রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়: শুধু একটি কামড়। ঠোঁটে প্রথম চুমুর কামড়ের মতন। শুধু একটু ভিতর পর্যন্ত শুষে নেওয়া। প্রথম চুমুর শুষে নেওয়ার মতো। সেই মিষ্টির নাম যাই হোক না কেন, পিঠে পুলি থেকে রসগোল্লা, বোঁদে থেকে পরমান্ন, লেডিকেনি থেকে অমৃতি, সন্দেশ থেকে খাজা, কামড় দিলেই বিশুদ্ধ শৃঙ্গার। জিভ হয়ে ওঠে নিজেই একটা জিভেগজা। মিষ্টির ভিতর পর্যন্ত চলে গিয়ে গড়াগড়ি দেয় রসে। আর আমাদের মধ্যে ছড়িয়ে দেয় শৃঙ্গারের উত্তেজনা ও তৃপ্তি। আমাদের পৌঁছে দেয় আদিরসের প্রসারিত সমবর্তিতায়, অব্যর্থ অস্তিত্ববাদে। পৃথিবীর আর কোনও মিষ্টি জানে না বাঙালি-মিষ্টির সেক্স-সংহিতা!
বিখ্যাত লেখক বনফুলের স্ত্রীর হাতে-গড়া মিষ্টি খেয়ে রবীন্দ্রনাথ যতদূর বিস্মিত, ততদূর গম্ভীর! এই আশ্চর্য আচরণে কিঞ্চিৎ ঘাবড়ে গিয়ে বনফুল প্রশ্ন করলেন, খুব খারাপ লাগল কি? রবীন্দ্রনাথের পালটা প্রশ্ন, এ মিষ্টি আজকাল ভাগলপুরে পাওয়া যাচ্ছে না কি? বনফুলের উত্তর: আমাদের ঘরে গাই আছে। তার দুধ দিয়ে আমার স্ত্রী তৈরি করেছেন এই মিষ্টি। এতে রবীন্দ্রনাথ যেন আরও গম্ভীর ও চিন্তিত। বললেন, আমি মনে করেছিলাম, বাংলাদেশে আছে একজনই রসস্রষ্টা। সেই লোকটি রবীন্দ্রনাথ। এখন দেখছি দ্বিতীয়জনের আবির্ভাব হল! চিন্তার বিষয়। সেই সময়ে এক অসামান্য শৃঙ্গাররসের সৃষ্টি করেছেন রবীন্দ্রনাথ। নাম ‘শেষের কবিতা’। রবীন্দ্রনাথের বয়েস সবে সত্তর পেরিয়েছে। অনেক বছর আগে, বিবেকানন্দ ও রবীন্দ্রনাথ দুজনেই তখন মধ্য যৌবনে, তখন রবীন্দ্রনাথদের সঙ্গে মেলামেশার জন্য নিবেদিতাকে তিরষ্কার করে বিবেকানন্দ বলেছিলেন, ঠাকুরবাড়ির সঙ্গে মেলামেশা করলে আমি তিরষ্কার করবই। ওই বাড়ি বঙ্গদেশকে শৃঙ্গার রসে ভাসাচ্ছে। আমার অনুরোধ, এবছর বাংলার কোনও মিষ্টান্ন ভাণ্ডার থেকে তীব্র আদিরসের একটি নতুন মিষ্টির আবির্ভাব হোক করোনার এই প্রাদুর্ভাবের মধ্যেই। সেই মিষ্টির শৃঙ্গাররসে ভেসে গিয়ে আমরা যেন সেই নতুন মিষ্টির নাম রাখি ‘শেষের কবিতা’-র নায়িকার নামে, ‘লাবণ্য’! আরও একটি অনুরোধ, লাবণ্যর শরীর যেন নলেন গুড়ের হয়।
