স্বল্প পরিচিত। কিন্তু মাহাত্ম্যে কম নয়। শহর কলকাতার তেমনই ছয় কালীবাড়ির সন্ধান দিলেন সোমনাথ লাহা।
কৃপাময়ী কালী, বরানগর:
মন্দিরটির পরিচিতি জয়রাম মিত্র কালীবাড়ি নামে৷ ১৮৫০ খ্রিস্টাব্দে দেবীস্থানটি প্রতিষ্ঠা করেন শোভাবাজারের জয়রাম মিত্র৷ তিনি ছিলেন বরানগরের সুপ্রসিদ্ধ জমিদার৷ ভাগীরথীর পূর্বকূলেই তাঁর বিশাল ঠাকুরবাড়ি৷ সেখানেই একটি অংশে নির্মিত এই সুন্দর দক্ষিণমুখী নবরত্ন মন্দির ও বারোটি শিবমন্দির, শিবমন্দিরগুলি নির্মিত হয়েছে বাংলার আটচালা রীতি অনুযায়ী৷ মন্দিরগুলির পরেই রয়েছে সারি দেওয়া তুলসীমঞ্চ৷ পাথরে বাঁধানো মন্দিরগাত্রের মিনারের কাজ দর্শনার্থীর মন কাড়বেই৷ সুন্দর পরিপাটি করে সাজানো গর্ভমন্দির৷ গঙ্গায় ভেসে আসা শিলাখণ্ড দিয়ে শ্বেতপাথরের বেদির উপর কাঠের সিংহাসনে প্রতিষ্ঠিত দেবী কৃপাময়ী কালিকার আড়াই ফুট উচ্চতার বিগ্রহ৷ দেবীর মুখমণ্ডল প্রসন্ন, হাসিতে ভরা৷ আজানুলম্বিত তরঙ্গায়িত কেশদাম পিঠ ছাড়িয়ে নিচের দিকে নেমেছে৷ প্রায় ১৬০ বছর ধরে দেবীর নিত্যভোগ আরতি চলে আসছে৷ অতীতে পশুবলি দেওয়ার প্রথা থাকলেও বর্তমানে তা আর নেই৷ প্রতিদিনই মন্দিরে ভিড় করেন আর্তজন-সহ নিসর্গপ্রেমী মানুষ৷ সিঁথির মোড় থেকে অটো ধরে কুঠিঘাট পৌঁছে সেখান থেকে সামান্য গেলেই মিলবে কৃপাময়ী কালীর মন্দির৷
সেবাপীঠ অভয়া কালী, রবীন্দ্র সরোবর:
রবীন্দ্র সরোবর মেট্রো স্টেশন থেকে হাঁটা পথেই চারু অ্যাভিনিউয়ে এই মাতৃমন্দির৷ সেবাপীঠ মাতৃমন্দিরে কালীস্বরূপা মা অভয়ার শ্রীমূর্তির সঙ্গে রয়েছেন স্বয়ং ত্রিনাথেশ্বর৷ শ্রীমূর্তিতে ‘কালীই ব্রহ্ম, ব্রহ্মই কালী’ রূপটির পূর্ণ প্রকাশ ঘটেছে৷ ১৯৮০-তে বাবুজির (স্বামী বেদানন্দ) মনের ইচ্ছায় মা ভগবতী কালীর এই মন্দির কুটিরটি স্থাপিত হয়৷ প্রতিষ্ঠা হয় দেবী কালিকার শ্রীমূর্তিটি৷ নাম হয় ‘সেবাপীঠ মাতৃমন্দির’৷ আরাধ্যা দেবী এখানে পূজিতা মা অভয়া রূপে৷ এই কুটিরাশ্রমে তিনি দেবীরূপে নন, মা রূপে পূজিতা৷ অনাড়ম্বরভাবে ভক্ত সন্তানের দ্বারা মায়ের নিত্যপূজা হয়৷ মন চাইলে এখানে এসে স্বহস্তে মাতৃসেবায় নিয়োজিত হতে পারেন৷ অতি নিয়মনীতির ঘেরাটোপে এই মন্দিরে মা পূজিতা হতে আগ্রহী নন৷ সেজন্যই প্রতি বছর কালীপুজোয় জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলে মায়ের পায়ে পুষ্পাঞ্জলি দেন এখানে৷ এবারও রাত আটটায় পুষ্পাঞ্জলি৷
