সুমিত বিশ্বাস, পুরুলিয়া: এসআইআর আতঙ্কে শুনানির কয়েক ঘণ্টা আগে আদিবাসী জনজাতির ৮২ বছরের বৃদ্ধ দুর্জন মাঝি রেললাইনে আত্মহত্যা করায় উত্তাল পুরুলিয়া। সোমবার রাতেই পুরুলিয়া জেলা তৃণমূল নেতৃত্বকে সঙ্গে নিয়ে মৃত দুর্জন মাঝির ছেলে কানাই মাঝি তাঁর বাবার আত্মহত্যার ঘটনায় চিফ ইলেকশন কমিশনার জ্ঞানেশ কুমার ও রাজ্যের চিফ ইলেকশন অফিসার মনোজকুমার আগরওয়ালের নামে অভিযোগ করেন। মঙ্গলবার পুরুলিয়া দেবেন মাহাতো গভর্নমেন্ট মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালের হাতোয়াড়া ক্যাম্পাসে ময়নাতদন্তের পরই এদিন বিকেলে মৃতদেহ নিয়ে পাড়ার আনাড়ায় প্রতিবাদ মিছিল, বিক্ষোভ ও সভা করে পুরুলিয়া জেলা তৃণমূল।
ওই কর্মসূচিতেই চিফ ইলেকশন কমিশনের কুশপুত্তলিকা পোড়ান তৃণমূল নেতা-কর্মী থেকে ওই এলাকার সাধারণ মানুষজন। তৃণমূল কংগ্রেসের এই বিক্ষোভে পুরুলিয়া-বরাকর রাজ্য সড়কে আনাড়া বাজারের কাছে এদিন বিকালে কার্যত অবরোধ হয়ে যায়। তবে সঙ্গে সঙ্গে পুলিশ সামাল দেয়। রাজ্য তৃণমূল কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদক তথা পাড়া বিধানসভার দায়িত্বপ্রাপ্ত কো-অর্ডিনেটর সুজয় বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, " আমরা নির্বাচন কমিশনের দুই আধিকারিকের নামে অভিযোগ করেছি। নির্বাচন কমিশনের কারণেই ওই আদিবাসী বৃদ্ধ মানুষটি আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়েছেন। তার বাড়িতে শুনানির নোটিশ আসার পর তিনি এতটাই আতঙ্কিত হয়ে গিয়েছিলেন যে খাওয়া বন্ধ করে দিয়েছিলেন। একজন আদিবাসী যিনি এদেশের মূলবাসি তাকেও প্রমাণ দিতে হবে তিনি এ দেশের নাগরিক? দেশ স্বাধীনতা লাভের আগে তার জন্ম হয়েছে। একজন আদিবাসীকে মরে প্রমাণ দিতে হচ্ছে যে সে দেশের আদিম অধিবাসী। এর চেয়ে লজ্জার আর কিছু হতে পারে না।" গত সোমবার দুপুর ১ টায় তার শুনানির দিন ছিল পাড়া ব্লক কার্যালয়ে। সকাল আটটা নাগাদ ঘর থেকে বার হয়ে বাড়ির অদূরে রেললাইনে তার ক্ষতবিক্ষত মৃতদেহ উদ্ধার হয়। পুরুলিয়ার পুলিশ সুপার বৈভব তেওয়ারি বলেন, " পাড়ার ঘটনায় একটি অভিযোগ জমা পড়েছে। আমরা ওই ঘটনার অনুসন্ধান করছি। "
পুরুলিয়া জেলা তৃণমূলের কথায়, আসলে এই প্রান্তিক জনজাতিদের কাছে সব রকম নথিপত্র থাকে না। আদিবাসী সেটাই তাদের কাছে সবচেয়ে বড় পরিচয়। আনাড়া গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকার বাসিন্দা তথা জেলা তৃণমূল ছাত্র পরিষদের সভাপতি কিরিটি আচার্য বলেন, "ওই বৃদ্ধ মানুষটির ২০০২ সালের ভোটার তালিকায় নাম পর্যন্ত ছিল। ২০২৫-র ভোটার তালিকায় নাম রয়েছে। সঠিকভাবে এনুমারেশন ফর্ম জমা দিয়েছেন। তবু তার খসড়া তালিকায় নাম নেই। আবার বলা হচ্ছে এনুমারেশন ফর্মের তথ্য ডিজিটাইজেশন করার সময় অনলাইনে ২০০২ সালের তার নাম দেখা যায়নি। এই গলদ কি ওই বৃদ্ধের? নাকি কমিশনের? এই জবাব দিতে হবে।"
এদিন আনাড়া এলাকায় ওই আদিবাসী বৃদ্ধের মৃতদেহ শববাহী গাড়িতে নিয়ে তুমুল বিক্ষোভ হয়। তৃণমূল কংগ্রেসের এই বিক্ষোভ কর্মসূচিতে গাড়ির সামনে হাজির ছিলেন তার একমাত্র ছেলে দিনমজুরির কাজ করা কানাই মাঝি। বাবার আত্মহত্যার পর শোক গ্রাস করেছে তাকে। এতটাই চুপচাপ হয়ে গিয়েছেন যে মুখ দিয়ে কথা বার হচ্ছে না। তার কথায়, " আমি এই ঘটনার বিচার চাই। আমার পরিবার এই ঘটনার বিচার চাইছে। সেই কারণেই আমি পাড়া থানায় অভিযোগ করেছি। বাবা শুধুমাত্র আতঙ্কিত হয়ে মারা গেল। এর জন্য কমিশন দায়ী।"
এদিন তৃণমূলের এই প্রতিবাদ কর্মসূচিতে এই এলাকার নেতা-কর্মীরা ছাড়াও এলাকার বহু মানুষ শামিল হন। পুরুলিয়া জেলা তৃণমূল সভাপতি তথা বান্দোয়ানের বিধায়ক রাজীবলোচন সরেন বলেন, "নির্বাচন কমিশন ভোটের সময় বয়স্ক নাগরিকরা যাতে ভোট দিতে পারেন তার জন্য আধিকারিকদেরকে ঘরে পাঠিয়ে দেন। আর এখানে আদিবাসী বৃদ্ধ মানুষজনদেরকে যাতে ভোটার তালিকা থেকে বাদ দেওয়া যায় তার জন্য শুনানিতে ডাকা হচ্ছে। কমিশনের কোথাও কোন বিধি নেই। শুধু হোয়াটস্যাপ করা হচ্ছে। আমরা এই ব্যবস্থাপনার প্রতিবাদ জানাচ্ছি।" এদিনের প্রতিবাদ মিছিল, বিক্ষোভ, সভায় আদিবাসী জনজাতির ওই বৃদ্ধের মৃত্যুকে নিয়ে নানান প্ল্যাকার্ড ছিল। যেখানে নিশানা করা হয়েছিল কমিশনকে।
