মণিশংকর চৌধুরি: অসমে বাংলাভাষীদের বিরুদ্ধে ধারাবাহিক উসকানির ফল বৃহস্পতিবারের পাঁচ বাঙালি হত্যাকাণ্ড। উত্তর-পূর্বের পাহাড়ি রাজ্যের বিচ্ছিন্নতাবাদীরা যে ফের আটের দশকের ‘বাঙালি খেদাও’ কর্মসূচি শুরু করতে চলেছে, আবারও যে রক্ত ঝরতে চলেছে তার ইঙ্গিত মিলছিল জাতীয় নাগরিকপঞ্জির তালিকা প্রকাশের পর থেকেই। একাধিক জনসভায়, টক শোয়ে বাঙালিদের হুমকি দেওয়া শুরু করেছিলেন আলোচনাপন্থী উলফা জঙ্গিগোষ্ঠীর নেতারা। এমনকী উলফাদের এই বাঙালি নিধনের পরিকল্পনায় মদত ছিল মাওবাদী, মৌলবাদীদেরও। সূত্রের দাবি, তিনসুকিয়া গণহত্যার তদন্তে নেমে এমনই চাঞ্চল্যকর তথ্য হাতে পেয়েছেন গোয়েন্দারা। উসকানির কথা স্বীকার করেছেন কৃষক নেতা অখিল গগৈও। কিন্তু সব দেখেশুনেও চুপ থেকেছে বিজেপি শাসিত অসমের সোনওয়াল সরকার। কোনও পদক্ষেপ করেনি পুলিশও। সেই কারণেই তিনসুকিয়ার নৃশংস হত্যাকাণ্ডের মতো ঘটনা ঘটেছে।
[অসমের পাশে বাংলা, তিনসুকিয়া গণহত্যার প্রতিবাদে রাজ্যজুড়ে মিছিল তৃণমূলের]
যদিও শুক্রবার এই হামলার দায় অস্বীকার করেছে উলফা (পরেশপন্থী) গোষ্ঠী। অসমের বিজেপি বিধায়ক শিলাদিত্য দেবের দাবি, এই ঘটনার নেপথ্যে রয়েছে আলোচনাপন্থী উলফা, মাওবাদী ও বাংলাদেশি মৌলবাদীদের হাত। হিন্দু বাঙালিদের ঘরছাড়া করতেই এই হামলা। বিদ্বেষ ছড়ালেও উলফা নেতাদের গ্রেপ্তার কেন করা হল না, সেই প্রশ্নই তুলেছেন তিনি। তাঁর আরও অভিযোগ, অসমিয়া ও বাঙালিদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করতেই এই চক্রান্ত করছে আইএসআই।
বৃহস্পতিবার রাতে তিনসুকিয়া জেলার ধোলা এলাকার খেরবাড়ি গ্রামের পাঁচজন বাঙালি যুবককে হত্যার প্রতিবাদে শুক্রবার তিনসুকিয়ায় ১২ ঘণ্টা বনধের ডাক দিয়েছে অসম বাঙালি যুব ছাত্র ফেডারেশন। বনধের প্রভাবে এদিন কার্যত স্তব্ধ হয়ে পড়ে তিনসুকিয়ার জনজীবন। তবে বনধকে ঘিরে কোথাও কোনও অশান্তি বা হিংসার খবর নেই। তবে এদিনও জেলাজুড়ে তীব্র উত্তেজনা রয়েছে। পাশাপাশি পাঁচজন বাঙালি যুবককে হত্যার প্রতিবাদে শনিবার থেকে অসম বনধের ডাক দিয়েছে ১৪টি সংগঠন। গত কয়েকদিনে অসমের বাঙালিদের বিরুদ্ধে একাধিকবার হুমকি দেন আলোচনাপন্থী বা অরবিন্দ রাজখোয়া গোষ্ঠীর নেতারা। এঁদের মধ্যে রয়েছেন, প্রবাল নেওগ, জিতেন শইকিয়া ও মৃণাল হাজারিকা। পাশাপাশি বাঙালিদের উদ্দেশে বিষ উগরেছেন ‘কৃষক মুক্তি সংগ্রাম সমিতি’র প্রধান অখিল গগৈ। গগৈর সঙ্গে মাওবাদীদের আঁতাত রয়েছে বলে অভিযোগ।
