ড্রাগের নেশা৷ কেউটে সাপের মতো পেঁচিয়ে ধরে। সেখান থেকে বেঁচে ফিরেছেন অনিন্দ্য চট্টোপাধ্যায়। বললেন কোয়েল মুখোপাধ্যায়কে৷
অনিন্দ্য চট্টোপাধ্যায়ের নাম শুনলেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে হ্যান্ডসাম, ইয়ং একজন অভিনেতার ছবি, যার সারা গায়ে ট্যাটু।
(হাসি) আমার তিনটে ট্যাটু আছে। বাঁ হাতে জাপানি কোই ফিশ। স্রোতের বিরুদ্ধে গিয়ে যারা কিছু করতে পারে, তাদের প্রতীক। ডান হাতে জিম মরিসন। আর যেটা আছে, সেটার নাম ‘বায়ো-হ্যাজার্ড’। একটা সময় তো খুব নেশা করতাম! আমার ফুসফুসটা যে একটু হলেও বিষাক্ত, সেটা বোঝাতেই এই ট্যাটু। এই ট্যাটুটা আমায় প্রতিনিয়ত মনে করিয়ে দেয় যে, আই হ্যাভ আ লং ওয়ে টু গো। আর ইচ্ছে আছে বাবা-মাকে নিয়ে একটা ট্যাটু করাব।
গত বছর আপনার বাবার মৃত্যু হয়। সেই ঘটনা আপনার জীবনে কতটা প্রভাব ফেলেছিল?
আমি যখন আমার প্রথম ছবির শুটিং শুরু করি, ‘বাপি বাড়ি যা’, তখন মা’কে হারিয়েছি। তার পর বাবাই ছিল আমার সব কিছু। আজও মেনে নিতে পারি না যে বাবা আমার সঙ্গে নেই। যখন পিছন ফিরে দেখি যে মাথার উপরে দুটো ছাতার একটাও নেই, কষ্ট হয়। বাবা ওয়াজ মাই ফ্রেন্ড, ফিলোজফার অ্যান্ড গাইড। আমরা একটা সিগারেট শেয়ার করে খেয়েছি, এমনও হয়েছে। বাবার মৃত্যুটা তো হঠাৎ করেই হল! লন্ডন থেকে ফিরেই বাবা অসুস্থ হয়ে পড়েন। ফুসফুসের ক্যানসার ধরা পড়ে। কিছু দিনের রোগভোগ। তার পর মৃত্যু। খুবই কঠিন
ছিল সেই সময়টা। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ঘুরে দাঁড়াতে হয়েছে।
আপনার জীবনের একটা বড় অংশ এই ঘুরে দাঁড়ানো থেকেই শুরু হয়েছে। মাদকের নেশা ছেড়ে বেরিয়ে আসতে পেরেছেন?
আমি বরাবরই এটা নিয়ে ওপেন। ভোকাল। কারণ আমার মনে হয়েছে, নেশা করা কতটা খারাপ, সেটা নিয়ে কথা বলা উচিত। সমাজকে বার্তা দেওয়া উচিত। আমার জার্নির কথা শুনে কেউ যদি উদ্বুদ্ধ হন নেশা ছাড়তে, সেটা আমার কাছে খুব বড় পাওনা। আমি অনেক সেমিনারে নেশার কুপ্রভাব নিয়ে আলোচনা করেছি। এখনও আমার কাছে প্রচুর বাবা-মা তাদের ছেলেমেয়েদের নিয়ে আসেন। আমি সাধ্যমতো তাদের বোঝানোর চেষ্টা করি। সমাজের মূলস্রোতে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করি।
ব়্যাপ করেন খাঁটি বাংলায়, কলকাতার ‘গাল্লি বয়’কে চেনেন?
কেমন ছিল সেই অন্ধকার সময়টা?
