বিশ্বদীপ দে: অভিশপ্ত। শব্দটি উচ্চারিত হলেই যে ছায়াচ্ছন্ন আতঙ্ক ঘিরে ধরে তার পিছনে থেকে যায় বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দোলাচল। কখনও শোনা যায়, কোনও কোনও দুর্লভ রত্ন কাছে রাখলেই নাকি সর্বনাশ নেমে আসে জীবনে। ওই রত্নখণ্ডের ঔজ্জ্বল্যের মধ্য়েই নাকি মিশে রয়েছে অভিশাপের বিষ। আবার মিশরের মমিদের ঘিরে নানা ধরনের আতঙ্ক কাহিনি তো রয়েছেই। বিশেষ করে তুতেনখামেনের মমি। কিন্তু যদি বলা যায়, পিরামিডের রহস্য কিংবা দুর্মূল্য হিরের ঝলমলানিই কেবল নয়, এক ক্রন্দনরত বালকের মুখই ডেকে আনতে পারে অশনি সংকেত? হ্য়াঁ, ‘দ্য ক্রাইং বয়’ (The crying boy) নামের একটি ছবিকে ঘিরে রয়েছে এমনই ছমছমে মিথ। শুনলে মনে হবে বুঝি হলিউডের হাড়কাঁপানো ছবি! কিন্তু রুপোলি পরদা নয়, এ একেবারে ‘সত্য়ি’ ঘটনা। তেমনই দাবি প্রত্যক্ষদর্শীদের। যদিও সেই দাবিকে নাকচ করা ব্যাখ্যাও রয়েছে। পরে সেই প্রসঙ্গেও আসব আমরা। তার আগে ছুঁয়ে দেখা যাক অভিশপ্ত ছবির গায়ে লেগে থাকা অদ্ভুত এক আগুনের আখ্যানকে।
১৯৮৫ সালের নভেম্বর। ইউরোপের বিভিন্ন জায়গায় বিপুল পরিমাণে ‘দ্য ক্রাইং বয়’ নামের ছবি পোড়ানো শুরু হল সেদিন। যাকে বলে বন ফায়ার। কিন্তু কেন? আসলে ততদিনে ইউরোপ জুড়ে আতঙ্ক ছড়াতে শুরু করেছে ওই ছবি। বলা হচ্ছে, ওই ছবির কপি যদি আপনি শখ করে টাঙিয়ে ফেলেন ঘরের দেওয়ালে, তাহলেই আর রক্ষা নেই। দেখা গিয়েছে বহু বাড়িই আগুনে ভস্মীভূত হয়ে গিয়েছে। অথচ সেই বাড়ির দেওয়ালে টাঙানো ‘দ্য ক্রাইং বয়’ ছবিটির গায়ে আঁচও লাগেনি! যা থেকে পরিষ্কার হয়ে যায়, ওই পরিবারগুলিতে ছবির বালকের আগমন হয়েছিল ‘মৃত্যুদূত’ হয়েই।
[আরও পড়ুন: EXCLUSIVE: ‘হাফ সেঞ্চুরি মার দি ইসনে’, সৌরভের জন্মদিনে কবিতা উপহার জাভেদ আখতারের]
গত শতকের পাঁচের দশক থেকে হু হু করে বাজারে ছড়িয়ে পড়ে ইটালির শিল্পী জিওভানি ব্রাগোলিনের আঁকা ‘দ্য ক্রাইং বয়’। অবশ্য ওই ছবিটি একটি সিরিজের অন্তর্গত। কেবল ওই বালকই নয়, আরও নানা ক্রন্দনরত বালক-বালিকাদের ছবিও এঁকেছিলেন জিওভানি। কিন্তু সব ছবির মধ্যে থেকে আলাদা করে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে ওই ছবিটিই। জানা যায়, পরবর্তী তিন দশকের মধ্যে প্রায় পঞ্চাশ হাজারের বেশি বিক্রি হয়েছিল অভিশপ্ত বালকের পোট্রেট। বিশেষ করে ইংল্যান্ডে ছবিটি তুমুল জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। কিন্তু আটের দশকে এসে শুরু হল গুঞ্জন।
১৯৮৫ সালের সেপ্টেম্বরে ব্রিটিশ ট্যাবলয়েড ‘দ্য সান’-এ প্রকাশিত হয় একটি সংবাদ। তাতে এসেক্সের এক দমকলকর্মীকে দাবি করতে শোনা যায়, আগুনে ছাই হয়ে যাওয়া কয়েকটি বাড়ির ভিতরে তিনি দেখতে পেয়েছেন অবিকৃত ‘দ্য ক্রাইং বয়’ পেন্টিং। এই একটি প্রতিবেদনই যেন কাজ করল স্ফুলিঙ্গের। ‘ভূতুড়ে’ ছবি ঘিরে শোরগোল পড়ে গেল। পরিস্থিতি এমন দাঁড়াল, মাস দুয়েকে মধ্যেই বন ফায়ার করে পুড়িয়ে দেওয়া হল ছবিটির বহু কপি। অভিশাপের হাত থেকে বাঁচতে মরিয়া মানুষদের অসহায়তা ছড়িয়ে পড়ল ইউরোপ জুড়ে।
