পুজো প্রায় এসেই গেল৷ পাড়ায় পাড়ায় পুজোর বাদ্যি বেজে গিয়েছে৷ সেরা পুজোর লড়াইয়ে এ বলে আমায় দেখ তো ও বলে আমায়৷ এমনই কিছু বাছাই করা সেরা পুজোর প্রস্তুতির সুলুকসন্ধান নিয়ে হাজির sangbadpratidin.in৷ আজ পড়ুন বেহালা নূতন সংঘের পুজো প্রস্তুতি৷
সুচেতা সেনগুপ্ত: পুরুষের কল্পনায় প্রকৃতি সৃষ্টি, নাকি প্রকৃতির গর্ভে পুরুষের জন্ম? এই জিজ্ঞাসা চিরন্তন। কেউ মানবপ্রেমে, কেউ ঈশ্বরপ্রেমে, কেউ বা শিল্পসৃষ্টি দিয়ে খুঁজে চলেছেন উত্তর। কিন্তু সত্যিই কি খুঁজছেন? নাকি পুরুষ আর প্রকৃতির চিরন্তন সম্পর্কের রসায়ন উদঘাটনে ততটা আগ্রহ আর নেই? মনের দরজায় করাঘাত না করে বহির্মুখীনতাই আজকের নিত্যকার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। তো এবারের শারদোৎসবে অন্তরের এই গভীর প্রেমকেই জাগ্রত করতে প্রস্তুত হচ্ছে বেহালা নূতন সংঘ। তাদের এবছরের থিম – অন্তর্যাত্রা : ইনার জার্নি। শিল্পী সনাতন দিন্দার ভাবনায় সেজে ওঠা মণ্ডপ দেখে এলাম আমরা।
[আরও পড়ুন: মনেপ্রাণে বাঙালি হলে পুজোয় কিছুটা সময় কাটাতেই হবে বেহালার এই মণ্ডপে]
‘অতল, তোমার সাক্ষাৎ পেয়ে চিনতে পারিনি বলে/হৃদি ভেসে গেল অলকানন্দা জলে’। সত্যি সত্যিই যদি অন্তরে ডুব দেওয়া যায়, কবি জয় গোস্বামীর এই চরণ উচ্চারণ করতেই হয়। শিল্পীমন নিজের অতলে নিমজ্জিত হয়ে নতুন কিছু আবিষ্কারের আনন্দ তাই উৎসর্গ করেন কবিকে। বেহালা নূতন সংঘের থিম ভাবনার নেপথ্যে জয় গোস্বামীর এই কবিতাই অনুপ্রেরণা শিল্পী সনাতন দিন্দার। কীভাবে? সেই ব্যখ্যা তিনি খুলে বললেন আমাদের। সনাতন দিন্দার কথায়, ‘অলকানন্দা জলে – এই কবিতাটি সহজ নয়। অনেক জটিল, অনেক গভীর কথা বলে। সেই কবে থেকে এই কবিতার সঙ্গে আমার একটি সম্পর্ক তৈরি হয়েছে। এখন একটা অদ্ভুত সময় চলছে। যখন প্রেমিক-প্রেমিকা পাশাপাশি বসে হোয়াটসঅ্যাপে কথা বলছে। হারিয়ে যাচ্ছে প্রকৃত মানবপ্রেম। এই মণ্ডপে আমি একটা ছোট নদী তৈরি করতে চেয়েছি, যা আসলে প্রেমের নদী। এই নদী ঘিরে থাকবে আমার প্রিয় কবি জয় গোস্বামীর কবিতা, তাতে সুর দেওয়া গান। জয়ের নিজকণ্ঠে কবিতাপাঠ এবং তার পাশাপাশি এনিয়ে গান গাইবেন প্রিয় শিল্পী সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়। সবমিলিয়ে, এক অন্যরকম আবহ। এটা যত না দেখার, তার চেয়ে ঢের বেশি অনুভব করার। কারণ, প্রেম তো অন্তিমত গভীর অনুভূতিরই বিষয়।’ আজকের জেটযুগে বদলে যাওয়া প্রেমের ধরন মণ্ডপের ভিতরে একেবারে অচল। বেহালা নূতন সংঘের ভিতরে প্রবেশ মানে অন্তর্যাত্রা। এখানে বইবে প্রেমের চিরন্তন নদী।