খুব অল্প বয়স থেকে নেশা করতে শুরু করি। ছোটবেলা থেকে আমার ঝোঁক ছিল যে, যা কিছু আমায় করতে বারণ করা হবে, আমি সেটাই করব। আমাকে বলা হয়েছিল, নেশা করা খারাপ। নেশা করতে নেই। তো আমার মনে হল, কেন খারাপ বলেছে, সেটা আমায় দেখতে হবে। সেটা করতে গিয়ে মাদকের নেশা ধরি। যতক্ষণে বুঝলাম যে এটা সত্যিই খারাপ, ততক্ষণে বেশ খানিকটা সময় পেরিয়ে গিয়েছে। আমি নেশার জালে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে পড়েছি। ফেরার রাস্তা নেই। রিহ্যাবে যাচ্ছি। লক আপে যাচ্ছি। মার খাচ্ছি। অসামাজিক কাজকর্ম করছি। কিন্তু কিছুতেই নেশা থেকে বেরোতে পারছি না। এটা ২০০৮ সালের কথা।
কীসের নেশা করতেন আপনি?
হেরোইন। বেসিক্যালি আমি ব্রাউন সুগার অ্যাডিক্ট ছিলাম।
রিহ্যাবে কত বার গিয়েছেন?
সব মিলিয়ে ৩০ বার তো বটেই।
সমাজের মূলস্রোতে ফিরলেন কী করে?
চোখের সামনে নিজের মৃত্যু দেখতে পাচ্ছিলাম আমি। সামনে দু’টো রাস্তা খোলা ছিল। হয় মেন্টাল অ্যাসাইলাম। আমার এমন বহু বন্ধু ছিল, যারা আজ আর নেই। মাদকের নেশা ওদের জীবন কেড়ে নিয়েছে। দু-তিন জনকে আমি সুইসাইড করতেও দেখেছি। সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে আমার সামনে ঘুরে দাঁড়ানো ছাড়া আর কোনও অপশন ছিল না। মনের জোরে করেছি, বলব না। আসলে দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গিয়েছিল। আর কোনও অপশন ছিল না। ২০০৮ সাল থেকে আমি নেশামুক্ত থাকার লড়াই শুরু করি। সেদিন থেকে আজকের দিন পর্যন্ত আমি ভাল আছি। আজ পৃথিবী উলটে গেলেও আমি জানি, আমি নেশা করব না। কাল কী হবে, জানি না। কিন্তু এই কথাটা আমি প্রতিদিন নিজের কাছে বলি। এভাবে এগারোটা বছর কেটে গেছে। আজ আমার আনন্দ হলে বা দুঃখ হলে, দু’পাত্তর মদ খেতে হয় না। খালি চোখে সূর্যোদয় দেখতে পারি, খালি চোখে সূর্যাস্ত দেখতে পারি। এটাই আমার সবচেয়ে বড় পাওনা।
বসন্তে হয়ে উঠুন স্টাইলিশ, পোশাকে থাকুক সাহসিকতার ছোঁয়া
পরিবার সেই সময় কতটা পাশে দাঁড়িয়েছিল?
পরিবার তো পাশে ছিলই। কিন্তু আমার সেই দুঃসময়ে আমার পাশে সেই বন্ধুরাও দাঁড়িয়েছিল, যাদের সঙ্গে আমার রক্তের সম্পর্ক নেই, নাড়ির টান নেই। ওরা আমাকে সেরে উঠতে সাহায্য করেছিল। সেই বিশ্বাসটা আমায় যুগিয়ে গিয়েছিল যে, নেশামুক্ত হয়েও ভাল থাকা যায়। ওদের ছাড়া আমি ভাল থাকতে পারব না।
তার পর অভিনয়ে এলেন কীভাবে?
