খোদ প্রধানমন্ত্রীর নির্বাচন কেন্দ্র বারাণসীর কাশী বিশ্বনাথ মন্দিরের লাগোয়া জ্ঞানবাপী মসজিদের ‘প্রকৃত চরিত্র’ অনুসন্ধানে স্থানীয় আদালতের নির্দেশ মেনে ভিডিও সমীক্ষার কাজ শেষ হয়েছে। সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি এন ভি রামানা ‘মামলার বিন্দুবিসর্গ জানা না থাকায়’ মসজিদ চত্বরের ভিডিও সমীক্ষার নির্দেশের বিরুদ্ধে স্থগিতাদেশ দিতে রাজি হননি। শেষ পর্যন্ত এই বিতর্ক কোন দিকে মোড় নেবে, কেউ জানে না। লিখছেন সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়
অযোধ্যার পর আসর সরগরম করে তুলেছে আরও এক মন্দির-মসজিদ মামলা। যদিও চরিত্র কিছুটা ভিন্ন। বিশ্বাস, ইতিহাস, লোকগাথা, পরম্পরার ধারাবাহিকতা, সত্য প্রতিষ্ঠার দাবি ও মামলার মধ্যে প্রাচীরের মতো মাথা উঁচিয়ে রয়েছে এক আইন, মাত্র ২১ বছর আগে সাম্প্রদায়িকতার বিষ-ছোবল থেকে দেশকে বাঁচাতে যা তৈরি করা হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত কী করবে সুপ্রিম কোর্ট? মূল্যবৃদ্ধি, মুদ্রাস্ফীতি, বেকারত্ব ও তুমুল সার্বিক অস্থিরতার মাঝে গোটা দেশের নজর আচমকাই ঘুরে গিয়েছে সেইদিকে।
মঙ্গলবার বিকেলে এই মামলার প্রথম শুনানির দিন সুপ্রিম কোর্ট যে সিদ্ধান্তের কথা জানাল, পত্রপাঠ বিদায়ের মতো তাতে বিতর্কের অবসান ঘটল না। বৃহস্পতিবার আরও একবার শুনানির দিন ধার্য হয়েছে। কথায় বলে, আইন-আদালতের ছ্যাঁকা লাগলে বিস্তর হ্যাপা পোহাতে হয়। শেষ পর্যন্ত তাই এই বিতর্ক কোন দিকে মোড় নেবে, কেউ জানে না, যেহেতু, এই মামলায় রাষ্ট্রপক্ষ না হলেও রাষ্ট্রীয় ধ্যান-ধারণা ইদানীং কোন খাতে বইছে, তা সহজে বোধগম্য। কাজেই, অযোধ্যার মতো কাশী বিশ্বনাথ-জ্ঞানবাপী বিতর্কও দীর্ঘ প্রলম্বিত হলে বিস্ময়ের কারণ নেই।
[আরও পড়ুন: রাজনীতির ময়দান অচেনা, সৌরভ কি সঠিক সময়ের অপেক্ষায়?]
নতুন এই মামলার ভরকেন্দ্র বারাণসী। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির নির্বাচন কেন্দ্র। সেই বারাণসী, যেখানে অবস্থিত কাশী বিশ্বনাথ মন্দির ও তার লাগোয়া জ্ঞানবাপী মসজিদ। মামলা, জ্ঞানবাপী মসজিদে বছরভর পুজো করার অধিকারের দাবিতে। সেই দাবি মেনে বারাণসীর সিভিল কোর্ট রাতারাতি যেসব নির্দেশ জারি করেছে, সেগুলোর অধিকাংশ স্থগিত রাখা হলেও বিতর্কটি অঙ্কুরেই বিনষ্ট হল না। সেই সঙ্গে ডেমোক্লিসের খড়্গের মতো ঝুলে রইল আশঙ্কাও। ঘরপোড়া গরুদের হাল এমনই হয়। বিশেষ করে অযোধ্যার উদাহরণ যখন টাটকা।
অযোধ্যা আন্দোলনের সময় যে-স্লোগান দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়েছিল, গর্বিত ‘হিন্দু’ জনতা বুক বাজিয়ে বলত, ‘ইয়ে তো সির্ফ ঝাঁকি হ্যায়, কাশী মথুরা বাকি হ্যায়’, সেটাই হঠাৎ উত্তরপ্রদেশের আঙিনা পেরিয়ে গোটা ভারতে জগঝম্প শুরু করেছে। খোদ প্রধানমন্ত্রীর নির্বাচন কেন্দ্র বারাণসীর কাশী বিশ্বনাথ মন্দিরের লাগোয়া জ্ঞানবাপী মসজিদের ‘প্রকৃত চরিত্র’ অনুসন্ধানে স্থানীয় আদালতের নির্দেশ মেনে ভিডিও সমীক্ষার কাজ শেষ হয়েছে। সিভিল কোর্টের নির্দেশ রুখতে অস্বীকার করেছে এলাহাবাদ হাই কোর্ট। মসজিদ কর্তৃপক্ষ দ্বারস্থ হয়েছিল সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি এন ভি রামানার এজলাসে। মামলাটি গ্রহণের পর বিচারপতি ডি ওয়াই চন্দ্রচূড় ও বিচারপতি পি এস নরসিংহর এজলাসে তা পাঠানো হয়েছে। কিন্তু ‘মামলার বিন্দুবিসর্গ জানা না থাকায়’ প্রধান বিচারপতি মসজিদ চত্বরের ভিডিও সমীক্ষার নির্দেশের বিরুদ্ধে স্থগিতাদেশ দিতে রাজি হননি। ফলে মহা ধুমধামের সঙ্গে সাঙ্গ হয়েছে সেই পর্ব। বারাণসী এই মুহূর্তে তপ্ত, প্রকৃতির রোষানল ও উগ্র হিন্দুত্ববাদী চেতনার দৌলতে। তাল ঠুকতে শুরু করেছে মথুরাও। কোমর কষে নামতে চলেছে কট্টর হিন্দুত্ববাদী জনতা। শাহি ইদগা মসজিদের সমীক্ষা চায় তারাও।
অযোধ্যার সঙ্গে কাশী মামলার চরিত্রগত মিল থাকলেও একটা বড় অমিলও রয়েছে। অযোধ্যার দাবি শুরু থেকেই ছিল ‘মন্দির ওহি বানায়েঙ্গে’-র, যেখানে মসজিদের কোনও অস্তিত্বই থাকবে না। কাশীতে কিন্তু সেই দাবি এখনও ওঠেনি। পাঁচ হিন্দু রমণী মসজিদ চত্বরের পশ্চিম প্রান্তের বাইরের দেওয়ালে যেখানে হিন্দু দেবদেবীর মূর্তি খোদিত, সেখানে দৈনন্দিন পুজো করার অনুমতি চেয়েছেন। আপাতত পুজোর সেই অধিকার রয়েছে বছরে একটি মাত্র দিনে। চৈত্র মাসের নবরাত্রিতে, যেদিন ‘শৃঙ্গার গৌরী’-র আরাধনা হয়। রমণীদের দাবি, মসজিদ চত্বরে দৃশ্যমান যেসব দেবদেবীর মূর্তি রয়েছে, যেমন শৃঙ্গার গৌরী, হনুমান ও গণেশ, তাঁদের তো বটেই, অদৃশ্য বিগ্রহেরও নিত্যপুজো ও দর্শনের অধিকার তাঁদের রয়েছে। আদালত সেই অধিকার দিক।
অযোধ্যা মামলার সঙ্গে কাশীর অমিল এটাই। জ্ঞানবাপী মসজিদের মালিকানা এখানে দাবি করা হয়নি। নিত্যপুজোর অধিকার দেওয়ার আগে দেওয়ানি আদালতের বিচারক নিশ্চিত হতে চেয়েছেন মসজিদের ধর্মীয় চরিত্র ও ‘প্রকৃত সত্য’ উদ্ঘাটনে। তাই ভিডিওগ্রাফের সঙ্গে সমীক্ষার নির্দেশ। সেই ভিডিওয় কী কী উদ্ঘাটিত, সোমবার আনুষ্ঠানিকভাবে তা জানানো হয়নি। কিন্তু হিন্দুত্ববাদী জনতা ইতিমধ্যেই রাষ্ট্র করে দিয়েছে, জ্ঞানবাপী মসজিদ চত্বরে যে পুকুর আছে, নমাজের আগে ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা যেখানে ‘ওজু’ করে শুদ্ধ হন, সেখানে নাকি শিবলিঙ্গর দর্শন পাওয়া গিয়েছে! প্রচার সত্য না মিথ্যা, সেই বিচারে বারাণসীর আদালত রাজি হয়নি। কিন্তু হুকুম জারি করেছে, পুকুরটির চারদিকে আধা সামরিক বাহিনী মোতায়েনের। সোমবার সন্ধ্যা থেকেই মসজিদ চত্বর চলে গিয়েছে সিআরপিএফ-এর জিম্মায়। আপাতত টান টান প্রতীক্ষা।