আসলে এই ধরনের গুঞ্জন একবার ছড়িয়ে পড়লে দাবানলের মতো তা ক্রমেই ছড়িয়ে পড়তে থাকে। যেমন, ‘দ্য হ্যান্ডস রেসিস্ট হিম’। ১৯৭২ সালে বিল স্টোনহ্যামের আঁকা এই ছবিতে এক ছোট্ট ছেলেকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। তার পাশে রয়েছে একটি মেয়ে পুতুল। আর পিছনে একটি দরজা। সেই দরজাটি বাস্তব দুনিয়া ও ফ্যান্টাসির জগতের মাঝের দরজা। পুতুলটি ওই ছেলেটিকে ওই জগতে নিয়ে যেতে এসেছে। এমন সুন্দর একটি ছবিকে ঘিরেও রয়েছে রহস্য। ২০০০ সালে মার্কিন বহুজাগতিক ই-কমার্স সংস্থা ‘ইবে’ নিলামে তোলে ছবিটিকে। দাবি করে, ছবিটি অভিশপ্ত। রাতের অন্ধকারে নাকি ছবি থেকে বেরিয়ে এসে হাঁটতে শুরু করে ছেলেটি। ঘটতে থাকে নানা ভয়ংকর ঘটনা। নেমে আসে দুর্যোগের কালো মেঘ।
[আরও পড়ুন: ‘ভাবলে খারাপ লাগে, বিধানসভায় বামেদের কেউ নেই’, জ্যোতি বসুর জন্মদিনে শ্রদ্ধাজ্ঞাপনের পর আক্ষেপ স্পিকারের]
কিন্তু এই ছবিটিকে ঘিরে জমে থাকা মিথও ‘দ্য ক্রাইং বয়’-এর কাছে নস্য়ি। কিন্তু কে ছিল বাস্তবের এই বালক? তা অবশ্য জানা যায় না। তবে গুঞ্জন, ওই ছেলেটি (কারও মতে তার নাম ছিল ডন বনিলো, কেউ বলে ডায়াব্লো) নাকি স্পেনীয় জিপসি পরিবারের সন্তান। তার বাবা-মা মারা গিয়েছিলেন আগুনে পুড়ে। এরপর যাঁরাই ছোট্ট ছেলেটিকে আশ্রয় দিয়েছেন পরিবারে, আগুনে পুড়ে গিয়েছে তাঁদের ঘরবাড়িও! এমনকী, ছেলেটির ছবি আঁকা হয়েছিল যে স্টুডিওয়, সেটিও নাকি আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে যায়! এমনকী, এমনও মিথ শোনা যায়, ছোট্ট ছেলেটি নিজেও মারা গিয়েছিল আগুনে পুড়ে।
তা বলে সত্য়িই কি ছবিটি ‘অভিশপ্ত’? এমন কি আদৌ হতে পারে? যুক্তিনিষ্ঠ মানুষের পক্ষে এই দাবি হজম করা অসম্ভব। তাঁরা ফুৎকারে উড়িয়ে দেন এমন দাবিকে। তাঁদের প্রতিনিধি হয়ে সবথেকে বড় যুক্তিটি দিয়েছিলেন ব্রিটিশ লেখক ও কৌতুকশিল্পী স্টিভ পান্ট। বিবিসি রেডিওতে তিনি একটি শো করতেন যার নাম ‘পান্ট পিআই’। সেখানে একটি এপিসোডে তিনি আলোচনা করলেন ক্রন্দনরত বালকের মিথ নিয়ে। আর যুক্তি দিলেন, ওই ছবিগুলির প্রিন্টে অগ্নিনির্বাপক পদার্থের সাহায্যে ভার্নিশ করা হয়েছিল। ফলে আগুনের সাধ্য হয়নি সেটিকে স্পর্শ করার। পাশাপাশি আরও একটি যুক্তি হল, ছবিটি যে স্ট্রিংয়ের সাহায্যে দেওয়ালে লাগানো থাকত সম্ভবত আগুনের সংস্পর্শে এসেছিল সেটিই। ফলে সেটি আগুনে পুড়ে দেওয়াল থেকে খসে পড়ার সময় উলটো মুখ করে মাটিতে পড়ত। যার ফলে আগুনে সেটার কোনওরকম ক্ষতি হত না।
পান্টের এমন সব যুক্তিতেও অবশ্য পরিস্থিতি বদলায়নি। বরং ক্রমেই ওই ছবির শরীরে অভিশপ্ততম চিত্রকর্মের জলছাপ আরও জোরাল হয়েছে। ইউরোপ থেকে পৃথিবীর সব মহাদেশেরই বাতাসে ভেসে বেড়িয়েছে ‘দ্য ক্রাইং বয়’কে ঘিরে জমতে থাকা অলৌকিকতার মেঘ। দাউদাউ আগুনের মাঝে অক্ষত এক ছবি থেকে অসহায় মুখের তাকিয়ে থাকা এক বালকের দৃষ্টি অনুসরণ করে শিউরে উঠেছে সারা পৃথিবীর মানুষ।