২০২৪ সালের লোকসভা ভোটকে বিজেপি চাইছে ২০২৬ সালের বাংলার বিধানসভা ভোটের সঙ্গে রাজনৈতিকভাবে সংযুক্ত করতে। আর, এই ভোট-অভিস্রবণ বুঝে তৃণমূল কংগ্রেস চাইছে, বিজেপির পালের বাতাস যথাসম্ভব কেড়ে নিতে। লিখলেন জয়ন্ত ঘোষাল।
২০২৪ এবং ২০২৬। ২০২৪ থেকে ২০২৬। এ এক যাত্রাপথ। সুদীর্ঘ সাত দফার ভোটপর্ব সাঙ্গ হতে না হতেই শুরু হতে চলেছে ২০২৬ বিধানসভা ভোটের প্রস্তুতি। যেন আমার হল সারা তো তোমার হবে শুরু। স্কটিশ-আমেরিকান কমেডিয়ান লেখক প্রখ্যাত অভিনেতা ক্রেগ ফার্গুসন একদা বলেছিলেন– হে ভগবান, অবশেষে ভোটের দিনটি বিদায় নিল। আর প্রচারের বিজ্ঞাপন দেখতে হবে না, আর কাদা ছোড়াছুড়ি হবে না। প্রার্থীদের আর অভিনয় করে গাদা গাদা মিছে কথা বলতে হবে না। ইট ইজ ওভার। অ্যাট লাস্ট। কিন্তু এর পর তিনি বলেন, এখানেই তো মস্ত বড় ভুল হয়ে যায়। ভোট কি আর শেষ হয়? একটা ভোট শেষ হতে না হতেই আবার ভোট এসে যায়।
এবার লোকসভা ভোটপর্বে দেখলাম বিজেপির শীর্ষনেতৃত্ব প্রতিপদে ২০২৪-কে ২০২৬-এর সঙ্গে যুক্ত করেছিলেন। এর মধে্য লুক্কায়িত ছিল বিজেপির এক গোপন রণকৌশল। ২০২৪ লোকসভা ভোট নরেন্দ্র মোদির (PM Modi) ভোট। দিল্লির মসনদে মোদি থাকবেন কি থাকবেন না, তার পরীক্ষা। এই ভোটে তৃণমূলের অাসন সংখ্যা যা-ই হোক সাংবিধানিকভাবে নবান্নে মমতা ক্ষমতাসীন থাকবেন। ২০২৬-এর বিধানসভা ভোট হবে মমতা বন্দে্যাপাধ্যায়ের তৃণমূল কংগ্রেসের অগ্নিপরীক্ষা কিন্তু বিজেপি শীর্ষ নেতৃত্ব এবার এই ২০২৪ আর ২০২৬-কে সযতনে যুক্ত করে দিলেন।
[আরও পড়ুন: জাতীয় পতাকা উলটে প্রতিবাদ ট্রাম্প সমর্থকদের! তীব্র নিন্দা বাইডেনের]
দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ কলকাতায় এসে বললেন, ২০২৪-এ বিজেপিকে (BJP) বিপুল সংখ্যায় ভোট দিন যাতে বিজেপি ২০২৬-এ মমতা বন্দে্যাপাধ্যায় সরকারকে বরখাস্ত করতে পারে। রাজে্য যদি নৈরাজ্য, দুর্নীতি, অপশাসনের অবসান চান, তবে চাই পরিবর্তন। আর এই পরিবর্তন তখনই সম্ভব যদি ২০২৪-এ আপনারা মোদির পক্ষে বিজেপির পক্ষে ভোট দেন।
ফলে ২০২৪ সালের লোকসভা ভোট (Lok Sabha Election 2024) যতটা না মোদির গ্যারান্টির পক্ষে, তার চেয়েও বেশি মমতা-বিরোধী নেতিবাচক ভোটের জন্য। মানে, এমনটাই চেয়েছে বিজেপি নেতৃত্ব। তাই ২০২৪ বিজেপির স্বল্পমেয়াদি লক্ষ্য। ২০২৬ বিধানসভা ভোট হল দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্য। পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির জন্য ২০২৪ সেমিফাইনাল, ২০২৬ ফাইনাল। ২০২৬-এর ভোটের ড্রেস রিহার্সাল যেন হয়ে গেল ২০২৪-এর সাতদফা ভোটে।