শ্যাম্পেনের সঙ্গে অনেক রসিক নলেন গুড়ের তুলনা করেন। এ-তুলনা অন্যায়। নলেন গুড়ের প্রতি অকুণ্ঠ অবিচার। ভোরের আলোয় গা চাঁচলে এমন গুড় পাওয়া যায়। গা মানে বিশেষ গাছের গা। ওই চাঁচাটার উপরেই স্বাদের তারতম্য। মদের শরীর আর নরনারীর মন, যত বুড়ো হয় তত রস আর স্বাদ বাড়ে সেখানে। এই যে আমি, যত বুড়ো হচ্ছি, তত জিভে তার আসছে। মনে ইচ্ছে জাগছে। নলেন গুড়ের মজাটা হল, ওর শরীরটি একেবারে নতুন হওয়া চাই। মজে গেলে চলবে না। পৃথিবীর আর সব মিষ্টি মজলে স্বাদে গভীর হয়। নলেন একমাত্র মিষ্টি, পৃথিবীর একমাত্র আদিম তারল্য, যার শৃঙ্গারের তারুণ্য চিরকালের। এইখানেই নলেন গুড় শ্যাম্পেনকে একেবারে লেজেগোবরে করেছে।
[আরও পড়ুন: সাবধান! ঠান্ডা লাগলে শিশুকে এই চার ধরনের খাবার একদম দেবেন না]
আরও একটি নতুন মিষ্টির প্রয়োজন বাঙালির এবছর-করোনার পরিব্যাপ্ত বিষণ্ণতার মধ্যে আমাদের প্রতত শৃঙ্গার রসে ভাসিয়ে নিয়ে যেতে! সেই মিষ্টি মুখে দিলেই যেন আমরা আমাদের প্রিয় বউদিদের মায়াময় রসসৃষ্টিতে নিমগ্ন আঙুলগুলির কথা ভাবতে পারি। যেমন শেষ বয়স পর্যন্ত ভেবেছেন রবীন্দ্রনাথ, তাঁর নতুন বউঠানের অঙ্গুলি স্পর্শে তৈরি মিষ্টান্নগুলির কথা, যাদের তিনি নিজের হাতে সাজাচ্ছেন রুপোর রেকাবিতে। নতুন বউঠানের তৈরি মিষ্টি, যে-মিষ্টির গায়ে ছড়িয়ে আছে প্রিয় বৌদিটির আঙুলের ছোঁয়া-আজীবন ভুলতে পারেননি রবীন্দ্রনাথ! আমরাও কি পারি বাঙালি মিষ্টির গায়ে বাঙালি বউদির আঙুল থেকে নেমে আসা তারল্যের কথা ভুলতে? আমি যত লেখা লিখেছি নতুন বউঠানকে নিয়ে, তাতে বাঙালি মিষ্টির গায়ে তাঁর আঙুলের সৃষ্টিশীল আনাগোনাকে সেলিব্রেট করেছি। উৎসবে পরিণত করেছি সেই আদিরসকে। আর মনে মনে সেই মিষ্টির নাম রেখেছি ‘কাদম্বরী’। ‘কাদম্বরী’ মানে তো ‘মদ’। বাঙালি মিষ্টির শৃঙ্গার ছাড়া আর কোথায় পাব এমন নেশা?
বাঞ্ছারাম
এই চরম মহামারীর সময় বাঞ্ছারামের অন্যতম কর্ণধার শুভজিৎ ঘোষ জানালেন, মানুষের অবসাদ থেকে মুক্তি পেতে একমাত্র পথ হল মিষ্টি। যদি বলি তা আবার কী করে হয়। হ্যাঁ হয়, সত্যি হয়। আপনি যদি এক টুকরো মিষ্টি মুখে দেন তাহলে সত্যি বিস্বাদ থেকে স্বাদ ফিরে আসে। আর সেই মিষ্টি যদি বিশুদ্ধ ছানা দিয়ে তৈরি হয়, তাহলে তো আর কথাই নেই। আগেকার দিনে মানুষ অসুস্থ হলে তার পথ্য হিসাবে ছানা ছিল অবশ্যম্ভাবী। কিন্তু সেকথা মানুষ ভুলে গিয়েছে। সবাই কৃত্রিমভাবে ওষুধের দ্বারা আরোগ্যলাভ করার পিছনে ছুটে বেড়ায়। যদি তাই হয়, আমার প্রিয় মিষ্টিটি একটু মুখে দিলে আমি ভাল, থাকি আমার মন ভাল হয়ে যায়, তাহলে ক্ষতি কী। নতুন এই মহামারীতে একে অপরের সঙ্গে আলাপ তো দূরের কথা, সামনা সামনি আসাও বারণ। কিন্তু আমরা যদি না এসে তাকে মিষ্টি পাঠাই, তাহলেও মনের দিক থেকে অনেক কাছাকাছি আসা যায়। সুতরাং শুদ্ধ ছানা, ভাল ঘি, ভাল দুধ, ভাল মধু দিয়ে যে মিষ্টান্ন তৈরি হয়, তা খেলে শরীর, মন দুই-ই ভাল থাকে।
