'আমার হারানোর কিছু নেই...', 'দেবী চৌধুরানী' মুক্তির আগে মন উজাড় করে কথা বললেন প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়। শুনলেন শম্পালী মৌলিক।
‘দশম অবতার’-এর পর এবছর আবার পুজোয় আসছেন ‘দেবী চৌধুরানী’ নিয়ে।
- হ্যাঁ, গত বছরটা হয়নি। বাংলা ছবি হিসাবে, অনেকটা খেটে, খরচ করে আমরা বানিয়েছি। বঙ্কিমচন্দ্রর উপন্যাস নিয়ে বাংলা ছবি করা সম্ভব হয় না, কারণ বড় স্কেল। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাহিনি নিয়ে তাও হয়। বঙ্কিমবাবুর ‘কপালকুণ্ডলা’, ‘আনন্দমঠ’ বা ‘দেবী চৌধুরানী’ ওঁর প্রত্যেকটা গল্প লেখার ধরন বড়। ফিকশনাল আর নন-ফিকশনাল চরিত্রকে উনি মেশাতেন। এই ছবিটা ভারত আর ব্রিটেন সরকারের যৌথ প্রযোজনা। ফলে ছবিটা তৈরি করেও, সব কাজ শেষ করতে অনেকটা সময় লেগেছে। যে কারণে, মে মাসে রিলিজ করা যায়নি। পরে ১৩ আগস্ট ভেবেও, প্রযোজকরা আনেননি কারণ অন্য একটি ছবি আসছিল। তাঁরা বলেছিলেন, বড় একটা উৎসবে আনতে চান। তবে পুজো প্ল্যানড ছিল, তা নয়। সব সিনেমার রিলিজ ডেট প্ল্যান করেই হয়, এমনটা নয়। যেমন– ‘অযোগ্য’ এসেছিল অফ পিরিয়ডেই। তাও হাউসফুল গিয়েছিল সকাল থেকে। ‘দেবী চৌধুরানী’ মনে হয় মানুষ পুজোর সময় দেখবেন।
প্রতিযোগিতাও রয়েছে...
- সেই ছবিগুলোও মানুষ দেখবেন। আমি চাইব, সবগুলো ছবি ব্যবসা করুক। বাংলা সিনেমার মধ্যে এমন বিরোধিতা আসা উচিত নয়, যে ‘আমি দেখিয়ে দেব’ ব্যাপারটা চলে আসে। সিনেমা না, কেউ দেখাতে পারে না। তাহলে ‘অঙ্ক কী কঠিন’ মানুষ দেখত না। একটা সময় অবধি হয়তো দেখানো যায়, তারপর দর্শক। বঙ্কিমবাবুর কানেক্ট এবং যেভাবে শুভ্রজিৎ বানিয়েছে...।
কীভাবে বানিয়েছেন?
- ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আর্কাইভের তথ্য ও ইতিহাস ঘেঁটে বানিয়েছে। এই ছবিটা কিন্তু দাদু-দিদারা নাতি-নাতনিদের নিয়ে যাবে। ১৭৭০-এর মন্বন্তরে পঁচাত্তর ভাগ মানুষ মারা গিয়েছিল বাংলায়, হয়তো অনেকেই জানেন না। ওই সময় দাঁড়িয়ে একজন সন্ন্যাসী যাকে তারা ডাকাত নাম দিয়েছিল, সে লড়াই করেছিল ট্যাক্সের বিরুদ্ধে। তখন ব্রিটিশ সবে ঢুকেছে দেশে, তারা জমিদারদের হাতে নিয়ে ট্যাক্সের লেভেল এমন জায়গায় নিয়ে গিয়েছিল, যাতে গরিব-সাধারণ মানুষ মারা পড়ছিল। একজন ফকিরও রয়েছে সেখানে। যেটা আমাদের গল্প না হলেও তাকে আনা হয়েছে। বাকিটা পর্দায় দেখবেন। দেবী চৌধুরানী নারীশক্তির গল্প। আজও প্রত্যেক মহিলা রিলেট করবেন। আমার ধারণা মা, বোন, বউদি প্রতিটি মহিলা আজও লড়াই করছে। ভবানী পাঠক একটা স্ট্রেন্থ, যে মানুষ শিব এবং কালীর পুজো করতেন, সাধক মানুষ। আমি তো ‘লালন’ করেছি, ওটা ছিল মিউজিকাল সাধক। ‘অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি’ও মিউজিকাল সাধক। ভবানী পাঠক করলাম, যিনি যোদ্ধা-সাধক।
দীনেন গুপ্ত ‘দেবী চৌধুরানী’ করেছিলেন, যেখানে ‘ভবানী পাঠক’ করেছিলেন বসন্ত চৌধুরি। আপনার তা নিশ্চয়ই দেখা?