শিল্পীর অভিনব ভাবনা অনুযায়ী গড়ে উঠছেন এখানকার প্রতিমাও। এমনকী তাঁর গর্ভগৃহটিও। নারীর শ্রোণিদেশের আদলে তৈরি এই অধিষ্ঠানক্ষেত্র। এই গর্ভই আসলে বিশ্বের জন্মদাত্রী। প্রথমে মূর্তির দিকে তাকালে কিছুটা হোঁচট খেতে পারেন। কিন্তু তা কাটিয়ে ভালভাবে দেখলে বোঝা যাবে, এই মূর্তি আসলে মিলনের। পুরুষ আর নারীর মিলন। তাই মূর্তিটি আলিঙ্গনাবদ্ধ হরপার্বতীর। শিল্পী সনাতন দিন্দার দৃষ্টিতে যাঁকে পুজো করা আসলে ভালবাসার কাছেই আহুতি দেওয়া, আত্মসমর্পণ করা। তাঁর কথায়, ‘আমরা জানি ব্রহ্মাণ্ড থেকে জ্যোতিষ্কমণ্ডলের সৃষ্টি এবং সেখান থেকেই বিশ্বের উৎপত্তি। কিন্তু বিজ্ঞান তা বলে না। তার তত্ব ভিন্ন। এই দুয়ের দ্বন্দ্ব থাকবেই। কিন্তু এখানে দেখানোর চেষ্টা করেছি যে নারীরূপী প্রকৃতির গর্ভ থেকেই সমস্ত কিছুর জন্ম।’
এমন গভীর একটা ভাবনাকে বাস্তবায়িত করার উপকরণ অবশ্য সামান্যই। হাতের কাছে পাওয়া কাপড়, বাঁশ, মাটি ইত্যাদি। বেহালা নূতন সংঘের উদ্যোক্তারা জানাচ্ছেন, যে পুজোর সঙ্গে সনাতন দিন্দার মতো শিল্পী জড়িয়ে থাকেন, সেখানে আর চিন্তার কিছু থাকে না। তাই চলতি বছর আর্থিক মন্দা তাঁদের কিছুটা চিন্তিত করলেও, শেষপর্যন্ত তাঁরা একেবারে নিশ্চিন্ত। তাহলে কি থিম, প্রতিমা, মণ্ডপসজ্জার অভিনবত্বে এবছর পুরস্কারের ঝুলি উপচে পড়বে বেহালার এই পুজো আয়োজকদের ঘরে? এই প্রশ্নের সরাসরি উত্তর কিছুটা এড়িয়েই গেলেন উদ্যোক্তারা। জানালেন, পুরস্কার জয় বড় কথা নয়। মানুষের মন জয়ই তাঁদের মূল লক্ষ্য। সেই লক্ষ্যেই এগিয়ে চলেছে এখানকার সাজসজ্জা।
[আরও পড়ুন: অজান্তে জল অপচয় নয়, পুজোয় সংরক্ষণের বার্তা দিচ্ছে আহিরীটোলা সর্বজনীন]
‘পড়ে হাত থেকে লিপিখানি/ ভেসে যাচ্ছিল – ভেসে তো যেতই, মনে না করিয়ে দিলে;’ – সবশেষে শিল্পী সনাতন দিন্দা অলকানন্দার জলে ভেসে যাওয়া কবিহৃদয়ের কথাখানিই মনে করিয়ে দিতে চান। মনে করিয়ে দিতে চান প্রেমের গভীর রূপ, প্রকৃত স্বরূপ। তাতেই যে প্রকৃত আনন্দ। শিল্পী নিজেও বলছেন, গত ২০ বছরের শিল্পীজীবনে এটাই তাঁর সেরা কাজ। আর সেই সৃষ্টি দেখতে হাজার হাজার মানুষের পা পড়বে বেহালা নূতন সংঘে, তা এখনই বলা যায়।
দেখুন ভিডিও:
The post এবার নারী-পুরুষের চিরন্তন প্রেমের নদীতে অন্তর্যাত্রার গল্প বেহালা নূতন সংঘের পুজোয় appeared first on Sangbad Pratidin.