বলরাম মল্লিক ও রাধারমণ মল্লিক
কলকাতার ১৩৬ বছরের ঐতিহ্যবাহী মিষ্টান্ন প্রতিষ্ঠান তাদের গুণমান অটুট রেখে চলেছেন চার পুরুষ ধরে। বর্তমানে ভবানীপুরের বলরাম মল্লিক ও রাধারমণ মল্লিকের কর্ণধার সুদীপ মল্লিক জানালেন, দীপাবলি ও ভাইফোঁটা উপলক্ষে নতুন নতুন মিষ্টি তৈরি করে থাকেন। এবছর ভাইফোঁটায় স্পেশ্যাল মিষ্টির তালিকায় রয়েছে ভাইফোঁটা সন্দেশ, খাজা, হোয়াইট চকোলেট অমৃতি, সীতাফল সন্দেশ, অরেঞ্জ রাবড়ি সুফলে, বেক মিহিদানা, চকোলোভা ইত্যাদি। ভবানীপুরে এদের মিষ্টির মূল শোরুম নতুন করে পাঁচতলা অত্যাধুনিক মিষ্টি হাব তৈরি হয়েছে। ছানার পাক থেকে মিষ্টি তৈরির সবকিছু বিদেশি অত্যাধুনিক স্বয়ংসক্রিয় মেশিনে। মিষ্টি তৈরি ও প্যাকেজিং সবটাই কোভিড বিধি মেনেই করা হচ্ছে। ভবানীপুর ছাড়াও কলকাতার কসবা, বালিগঞ্জ, লেক গার্ডেন্স ও পার্ক স্ট্রিটে এদের শাখা আছে।
নলীন চন্দ্র দাস অ্যান্ড সন্স
এই মহামারীর মধ্যেও এই প্রতিষ্ঠান ১৯৩ বছরের ঐতিহ্য বহন করে চলেছে। বর্তমানে নিত্যনতুন সংমিশ্রণে আকর্ষণীয় ও সুস্বাদু সন্দেশ আবিষ্কার করেছে এই প্রতিষ্ঠান। নলীন চন্দ্র দাস হলেন সন্দেশ ও চকোলেট ফিউশন মিষ্টির পথিকৃৎ। ভাইফোঁটার মিষ্টিমুখের তালিকায় থাকছে চকোলেট তালশাঁস, বিদেশি স্ট্রবেরি ও ব্ল্যাকবেরি তালশাঁস, নলেন গুড়ের তালশাঁস, মৌসুমি, বাটার স্কচ, ব্ল্যাক ফরেস্ট সন্দেশ, কেশর বাটার মিল্ট সন্দেশ এবং ফ্রেশ ছানার পায়েস। আবার খাব মালাই রোল, দিলখুশ, পারিজাত ইত্যাদি। সংস্থার কর্ণধার তপন দাস জানালেন, সন্দেশের উপর নিরন্তর পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়ে নতুন কিছু জিভে জল আনা সন্দেশ উপহার দিচ্ছেন তাঁরা। রবীন্দ্র সরণির নতুন বাজারের পাশাপাশি আরও ছ’টি নতুন শাখা তৈরি করেছে এই প্রতিষ্ঠান।
শ্রীহরি মিষ্টান্ন ভাণ্ডার
কলকাতার ঐতিহ্যপূর্ণ মিষ্টির দোকানগুলির মধ্যে অন্যতম হল ভবানীপুরের ১০৯ বছরের শ্রীহরি মিষ্টান্ন ভাণ্ডার। ম্যানেজার সুব্রতবাবুর কথায়, কালীপুজো ও ভাইফোঁটা উপলক্ষে থাকতে চলেছে পশ্চিমবঙ্গের প্রসিদ্ধ বড় ল্যাংচা। থাকবে কমলাভোগ, মালাইচপ, ভেজ সুইটস, হরিভোগ, রসনাভোগ এবং নতুন গুড়ের রসগোল্লা ও মনোহরা। আরও জানতে চলে আসুন ভবানীপুর থানার ঠিক বিপরীতে।