বৃহস্পতিবার রাতে শদিয়ায় একটি দোকানে বসেছিলেন কয়েকজন যুবক। সে সময় সেখানে হাজির হয় সেনার পোশাক পরা কয়েকজন অস্ত্রধারী যুবক। তারা জোর করে ৬ জনকে তুলে নিয়ে যায় ব্রহ্মপুত্রের চরে। ব্রহ্মপুত্রের ধোলা শদিয়া সেতুর কাছে ব্রহ্মপুত্র নদের চরে দাঁড় করিয়ে তাদের পয়েন্ট ব্ল্যাঙ্ক রেঞ্জ থেকে গুলি করে খুন করা হয়। জাতীয় নাগরিকপঞ্জি বা এনআরসি নিয়ে এমনিতেই মাস দু’য়েক ধরে অসমে চরম উত্তজেনা রয়েছে। মানুষের মনে চেপে বসেছে চাপা আতঙ্ক। এরই মধ্যে বৃহস্পতিবার রাতে যেভাবে পাঁচ বাঙালি যুবককে নৃশংসভাবে খুন করা হয়েছে তাতে সেই উত্তেজনা ও আতঙ্ক বহুগুণ বেড়ে গিয়েছে। তিনসুকিয়ায় এদিন একেবারে স্তব্ধ ছিল। জায়গায় জায়গায় চলছে বিক্ষোভ। কোনও যানবাহন চলাচল করেনি। দোকানপাট, বাজার সব বন্ধ। একাধিক জায়গায় এদিন বিক্ষোভকারীরা পথ অবরোধ করেন। কোথাও টায়ার জ্বালিয়ে, কোথাও গাছের গুঁড়ি ফেলে রাস্তা অবরোধ হয়। বৃহস্পতিবারের ঘটনার জন্য স্থানীয় মানুষ পুলিশের দিকে আঙুল তুলেছে। বাসিন্দাদের অভিযোগ, রাতে পুলিশকে খবর দেওয়া হলেও থানা থেকে কেউ আসেনি। সময়মতো পুলিশ এলে হয়তো এই গণহত্যা ঠেকানো যেত। এই গণহত্যা নিয়ে এদিন অবশ্য সক্রিয় হয়ে উঠেছে রাজ্য প্রশাসন।
সারা অসম বাঙালি যুব ছাত্র ফেডারেশনের সভাপতি দীপক দে বলেন, “এই ঘটনার জন্য অসম সরকারই দায়ী। ঘটনার প্রতিবাদে শনিবার রাজ্যজুড়ে ২৪ ঘণ্টা বন্ধ পালন করা হবে। রাজ্যে রাষ্ট্রপতি শাসনের দাবিও জানাব আমরা।” দুষ্কৃতীরা যাতে পালিয়ে যেতে না পারে সে জন্য অরুণাচল-সহ সব সীমান্ত সিল করে দেওয়া হয়েছে। রাস্তায় নামানো হয়েছে সেনা। গত সপ্তাহে গায়ক শান্তনু মুখোপাধ্যায় একটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অংশ নিতে অসমে গিয়েছিলেন। মঞ্চে তিনি যখন অনুষ্ঠান করছিলেন সে সময় তাঁকে লক্ষ্য করে পাথর ছোঁড়া হয়েছিল।
[অসমে ৫ বাঙালি যুবককে গুলি করে খুন, তীব্র ক্ষোভ মমতার]
The post তিনসুকিয়া গণহত্যার নেপথ্যে মাওবাদী-উলফা-মৌলবাদী আঁতাঁত! appeared first on Sangbad Pratidin.