছে, গোড়ালির চোট নিয়ে নেইমার মাঠে বাইরে বসে থাকলেও আর দুঃখিত নন তাঁরা। বাধ্য হয়েই ব্রাজিলের জাতীয় দলে নেইমারের সতীর্থ রাফিনহা (Raphinha) ময়দানে নেমেছেন। সমর্থকদের আচরণে তিনি এতটাই হতাশ হয়েছেন যে এদিন বলেন, “ব্রাজিলে জন্ম নিয়েই ভুল করেছে নেইমার। ওর মতো প্রতিভাকে ব্রাজিল সম্মান জানাতে পারে না!” বিশ্বকাপ না পেলেও, জাতীয় দলের হয়ে গোল সংখ্যায় ব্রাজিলে এই মুহূর্তে পেলের পরেই নেইমারের স্থান। তিনিও ভালভাবেই জানেন, দেশের জনগণের সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের রসায়নটা একমাত্র ঠিক হতে পারে যদি তিনি ব্রাজিলকে বিশ্বকাপ জেতাতে পারেন। কিন্তু চোট পেয়ে এখন আর গ্রুপ পর্যায়ের ম্যাচেই যে খেলতে পারবেন না তিনি। কিন্তু তাঁকে কেন্দ্র করে দেশের মানুষের মনোভাবটা বুঝতে পারছেন তিনি। তাই ব্রাজিলিয়ানদের সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের গভীরতা বোঝানোর জন্য এদিন সংবাদমাধ্যমের কাছে মুখ না খুলে নিজের সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাকাউন্টে লিখেছেন, ‘পরজন্মে আমাকে যদি একটি দেশ বেছে নেওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়, তাহলে আমি ফের ব্রাজিলেই জন্মাতে চাই। এই দেশের জার্সি পরে যে ভালবাসা আর গর্ব অনুভব করি, তা আর কোনও দেশে পাওয়া সম্ভব নয়।’
[আরও পড়ুন: নামতা বলতে না পারার শাস্তি! খুদে পড়ুয়ার হাতে ড্রিলিং মেশিন চালাল শিক্ষিকা]
এখানেই থামেননি তিনি। জানিয়েছেন, কত কঠিন পরিশ্রম করে তিনি আজ এই জায়গায় উঠে এসেছেন। দেশের সমর্থকদের উদ্দেশে তিনি লিখেছেন, ‘আমি জীবনে কোনও কিছু সহজে পাইনি। স্বপ্নপূরণের জন্য সব সময় ছুটতে হয়েছে। এই মুহূর্তে জীবনের অন্যতম কঠিন সময়ের মধ্যে ফের পড়লাম। কারণ, এটা বিশ্বকাপ। আমি আবার চোটের কবলে।’ এবার একদম চোটমুক্ত হয়েই বিশ্বকাপে এসেছিলেন ব্রাজিলিয়ান তারকা। সার্বিয়ার (Serbia) বিরুদ্ধে শুরুটাও করেছিলেন দারুণভাবে। কিন্তু চোটটাই তাঁকে গ্রুপ পর্ব থেকে দূরে সরিয়ে দিল। যদিও তিতে নিশ্চিত নকআউট থেকেই নেইমারকে দলে পাওয়া যাবে। নিজের মতো করে সুস্থ হয়ে ওঠার জন্য লড়াই শুরু করেছেন নেইমারও। যে কারণে তিনি আজ লিখেছেন, ‘আমি ফিরে আসবই। দেশ এবং সতীর্থদের সাহায্য করার জন্য যা কিছু সম্ভব, সব করতে হবে আমায়। এত কষ্ট করার পর শত্রুরা আমাকে হারিয়ে দেবে? এটা কখনও হতে পারে না। আমার বিশ্বাস, আমি ফিরবই।’ নেইমারের বার্তার মধ্য দিয়ে স্পষ্টতই প্রকাশ পাচ্ছে, চোট পাওয়ায় কী অপরিসীম কষ্টের মধ্যে রয়েছেন তিনি। বিশ্বের ফুটবলপ্রেমীরা তাঁর বেদনায় সমব্যথী হলে কী হবে, দেশের সমর্থকদের আচরণে তিনি যে মর্মে মর্মে পুড়ছেন। তাঁর বার্তায় পরিষ্কার হয়ে গিয়েছে। এই নেইমার ফিরবেই ফিরবে। অন্তত ব্রাজিল টিম ম্যানেজমেন্ট তো তাই মনে করছে।