বিশ্বদীপ দে: নয়ের দশকের সেই বিজ্ঞাপনটা মনে পড়ে? শচীন তেণ্ডুলকর (Sachin Tendulkar) নামের মায়াবী এক ক্রিকেটার ব্যাট হাতে বাইশ গজে পৌঁছতেই যেন থমকে যাচ্ছে সময়। থমকে যাচ্ছে চেনা জীবনের গতি। সবাই, সক্কলে চুপ করে বসে পড়ছে টিভির সামনে। সে এক ভিন্ন সময়। ক্রিকেট বিশ্বে তখন শুরু হয়েছে শচীনাব্দ। সেই সময় এক বালকও টিভিতে দেখত রূপকথা সত্যি হতে। অনেক পরে শচীনের বায়োপিকে তাকে বলতেও শোনা গিয়েছে, ‘‘আমি তো বুঝতেই পারতাম না। ব্যাক লিফট ছাড়াই ওভাবে ছয় মেরে দেওয়া!’’ সেই বালক সেদিনের ছোট্ট সিম্বা আজ মুফাসার উত্তরসূরি হিসেবে মসনদে। ক্রিকেট বিশ্ব পেয়ে গিয়েছে তাদের নতুন সম্রাটকে। ‘দ্য লায়ন কিং’ যাঁরা দেখেছেন তাঁরা জানেন এটাই ‘সার্কল অফ লাইফ’। দর্শকাসন থেকে শচীন ওরফে মুফাসা দেখে নিলেন সিম্বার রাজ্যাভিষেক।
এই গ্রহের প্রথম মানুষ হিসেবে একদিনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে সেঞ্চুরির হাফসেঞ্চুরি করেছেন বিরাট কোহলি (Virat Kohli)। আর সেই কীর্তি গড়তে বেছেও নিলেন কোন ম্যাচ! বিশ্বকাপ সেমিফাইনাল। শচীনের অবসরের সময়ই বিরাট তুমুল প্রতিভাবান হিসেবে চিহ্নিত হয়ে গিয়েছেন। কিন্তু ক্রিকেট বিশ্বে প্রতিভার তো কমতি কোনওদিনই ছিল না। বিরাট ছিলেন সেই দলেরই উজ্জ্বল এক মুখ। ২০১৩ সালে হেমন্তের এক বিষণ্ণ দিনে ক্রিকেট মাঠ থেকে চিরবিদায় নিলেন শচীন। আর তার পরবর্তী সময়ে দ্রুত বাকিদের থেকে নিজেকে আলাদা করে নিতে শুরু করলেন বিরাট।
মাঝের বছর তিনেকের ব্যাড প্যাচ সত্ত্বেও তাঁর গোটা কেরিয়ারই চূড়ান্ত ঈর্ষনীয়। আর এই পারফরম্যান্স সহজ ছিল না একেবারেই। নিজেকে ক্রমেই প্রতিজ্ঞার আগুনে সেঁকে নেওয়া। অথচ শুরুর দিনে তিনি যে নেহাতই সিম্বা। এক ছটফটে প্রাণ যুবা। জনপ্রিয় কমেডি শোয়ে এসে অবলীলায় মিমিক্রি করেন অনিল কাপুরের। ওই বয়সি আর পাঁচটা ছেলেছোকরার মতোই লঘু রসিকতা, কথায় কথায় হেসে ওঠা, এর তার লেগপুল করা… এবং অবশ্যই যখন তখন প্রেমে পড়ে যাওয়া। বিভিন্ন সময়ে নানা নারীর সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের গসিপ পুরনো পত্রিকা ঘাঁটলেই পাওয়া যেতে পারে। যেন জীবন নামের দৈব পিকনিকে নিজের মতো করে বেড়াতে বেরনো এক তরুণ। তবে সেই সঙ্গেই প্রতিভার তুমুল বারুদে রানের ঝলমলে রংমশালটা জ্বালিয়ে রাখা। আসলে সকলের অলক্ষে সম্রাট হওয়ার সব উপাদানই তিনি ততদিনে জড়ো করতে শুরু করেছেন।
[আরও পড়ুন: ৭০৪ রানের ম্যাচে ৭ উইকেট শামির, ‘সুযোগের অপেক্ষায় থাকি’, বললেন ম্যাচের সেরা পেসার]