- অনেক কম বয়সে দেখেছি। দীনেন জেঠু খুব সুন্দর বানিয়েছিলেন। বসন্ত জেঠুকে আমার এখনও মনে আছে। শেখর চট্টোপাধ্যায়ের রঙ্গরাজ অসামান্য। আর যতই ভবানী পাঠক বা দেবী চৌধুরানীকে (শ্রাবন্তী) নিয়ে কথা হোক, আমাদের এই ছবিতে বেরিয়ে আসবে রঙ্গরাজ (অর্জুন চক্রবর্তী) আর নিশি (বিবৃতি চট্টোপাধ্যায়), ফাটিয়ে করেছে।
ছবি: ইনস্টাগ্রাম
শুভ্রজিৎ বলেছেন, আপনি না করলে ছবিটা করতেন না।
- কিছু চরিত্র আমি পেয়েছি আমার অভিজ্ঞতা বা বয়স বা 'অরা'-র কারণে। যেমন– গৌতমদা যখন ‘লালন’ করার জন্য বলেছিল, আমি বলেছিলাম, আমাকে মানায় না। ‘সুভাষ বোস’-এর ক্ষেত্রেও বলেছিলাম। কিন্তু গৌতমদা আর সৃজিতের প্যাশন, আমার বিশ্বাস মিলে হয়েছিল। গৌতমদা আমি শহুরে মানুষ জেনেও, আমার চোখটা ব্যবহার করেছিল। মনে হয়, শুভ্রজিৎ ভবানী পাঠকের ক্ষেত্রেও আমার প্রেজেন্স আর চোখটা ব্যবহার করেছে।
এক্ষেত্রে ‘কিক’টা কী ছিল?
- আমি বায়োপিক মাস্টার হয়ে গেছি (হাসি)। আশা করি, প্রত্যেকটা মানুষ মনে রাখবে। সবথেকে বড় কথা, অসামান্য লিখেছে শুভ্রজিৎ। বাংলার বাজেটে এই ছবি করা শক্ত। যখন প্যানডেমিক গেছে তখনকার কথা এটা। তবে প্রযোজকরা, অপর্ণা দাশগুপ্ত ও অনিরুদ্ধ দাশগুপ্ত করল। দ্বিতীয় হল, সব কাজেই এখন একটা ফেদার অ্যাড করতে চাই। বঙ্কিমবাবুর লেখা গল্পে কাজ আমি মিস করতে চাইনি। আমার হারানোর কিছু নেই। এখন যেমন বাবুদাকে বলি, সত্যজিৎ রায়ের লেখা গল্পে আমাকে এক সিনের পার্ট দিন। সবটাই করেছি, তবু মনে হয় এইটুকু কেন বাকি থাকবে।
প্রচুর অ্যাকশন আছে। বিশাল উঁচু বটগাছ থেকেও নিজে লাফ দিয়েছেন এই বয়সে।
- এই অ্যাকশনটা ক্লাসিক অ্যাকশন। শুভ্রজিৎকে মাথায় নিয়েই বলছি, ক্লাসিক ছবি, তার সঙ্গে কমার্শিয়াল ব্লেন্ড। মাস্টারজিরা যখন রিহার্সাল করে, আমি না তাকিয়েও শট দিতে পারি। এক সময় তিনটে শিফটে ফাইটিং করেছি। একদিনে করে দিতাম তিনটে প্রযোজকের জন্য।
দুটো পিরিয়ড ফিল্ম এবার ‘রঘুডাকাত’ এবং ‘দেবী চৌধুরানী’। তুলনা আসবেই।
- তুলনাটা পিরিয়ড নিয়ে আসবে। তবে ওটা ফোকলোর। আর দেব যেভাবে নিজেকে প্রেজেন্ট করছে সেটা হওয়া দরকার ছিল। ও মেনস্ট্রিমের দরজা নতুন করে খোলার চেষ্টা করছে। আই অ্যাপ্রিশিয়েট দ্যাট। সেই দরজা খোলা আমাদের সকলের প্রয়োজন। বহু বছর আগে আমি লড়াই করেছিলাম ‘শ্বশুরবাড়ি’ আর ‘প্রতিবাদ’ নিয়ে। নতুন ওয়েভ এসেছিল। আমি চাই, যদি আমার ছেলে বাংলা ছবি করে, এমন একটা মার্কেটে করুক যখন সে তিন কোটি টাকা চাইতে পারবে। আমি যখন ‘শ্বশুরবাড়ি জিন্দাবাদ’ বা ‘প্রতিবাদ’-এর লড়াই করেছিলাম, যে আমাদের এইখানে দাঁড়িয়ে থাকলে হবে না, বাড়তে হবে। আমার পরের প্রজন্মের থেকে আমি সেটাই আশা করি। দেব খুব সৎভাবে সেটা করছে। আমাদের ছবির ধরন এক হলেও, দর্শক আলাদা। দুটো ছবিই ভালো চলবে। আর দুই ডাকাতের লক্ষ্যই ব্রিটিশ তাড়ানো (হাসি)।
দেব তথা নতুন প্রজন্ম প্রচার কৌশলে বাজিমাত করছে। সেখানে আপনাদের স্ট্র্যাটেজি কী হতে চলেছে?
