কৃশানু মজুমদার: শচীন খেললে ভারত জিতবে। তখন এটাই ছিল ভারতীয় ক্রিকেটের রিং টোন। এখন তা হয়ে গিয়েছে বিরাট (Virat Kohli) খেললে ভারত জেতে।
অনেকে এর সঙ্গে সহমত নাও হতে পারেন। কারণ একটা সময়ে কোহলি-ম্যাজিক চলছিল না। ব্যর্থ হচ্ছিলেন। সমালোচকরা নখ-দাঁত বের করছিলেন। রক্তাক্ত হচ্ছিলেন বিরাট কোহলি।
কিন্তু টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে প্রায় হাতের বাইরে বেরিয়ে যাওয়া একটা ম্যাচ বের করার পরে কোহলিয়ানায় মজে গোটা ক্রিকেটবিশ্ব।
শচীন তেন্ডুলকর (Sachin Tendulkar) টুইট করে লিখেছেন, ”নিঃসন্দেহে তোমার জীবনের সেরা ইনিংস। তোমাকে খেলতে দেখা দারুণ এক ব্যাপার। ১৯-তম ওভারে রাউফকে ব্যাকফুটে গিয়ে লং অনের উপর দিয়ে ছয় মারা এক কথায় অপূর্ব।” যিনি বলছেন, তাঁর জাদুদণ্ড একসময়ে বহু ম্যাচের ভাগ্য গড়ে দিয়েছে। ব্যাট হাতে তিনি নিত্যনতুন রূপকথার জন্ম দিতেন। কে ভুলতে পারবেন গোয়ালিয়রে দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে খেলা ডাবল সেঞ্চুরির ইনিংস? শারজায় অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে পর পর দুটো ম্যাচে সেঞ্চুরি নিয়ে এখনও চায়ের পেয়ালায় তুফান ওঠে। মরুশহরের বিধ্বংসী শচীন আজও হয়তো দুঃস্বপ্নে তাড়া করে বেড়ায় ক্যাসপ্রোইচ, ফ্লেমিংদের।
[আরও পড়ুন: ‘কোহলির চাপেই নো বল দিয়েছেন আম্পায়াররা’, শেষ ওভার বিতর্কে ক্ষুব্ধ আক্রম-ওয়াকাররা]
শারজা দেখেছে রক্তের গতি বাড়িয়ে দেওয়া বহু ম্যাচ। জাভেদ মিয়াঁদাদের শেষ বলে দুর্ধর্ষ ছক্কা মেরে ম্যাচ জেতানোও এই শারজাতে। মরুভূমির মাটিতেই বিজয়কেতন উড়িয়েছিলেন এক খর্বকায় মারাঠী। মরুশহরে শচীন যখন মরুঝড় তুলে সেঞ্চুরি করছেন, তখন সামনে থেকে বসে সেই ইনিংস দেখেছিলেন অংশুমান গায়কোয়াড়। তিনি তখন ভারতের কোচ। চলতি মাসের ২৯ তারিখ বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ইন্ডিয়ান ক্রিকেটার্স অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট হিসেবে ঘোষিত হবেন তিনি।
সেই তিনি শচীন ও কোহলির খেলা ইনিংস দুটো নিয়ে তুলনায় যেতে রাজি নন। তবে দুটো ইনিংস নিয়েই সমান উচ্ছ্বসিত। সংবাদ প্রতিদিন ডিজিটালকে গায়কোয়াড় বলছেন, ”শারজায় মরুঝড়ের সঙ্গে কোহলির গতকালের ইনিংসের তুলনা টানা উচিত নয়। গতকালের ম্যাচ অস্ট্রেলিয়ায় হয়েছে। ওই ম্যাচটা শারজায় হয়েছিল। দুটো দল কখনওই এক নয়। শচীনের ম্যাচটা ছিল ওয়ানডে, আর কোহলিরটা টি-টোয়েন্টি। শচীন ও কোহলির দু’ জনের ইনিংসই গ্রেট। দে আর ইম্পরট্যান্ট ইন দেয়ার ওন রাইট।”
একসময়ে শচীন সম্পর্কে অংশুমান গায়কোয়াড়কেই (Angshuman Gaekwad) বলতে শোনা গিয়েছিল, ”ও তো অস্ট্রেলিয়াকে ব্রেকফাস্ট, লাঞ্চ আর ডিনার বানিয়ে ফেলেছে।” সেই প্রসঙ্গ উত্থাপ্পন করতেই গায়কোয়াড় বলছেন, ”শারজায় শচীন যদি সেঞ্চুরি না করত তাহলে আমরা ফাইনালেও পৌঁছতাম না। আর ফাইনালে সেঞ্চুরি না পেলে আমরা চ্যাম্পিয়নও হতাম না।”