আমাদের দেশে কখনও কখনও লোকসভা আর বিধানসভা ভোট মিলেমিশে যায়, আবার অনেক সময় একই ভোটার দু’টি রাজে্য দু’রকমভাবে তার আচরণ প্রদর্শন করে। একদা দিল্লিতে দেখেছি, জাতীয় স্তরে মোদির পক্ষে ভোট দিলেও রাজ্যস্তরে দিল্লিবাসীকেজরিওয়ালকে ভোট দিয়েছে। আমরা বলতাম, উপরে মোদি, নিচে কেজরিওয়াল। ওড়িশাতেও দেখেছি, জাতীয় স্তরে বিজেপি, কিন্তু রাজ্যস্তরে যত দিন নবীন পট্টনায়ক বেঁচে আছেন, তত দিন যেন ওড়িশার মানুষ তঁার পক্ষেই ভোট দিতে চান। এবারের ভোটে ওড়িশা-দিল্লির মতো রাজ্যে কী হবে তার শেষ কথা তো জানি না, কিন্তু পশ্চিম বাংলায় এখনও মমতা বন্দে্যাপাধ্যায়ের শক্তি ও প্রাসঙ্গিকতাকে অবজ্ঞা করা যায় না। ২০২১ সালে নকশালপন্থী ও ধর্মনিরপেক্ষ এক বিপুল নাগরিক সমাজ প্রচার চালায়, ‘সে নো টু মোদি’। এবারও মোদি-বিরোধী নেতিবাচক প্রচার আছেই। কিন্তু বিজেপির শীর্ষ নেতৃত্ব মোদি-বিরোধী এই নেতিবাচক ভোটের মোকাবিলায় মমতা-বিরোধিতাকে প্রচারের প্রধান হাতিয়ার করতে চাইছে। প্রচারের কৌশল হল– দেশের জন্য মোদির গ্যারান্টি যাই হোক, পশ্চিমবঙ্গে আসল প্রচার হল, মমতা-তৃণমূলের ভোট সমর্থনে ব্যাপক অবক্ষয় হচ্ছে। এই অবক্ষয়ের ফলে রাজনৈতিক পরিসরে যে-শূন্যতা তৈরি হচ্ছে তা এবার দখল করবে বিজেপি। তারপর সেই সাফল্যকে মূলধন করে বিজেপি ২০২৪ থেকে ২০২৬-এর বিধানসভা ভোটের প্রচারে নেমে যাবে।
[আরও পড়ুন: ইউক্রেনকে উসকে রাশিয়ায় ‘ছদ্মবেশে’ আক্রমণ আমেরিকারই! কী চাইছেন বাইডেন?]
২০২৪ আর ২০২৬-এর মধে্য এই ভোট রাজনীতির অভিস্রবণ মমতা জানেন না, এটা ভাবাও ভুল। তাই বিজেপি ২০১৯-এ প্রাপ্ত ১৮টি আসনকে বাড়াতে চাইছে। সবচেয়ে বড় আশঙ্কা, ১৮ সংখ্যাটি কমে যেন ১৭ না হয়ে যায়। ভোটের শুরুতে অমিত শাহ ৩০-৩৫ বলেছিলেন, সে তো সৈনিকদের মনোবল বৃদ্ধির জন্য সেনাপ্রধানের ‘ভোকাল টনিক’। পরবর্তীকালে তিনি বলতে শুরু করেন ২০-২৫।
তৃণমূল কংগ্রেস পশ্চিমবঙ্গের শাসক দল। ১৩ বছর ধরে ক্ষমতায়। ১৩ বছর পর অ্যান্টি-ইমকামব্যান্সি হওয়াটাই তো স্বাভাবিক। একে বলে প্রকৃতির সূত্র। ‘ল অফ নেচার’। ২০২৪-এ ২০২৬-এর এই প্রচার যে বিজেপির কৌশল তা মমতা বন্দে্যাপাধ্যায় এবং অভিষেক বন্দে্যাপাধ্যায় যে জানেন না, তা তো নয়। তাই তৃণমূল কংগ্রেসের পক্ষ থেকেও ২০২৪ ও ২০২৬ কৌশলকে মিলিয়ে দেওয়া হয়েছে। বলা যায় রাজনৈতিক অভিস্রবণ। তাই ‘লক্ষ্মীর ভাণ্ডার’ থেকে রাজ্য সরকারের নানা জনমুখী