নেশা ছেড়ে ভাল থাকতে যখন শুরু করলাম, তার পর থেকেই ক্যামেরার পিছনে কাজ করতে শুরু করি। এখনও করি। প্রচুর ন্যাশনাল লেভেলের টিভিসিতে কাস্টিং ডিরেক্টর হিসাবে কাজ করেছি। পরিচালককে অ্যাসিস্ট করেছি। অভিনয়ের সুযোগ প্রথম পাই ২০১১ সালে। সুদেষ্ণাদি (সুদেষ্ণা রায়), অভিজিৎদার (অভিজিৎ গুহ) ‘বাপি বাড়ি যা’ ছবিতে। তার পর প্রচুর টিভি সিরিয়াল, সিনেমা, ওয়েব সিরিজ, টেলিফিল্ম-নানা ধরনের কাজ করছি।
অনিন্দ্য চট্টোপাধ্যায় আজ ইউথ আইকন।
সমাজ আমাকে আইকন বানিয়েছে। আমি নিজেকে কোনও তকমা দিইনি। সকলকে এটাই বলতে চাই যে, আপনারা আমাকে পাতাখোর বলুন বা নেশাড়ু বা ইউথ আইকন-এটাই আমি। অতীত নিয়ে আমি ভয় পাই না। গত চার-পাঁচ বছর ধরে আমি কলকাতা পুলিশের অ্যান্টি ড্রাগ ক্যাম্পেনের সঙ্গে যুক্ত।
সমাজের চোখে আপনি ইউথ আইকন, কিন্তু আপনার চোখে আইকন কে?
আমার চোখে কলকাতার সেই সাড়ে তেরোশো ‘নেশাড়ু’ তরুণ-তরুণী ইউথ আইকন যারা আজ নেশা ছেড়ে ভাল আছে। আমার মতো সমাজের মূলস্রোতে ফিরে আসতে পেরেছে।
আপনার আপকামিং প্রজেক্টস কী কী?
লেটেস্ট রিলিজ ‘মহালয়া’। ছোট কিন্তু ইন্টারেস্টিং চরিত্র। তার পর ‘নেটওয়ার্ক’ রিলিজ হবে। পরিচালক ইন্দ্রাশিস আচার্যর সঙ্গে কাজ করেছি। ছবিটার নাম ‘পার্সেল’। নন্দিতা রায়-শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের ‘বেলাশুরু’ আছে।
আচ্ছা, ‘বেলাশুরু’ কী ‘বেলাশেষে’-র সিকুয়েল? না প্রিকুয়েল?
কোনওটাই না। ইটস আ ডিফারেন্ট স্টোরি অলটুগেদার। শুধু চরিত্রগুলো এক।
বিদেশি ভাষার ছবিতে অভিনয় করছেন, শুনলাম?
বাংলা ভাষারই ছবি। তবে প্রোডাকশন ইউনিট বিদেশি। সম্প্রতি লস অ্যাঞ্জেলসে শুটিং করে এলাম। ছবির নাম ‘রূপকথা নয়’।
‘কষ্ট দিয়ে থাকলে ক্ষমা চেয়ে নেব’, কঙ্গনা প্রসঙ্গে মুখ খুললেন আলিয়া
অনিন্দ্য, যে শো-বিজ ইন্ডাস্ট্রিতে আপনি আছেন, সেখানে কি বন্ধু হয়?
হ্যাঁ। কেন হবে না! (অবাক হয়ে)
কিন্তু সেই বন্ধুত্বের সমীকরণ কি সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বদলায়? বিক্রম-সোনিকা প্রসঙ্গে প্রশ্নটা করছি। আপনিও বন্ধু সোনিকাকে হারিয়েছেন…
(একটু থেমে) হ্যাঁ, বন্ধুত্বের সমীকরণ পালটায়। কারণ সময় পালটায়। আর সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মানুষও পালটে যায়। কিন্তু এখন এটা নিয়ে কিছু বলা ঠিক হবে না, কারণ এর সঙ্গে আইন জড়িয়ে আছে। এটুকু বলতে পারি, যে বন্ধুকে হারিয়েছি, তাকে আজও খুব মিস করি। যা হয়েছে, তা না হলেই পারত!
আচ্ছা, অনিন্দ্য কি সিঙ্গল না ইন আ রিলেশনশিপ?
ইন আ রিলেশনশিপ।
পরের প্রশ্নটা আপনি জানেন।
(হেসে) কেরিয়ারটা একটু সেটল করে নিই আগে, তার পর বিয়ে করব!
তিনি কি সিনেমার জগতের কেউ?
না। না।
মিডিয়া তাঁকে চেনে?
না। না। (হাসি) থাক না!
The post ‘চোখের সামনে নিজের মৃত্যু দেখেছি’, কেন এমন বললেন অনিন্দ্য? appeared first on Sangbad Pratidin.