কোকা কোলা কাপের ফাইনালে পৌঁছনোর রাস্তা ভারতের জন্য মোটেও ফুল বিছানো ছিল না। বরং তা কাঁটা বিছানোই ছিল। অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে ম্যাচটা কার্যত সেমিফাইনালই হয়ে গিয়েছিল ভারতের কাছে।৫০ ওভারে সাত উইকেটে ২৮৪ রান করে অজিরা।ভারত যখন ব্যাট করছিল তখন মরুঝড় ওঠে। খেলা বন্ধ থাকে ২৫ মিনিট। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে বদলে যায় সমীকরণ। ৪৬ ওভারে ২৩৭ রান করলেই ভারত চলে যাবে ফাইনালে। সেক্ষেত্রে নেট রান রেটের বিচারে ছিটকে যাবে নিউজিল্যান্ড।
শুরু হয় শচীন শো। তাঁর বিধ্বংসী ১৩১ বলে ১৪৩ রানের সৌজন্যে ভারত খুব সহজেই ২৩৭ রান টপকে যায়। শচীনের সেই মহাকাব্যিক ইনিংস ভারতকে পৌঁছে দেয় ফাইনালে। ফাইনালেও চলে শচীন ঝড়। মাস্টার ব্লাস্টার করেন ১৩৪ রান। অস্ট্রেলিয়া আত্মসমর্পণ করে। অংশুমান গায়কোয়াড় বলছিলেন, ”অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে মরণবাঁচন ম্যাচটার আগে শচীনকে বলেছিলাম, বড় রান কাউকে করতেই হবে। শচিন বলেছিল আমি করব। শচিন সেঞ্চুরি করেছিল। বাসে করে ফেরার সময়ে আমাকে আবার বলেছিল ফাইনালেও আমি সেঞ্চুরি করব। কথা রেখেছিল শচীন।”
১৯৯৮ সালের শারজা থেকে কাট টু ২০২২। মেলবোর্নে কোহলির অতিমানবিক ইনিংস প্রসঙ্গে গায়কোয়াড় বলছেন, ”৩১ রানে ৪ উইকেট চলে গিয়েছিল ভারতের। চাপ বাড়ছিল ক্রমশ। সেই রকম একটা জায়গা থেকে ম্যাচ বের করা সহজ ব্যাপার নয়। বিরাট মহাজাগতিক ইনিংস খেলল। এরকম ইনিংস রোজ কেউ খেলতে পারে না। মাঝে মধ্যে এমন ইনিংস হয়।”
যে কোনও টুর্নামেন্টেরই প্রথম ম্যাচ গুরুত্বপূর্ণ। সেই ম্যাচ জিতে ভারত এখন সুবিধাজনক অবস্থায়। গায়কোয়াড় বলছেন, ”এবারের বিশ্বকাপে ভারতের ভাল সুযোগ রয়েছে। তবে টি টোয়েন্টি ক্রিকেট নিয়ে ভবিষ্যদ্বাণী করা সম্ভব নয়। একটা বাজে ওভার হিসেবনিকেশ সব বদলে দিতে পারে। একদিন কিছুই ঠিকঠাক না হতে পারে। তবুও বলছি নিজেদের ক্ষমতা অনুযায়ী খেলতে পারলে জেতা সম্ভব।”
কোহলির অতিমানবিক ইনিংস, ভারতের নাটকীয় জয় ছিনিয়ে নেওয়ার থেকে সোশ্যাল মিডিয়ায় এখন ট্রেন্ডিং নওয়াজের শেষ ওভারের নো বল। গোটা পাকিস্তান ফুঁসছে। ওয়াসিম আক্রমরা বলছেন, তৃতীয় আম্পায়ারের পরামর্শ নেওয়া উচিত ছিল। যদিও পাকিস্তানের অনুজ ক্রিকেটারদের সঙ্গে একমত নন পাকিস্তানের প্রাক্তন ক্রিকেটার আসিফ ইকবাল। তিনি বলছেন, ”আমার মতে নো বল নিয়ে বিতর্ক থাকার কথাই নয়।” গায়কোয়াড় কী বলছেন? তিনি বলছেন, ”সবটাই আম্পায়ারের উপর নির্ভর করছে। তিনি যদি মনে করেন নো বল তাহলে তৃতীয় আম্পায়ারের পরামর্শ নেওয়ার কী দরকার?” এক কথায় বিতর্কের আগুনে জল ঢেলে দিলেন অংশুমান গায়কোয়াড়।
বিশ্বের দু’ প্রান্তে খেলা দুটো ইনিংস। ভিন্ন মঞ্চ, ভিন্ন প্রতিপক্ষ। সময়ের ব্যবধানও ২৪ বছরের। তুলনা টানা কখনওই সম্ভব নয়। কিন্তু পরিস্থিতি, গুরুত্বের বিচারে দুই মহানায়কের দুই ইনিংস যে ক্রিকেট-ইতিহাসে অমর হয়ে থাকবে, তা বলে দেওয়াই যায়।