প্রকল্পর প্রচারও কম হয়নি। সামগ্রিকভাবে ২০২৪ ভোট হল মোদি বনাম মমতার দ্বৈরথ। রাজ্যকে কেন্দ্র কীভাবে বঞ্চিত করছে তার তত্ত্বতালাশও তো এবার কম হল না। মোদি বলছেন– কেন্দ্র রাজে্যর জন্য কাজ করতে চাইছে। কিন্তু তৃণমূল একটাই কথা বলে চলেছে– কাজ হতে দেব না। আর মমতা অভিষেক বলছেন– রাজ্যকে প্রাপ্য টাকা থেকে বঞ্চিত করছে দিল্লি। ১০০ দিনের কাজের টাকা কেন পাব না? সিপিএম যখন শাসক দল ছিল তখন রাজে্যর প্রতি কেন্দ্রের বিমাতৃসুলভ মনোভাব ছিল প্রচারের বড় হাতিয়ার। এখনও দিল্লির বঞ্চনা মমতারও হাতিয়ার। আমরা বাঙালি। দিল্লির শাহেনশার কাছে বঞ্চিত।
বিজেপি বলছে ২০২৬-এ ‘ডাব্ল ইঞ্জিন সরকার’ হলে রাজে্য আবার ‘সোনার বাংলা’ ফিরে আসবে। মোদি বাংলাকে নাকি সোনায় মুড়িয়ে দেবেন! দিদি বলছেন, মিথে্য কথা। মোদি মিথ্যুক। তাই শেষ হয়েও হইল না শেষ। ২০২৪-এ তৃণমূলের লক্ষ্য– ২০১৯-এর বিজেপির আসন সংখ্যাকে ১৮ থেকে যথাসম্ভব কমিয়ে দেওয়া। তাই ২০২৪ হল ২০২৬-এর লিটমাস টেস্ট। সেই ক্রেগ ফার্গুসনের গল্পেই ফিরে আসি। তিনি বলেছিলেন, ভেবেছিলাম ভোট শেষ হয়ে গেল। অতএব সেই অঁাধি-ঝড় থেমে গেল। কিন্তু বাস্তবে তা হবে না, কারণ ৪ জুন ভোটের ফল বেরতে না বেরতেই শুরু হয়ে যাবে ২০২৬-এর প্রস্তুতি। ক’দিন আগে ভিন্স কেব্লের লেখা ‘হাউ টু বি আ পলিটিশিয়ান’ বইটি পড়ছিলাম। কেব্ল লন্ডনের এক প্রবীণ সাংসদ। নিজের অভিজ্ঞতায় রাজনীতিক জীবনের বর্ণনা দিতে গিয়ে তিনি বারবার উইনস্টন চার্চিলের কথা স্মরণ করেছেন। বলেছেন– রাজনীতি থেকে অবসর নেওয়াও তো কঠিন। একটা ভোট শেষ হতে না হতেই আর একটা ভোট এসে দরজায় কড়া নাড়ে। চার্চিলের উদ্ধৃতি দিয়ে
কেব্ল বলেছেন, যুদ্ধে তোমার একবারই মৃতু্য হতে পারে, কিন্তু রাজনীতিতে তোমার মৃতু্য হতে পারে অনেকবার (In war you can only be killed once, but in politics many times)।
অতএব, ২০২৪-এর পর সঙ্গে সঙ্গেই ২০২৬-এর যুদ্ধের জন্য দু’পক্ষ প্রস্তুত। নাগরিকত্ব বিল (সিএএ) প্রয়োগে শেষবেলায় ১ জুন ভোটের চার-পঁাচদিন আগে পশ্চিম বাংলায় আট-দশজনকে নাগরিকত্ব দেওয়া হল বটে, তাতে মতুয়া সম্প্রদায়ের সংশয় দূর করে মন জয় করার শেষ মরিয়া চেষ্টা করল বিজেপি। কিন্তু অতঃপর?
২০২৪-এর পর ২০২৬-এর আগে বিজেপি কীভাবে এগোবে? কতটা এগোবে? রাজে্য এই সিএএ-এর জন্য এবার সংখ্যালঘু মুসলমান ভোট একত্রিত হল, না কি ভোট ভাগাভাগি হল– এসব জানার পর দু’পক্ষই ময়নাতদন্ত করবে। ২০২৪ ফলাফলের নিরিখেই তৈরি হবে ২০২৬-এর যাত্রাপথ।