তবে তাঁর প্রক্রিয়া ছিল ভিন্ন। বিভিন্ন সময়ের গ্রেটদের মধ্যে তুলনা এই কারণেই অনর্থক। গাভাস্করের শ্রেষ্ঠত্বের আখ্যানে তাঁর নিজস্ব ফিঙ্গার প্রিন্ট পাওয়া যাবে। অন্যদিকে শচীন। ভারতে অর্থনীতির উদারীকরণ আর তাঁর অভিষেকের মধ্যে মাত্র বছর দুয়েকে ফারাক। কিশোর বয়স থেকেই শচীন সকলের সঙ্গে একটা দূরত্ব বজায় রাখতেন। জনসমক্ষে আড়াল তৈরি করতেন কানে হেডফোন গুঁজে। বিরাটকে এমন বর্ম ধারণ করতে হয়নি। তিনি মনের অন্দরে নিজের মতো করে ঘর বানিয়ে সেখানে বাস করতেন। একদিকে ফিটনেস নিয়ে অসম্ভব খেটেছেন। পাশাপাশি ব্যাটিংকেও অনুশীলনে অনুশীলনে করে তুলেছেন আরও মসৃণ, আরও চকচকে। বহিরঙ্গে দেখে ছটফটে যুবা মনে হলেও ভিতরে ভিতরে প্রতিজ্ঞায় তিনি শুরু থেকেই ছিলেন অনন্য।
২০০৬ সালের ১৮ ডিসেম্বর বাবাকে হারান কোহলি। সেরিব্রাল অ্যাটাকে আচমকাই বাবার চলে যাওয়াটা রাতারাতি বদলে দিয়েছিল বিরাটকে। তাঁর মা পরবর্তী সময়ে বলেছেন, সেই সময় থেকেই ব্যক্তিত্বে বদল আসতে শুরু করেছিল তাঁর। প্রতিটি ক্রিকেট ম্যাচকে আলাদা এক ফোকাসে দেখতেন। তখন তিনি মাত্র ১৮। পরবর্তী সময়ে আশিস নেহরা এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, কখনও তিনি বিরাটকে সময় নষ্ট করতে দেখেননি। মাঠে যতক্ষণ রয়েছেন একশো শতাংশ দিচ্ছেন। আবার মাঠ থেকে বেরোলেই চলে যাচ্ছেন জিমে! অথচ বাইরে থেকে দেখলে মনে হবে নেহাতই হইহই তারুণ্যকে বয়ে নিয়ে চলা এক ‘ছোকরা’। এটাই বিরাটতন্ত্র। জীবনকে সহজে নাও। বাঁচো, বেঁচে থাকো। আর সমস্ত শক্তি উজাড় করে দাও ক্রিকেটে।
ভারতীয় ক্রিকেটে তাঁর আগমনের দিনে অনেকেই ওই বহিরঙ্গ দেখে হয়তো ভেবেছিল, প্রতিভাবান। ভালো একটা কেরিয়ার গড়বে নিশ্চয়ই। কিন্তু একটা সীমার মধ্যেই হয়তো থেকে যাবে কেরিয়ারগ্রাফ। তাঁরা খেয়াল করেননি সামান্যর মধ্যে অসামান্যকে। ২০১১ সালে বিশ্বকাপের ফাইনালে পর পর দুই উইকেট হারানো ভারতকে প্রাথমিক অক্সিজেন জোগাতে গম্ভীরের সঙ্গে জোট বেঁধেছিলেন কোহলি। খুব বেশি রান করেননি। ৩৫ করে প্যাভিলিয়নে ফিরেছিলেন। ম্যাচ শেষ করে আসা তখনও শিখতে বাকি বিরাটের। পরবর্তী সময়ে মনকে বেঁধে রাখা শিখেছেন। ঝকঝকে আলো থেকে সূর্য হয়ে উঠেছেন। কিন্তু মনের ভিতরে ‘সিংহ সাম্রাজ্যে’র উত্তরাধিকার বয়ে চলেছেন বরাবরই।
আসলে তিনি বুঝে গিয়েছিলেন সেই আপ্তবাক্য। মনে করুন ‘লায়ন কিং’। যতদূর সূর্যের আলো পড়ছে সবটা তোমার। ততদূর পর্যন্ত তোমার রাজত্ব। সেঞ্চুরির হাফসেঞ্চুরি আজ হল। কিন্তু এই প্রাপ্তির ব্লু প্রিন্ট তিনি ছকে ফেলেছিলেন বহু আগেই। তবে এটা মানতে হবে ব্যাড প্যাচের দীর্ঘ সময়ে বিরাট যেটা বাড়তি অর্জন করেছেন সেটা হল অপেক্ষা করা, ধৈর্য ধরা। সামনে অন্ধকার পথ। কিন্তু দাঁড়িয়ে থাকলে ওই পথেই সূর্যোদয় হবে। ফিরে পাওয়া যাবে রাজ্যপাট। বুধবারের দুপুর ও বিকেল ওয়াংখেড়ে যে ইতিহাস তৈরি হতে দেখল তা আসলে নিয়তি নির্ধারিতই ছিল। মুফাসার রাজত্ব যে সিম্বারই পাওয়ার কথা।