অষ্টাদশভুজা কালী, মুক্তারামবাবু স্ট্রিট:
মন্দিরটির অবস্থান ১৪০ মুক্তারামবাবু স্ট্রিটে৷ শোনা যায় প্রায় ১০৫ বছর আগে কালীসাধক আশুতোষ মুখোপাধ্যায় নেপালের এক গুহার মধ্যে তন্ত্রসাধনার সময় অষ্টাদশভুজা কালীর এক প্রস্তরময় ছোট কালীমূর্তি পান৷ কলকাতায় এসে ১৪০ মুক্তারামবাবু স্ট্রিটের এই বাড়িতেই দেবীর বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা করেন৷ শুরু করেন নিত্যপূজা৷ পরবর্তীকালে তাঁর পুত্র কালীপ্রসাদ ১৮ মণ অষ্টধাতু দিয়ে সাধকপ্রাপ্ত মূর্তির অবিকল প্রতিরূপ তৈরি করেন৷ পাঁচ ফুট উঁচু দেবী কালিকা শিবের উপর পদ্মাসনে উপবিষ্টা৷ দেবীর আঠারো হাতে নানা প্রহরণ৷ রথের দিন মন্দিরের প্রতিষ্ঠা হয়েছিল বলে ওই দিনটি প্রতিবছর বিশেষভাবে পালিত হয়৷ মন্দিরে কোনও পশুবলি হয় না৷ এই মন্দিরে আসতে হলে নামতে হবে মহাজাতি সদন হলের স্টপেজে আর মেট্রোয় এলে মহাত্মা গান্ধী রোড স্টেশনে৷
রঘু ডাকাতের কালী, মনোহরপুকুর:
দেবী পরিচিতা রঘু ডাকাতের প্রতিষ্ঠিত কালী নামেই৷ দক্ষিণ কলকাতার গড়িয়াহাট অঞ্চলে ২৯ নম্বর পূর্ণদাস রোডে এই দেবীর অবস্থান৷ এই রাস্তার বিপরীত দিকের মনোহরপুকুর রোডটি নাকি মনোহর ডাকাতের স্মরণে৷ চূড়াহীন মন্দিরটি বাংলার চাঁদনি মন্দিরের মতো সমতল ছাদবিশিষ্ট৷ বিভিন্ন ধরনের গাছগাছালিতে ভরা আড়ম্বরহীন মন্দিরটির পরিবেশ খুবই মনোরম৷ এই দেবীস্থানটির বয়স ১১২ বছর৷ গর্ভমন্দিরে দেবী কালিকা প্রতিষ্ঠিত একটি পিতলের সিংহাসনে৷ প্রস্তরময়ী দেবীমূর্তিটি ছোট হলেও আকর্ষণীয়৷ মাতৃমূর্তির গলায় রক্তজবার বহু মালিকার সঙ্গে শোভা পাচ্ছে কয়েক ছড়া সোনার হার৷ দেবীর পদতলে আসীন মহাকালরূপী মহাদেব৷ কথিত আছে মন্দিরে একসময় নরবলি দেওয়া হত৷ তবে বর্তমানে কোনও জীব বলি দেওয়া হয় না৷ প্রতিদিনই বহু দর্শনার্থী-ভক্ত মায়ের কাছে আসেন প্রণাম করার পাশাপাশি নিজেদের মনস্কামনা নিয়ে৷
রাজরাজেশ্বরী কালীবাড়ি, বাঙ্গুর অ্যাভেনিউ:
বেলগাছিয়া মেট্রো স্টেশন থেকে বেরিয়ে অটোয় বাঙ্গুর অ্যাভিনিউ মোড়ে দমদম পার্কে কৃষ্ণপুর উপনগরে এই কালীবাড়ি৷ এই মন্দিরটি স্থাপিত হয়েছে ১৯৬১ সালে৷ মন্দির পরিচালনার দায়িত্বে রয়েছে শ্রীশ্রী করুণাময়ী রাজরাজেশ্বরী কালীভক্ত নামক ট্রাস্ট৷ মাতৃ বিগ্রহ কষ্টিপাথরের নির্মিত হলেও শবরূপী শিব কষ্টিপাথরের নয়৷ এক ফুট উঁচু শ্বেতপাথরের বেদির উপর চার ফুট উচ্চতার চতুর্ভুজা মা খড়্গ, মুণ্ডমালা ও বরাভয় নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছেন মহাদেবের বক্ষের উপর৷ বসন পরিহিত মাতৃমূর্তির গলায় রয়েছে সোনার চন্দ্রহার৷ মাথায় সোনার মুকুট৷ মাতৃমূর্তির বাঁদিকে একটি সিংহাসনে রয়েছে বাঁশী হাতে দণ্ডায়মান রাধা-কৃষ্ণের যুগলমূর্তি৷ মাকালীর মাথার উপর শ্রীরামকৃষ্ণ ও সারদার বিগ্রহ৷ আর রাধাকৃষ্ণের উপর রয়েছে শ্রীজগন্নাথ, সুভদ্রা ও বলরামের বিগ্রহ৷
সিদ্ধেশ্বরী কালীমন্দির, টালিগঞ্জ:
টালিগঞ্জ মেট্রো স্টেশন থেকে আদিগঙ্গা পেরিয়ে সিরিটি শ্মশানের দিকে যেতে পাঁচ মিনিটের হাঁটা পথে এই মন্দিরটির অবস্থান৷ বাসস্টপের নাম করুণাময়ী কালীবাড়ি৷ বাস, অটো কিংবা ট্যাক্সি থেকে নেমেই বিপরীত দিকে চোখ ফেরালেই দেখতে পাওয়া যায় মায়ের অপরূপ ছোট মন্দিরটি৷ ছোট মন্দিরের প্রবেশদ্বার৷ মন্দিরের পিছন দিয়ে বয়ে চলেছে আদিগঙ্গার ক্ষীণ ধারা৷ মন্দির অঙ্গনবেষ্টিত বটগাছের ছায়ায়৷ মন্দিরের ছোট গর্ভগৃহে গোলাপি রঙের পাথরের সিংহাসনে অধিষ্ঠিত দেবী দক্ষিণাকালী৷ দেবী কালিকার মূর্তিটির উচ্চতা তিন ফুট৷ মাথায় রুপোর চূড়া, পরনে বেনারসি শাড়ি৷ হাতে-গলায় রয়েছে বিভিন্ন স্বর্ণালঙ্কার-সহ প্রহরণ৷ দেবীর বাম হস্তে খড়্গ আর মুণ্ডমালা এবং ডান হাতে অভয় ও বরাভয় মুদ্রা৷ টানা টানা দু’টি চোখ৷ নাকে সোনার বড় নথ৷ লোলজিহ্বা থাকলেও মায়ের মুখটি লালিত্যে ভরা৷ বহু রক্তজবার মালায় ঢাকা মায়ের বক্ষদেশ৷ পদতলে মহাকালরূপী শিব আর দু’পাশে ঠাকুর রামকৃষ্ণ ও মা সারদা৷ কথিত আছে আগে মা ডাকাতদের দ্বারা পূজিত হতেন৷ এমনকী ডাকাতরা ডাকাতি করতে যাওয়ার আগে মায়ের কাছে নরবলি দিত৷ পরবর্তী সময়ে নরবলির অভাবে ছাগবলি হত৷ এখন আর বলি দেওয়া হয় না৷ মাকে নিত্য অন্নভোগ দেওয়া হয়৷ প্রতি অমাবস্যা ও কার্তিক মাসের কালীপুজোয় মায়ের বিশেষ পুজো করা হয়৷ সঙ্গে হোমযজ্ঞও হয়৷
The post এই ছয় কালীবাড়ি পরিক্রমায় সার্থক হোক মনস্কামনা appeared first on Sangbad Pratidin.