খানিকটা এমন ধরনের আবদারই ছিল তাজমহল মামলায়। নানা দাবি। কারও দাবি, তাজমহলের তল্লাট ছিল নাকি জয়পুরের মহারাজার সম্পত্তি। সেই পরিবারের সদস্যা বিজেপি সাংসদ রানি দিয়া কুমারীর দাবি, একদা মালিকানার যাবতীয় কাগজপত্রও নাকি তাঁদের তোশাখানায় মজুত রয়েছে। হিন্দুত্ববাদীদের দাবি, তাজমহল আদতে নাকি ‘তেজো মহালয়’, শিব মন্দির, ১২১২ সালে যা নাকি তৈরি করেছিলেন রাজা পরমর্দি দেব! তার অভ্যন্তরের ২২টি কুঠুরিতে নাকি বন্দি হিন্দু দেবদেবীদের বিগ্রহ। বন্ধ দরজা খুললেই নাকি সত্য প্রকাশিত হবে। সেই আগ্রহেই মামলা ঠোকা। সেই মামলা একদিনে শুধু খারিজই হয়নি, এলাহাবাদ হাই কোর্টের লখনউ বেঞ্চের দুই বিচারপতি ডি কে উপাধ্যায় ও সুভাষ বিদ্যার্থী মামলাকারী বিজেপি নেতাকে ভর্ৎসনা করে বলেছেন, ‘জনস্বার্থ মামলাকে এভাবে উপহাসে পরিণত করবেন না। এরপরে তো আমাদের চেম্বার খুলে দেখতে চাওয়া হবে কী আছে?’
যে-কারণে তাজমহল সংক্রান্ত মামলা খারিজ হয়, সেই একই ঢঙে জ্ঞানবাপী মামলাও খারিজ করে দেওয়া যেতে পারত। কিন্তু নিম্ন আদালত তা করেনি। হাই কোর্টও স্থগিতাদেশ দেয়নি। অথচ ২১ বছর আগে ১৯৯১ সালের শেষে প্রধানমন্ত্রী নরসিমা রাওয়ের সরকার দেশকে এই ধরনের সাম্প্রদায়িক বিপদ থেকে বাঁচাতে প্রণয়ন করেছিল ধর্মস্থান আইন। জ্ঞানবাপী মসজিদ কর্তৃপক্ষ সুপ্রিম কোর্টের কাছে যে-আরজি পেশ করেছে, তার ভিত্তিও ওই কেন্দ্রীয় আইন, যাতে বলা হয়েছে, ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট দেশ স্বাধীন হওয়ার সময় অগুনতি ধর্মস্থানের চরিত্র যেখানে যেমন ছিল, তেমনই থাকবে। কোনওরকম অদলবদল ঘটানো যাবে না। একমাত্র ব্যতিক্রম অযোধ্যা। সারার্থ, অযোধ্যা ছাড়া দেশের আর কোনও ধর্মস্থানের চরিত্র কোনওভাবেই বদলানো যাবে না। মসজিদ ভেঙে মন্দির তৈরি করা যাবে না, মন্দির ভেঙেও করা যাবে না মসজিদ। অথবা অন্য কোনও ধর্মালয়।
এই মামলায় ১৯৯১ সালের ওই আইনই পড়েছে ঘোর চ্যালেঞ্জের মুখে। অথচ, সুপ্রিম কোর্টের তৎকালীন প্রধান বিচারপতি রঞ্জন গগৈয়ের নেতৃত্বাধীন ৫ সদস্যর বেঞ্চ রাম জন্মভূমি মামলার রায়ে যা লিপিবদ্ধ করে গিয়েছে এবং ১৯৯১ সালের এই আইন সম্পর্কে যে-কথা বলেছে, সেটাই হওয়া উচিত পত্রপাঠ মামলা খারিজের হাতিয়ার। সর্বসম্মতভাবে সুপ্রিম কোর্টের রায়ে লেখা হয়েছিল– ‘…Parliament determined that independence from colonial rule furnishes a constitutional basis for healing the injustices of the past by providing the confidence to every religious community that their places of worship will be preserved and that their character will not be altered.’ রায়ে আরও লেখা হয়েছিল– ‘The Places of Worship Act imposes a non-derogable obligation towards enforcing our commitment to secularism under the Indian Constitution. The law is hence a legislative instrument designed to protect the secular features of the Indian polity,… it is a legislative intervention which preserves non-retrogression as an essential feature of our secular values.’
শেষ পর্যন্ত এই রায় সম্মান পাবে তো? রাষ্ট্রের কাছে? দ্রষ্টব্য সেটাই।