- আমাদের ক্ষমতা নেই অনেক কিছু করার, মানে প্রযোজকের কথা বলছি। মার্কেটিং স্ট্র্যাটেজি-বাজেট মিলিয়ে বলছি। এখানে ওরা দুটো হাউস মিলেছে। আমরা নিজেদের কানেকশনে কিছু করতে পারি। এই যে দেব, দ্বিতীয়বার ছবির জন্য বেঙ্গল টুর করছে। আই অ্যাপ্রিশিয়েট। বম্বের কাজের ক্ষেত্রেও দেখি, তারা অল ইন্ডিয়া টুর করে। কারণ তাদের মার্কেট সারা ভারত। এটা তো ঠিক, আমাদের ছবির পয়সা বহরমপুর, মেদিনীপুর, মালদহ, বর্ধমান ইত্যাদি থেকে আসে। আমি ওর লড়াইয়ের সঙ্গে আছি। কিন্তু ‘দেবী চৌধুরানী’র সেই ক্ষমতা নেই। আমরা আমাদের মতো করে মানুষের কাছে পৌঁছব।
প্রাইম টাইমে বাংলা ছবি বাধ্যতামূলক হয়েছে। তবু চারটে ছবির শো পাওয়া নিয়ে লড়াই তো থাকবে।
- প্রাইম টাইমে বাংলা ছবি বাধ্যতামূলক হওয়াটা খুব ভালো হয়েছে। আমরা কয়েকজন সেদিন সকালে চিঠিতে সই করেছিলাম। দেব আমাকে ফোন করেছিল। হিন্দি ছবির সঙ্গে লড়াই তো আমরা কবে থেকে লড়ছি। মুখ্যমন্ত্রীকে দেওয়া চিঠিতে প্রথম সই বোধহয় আমারই ছিল। ছয়ের দশকে বাংলা ছবি বাঁচানোর কমিটিতে ছিলেন সুনীলদা, সমরেশদা, আরও অনেকে। সেই থেকে আজও আমরা লড়াই করছি। যার ফলে আজকে জিনিসটা হল। আজকের নিয়মটা সৎভাবে ব্যবহার হলে, ইন্ডাস্ট্রির সবাই বাঁচবে।
চারটে ছবির ভাগ্য কী?
- ‘রঘুডাকাত’ ফাটিয়ে ব্যবসা করবে, ‘রক্তবীজ টু’ ও ভালো করবে। ‘দেবী চৌধুরানী’ তার মতো করে ভালো ব্যবসা করবে। আর আমি তো অনীকের ছবির ফ্যান। কালেকশনে কেউ একশো, সত্তর বা পঞ্চাশ পাবে। দ্যাট ইজ ফাইন।
সোশাল মিডিয়া হাতে আসার ফলে মানুষ মুহূর্তে হিরোকে জিরো করে দিতে পারে বা মাটিতে নামিয়ে আনতে পারে। যে অভিজ্ঞতা আপনারও হয়েছে কিছুদিন আগে। কী বলবেন?
- ওটার জন্য আমি প্রস্তুত ছিলাম না। মানুষ হিসাবে ৪২ বছর কাজ করছি, তখন সোশাল মিডিয়া ছিল না। কোনও দিন আমার মুখ থেকে এমন শব্দ, কাউকে আঘাত করে, এমন রেকর্ড কেউ দেখাতে পারবে না। ওটা অদ্ভুত মিস কমিউনিকেশন হয়েছিল। আমি যদি আমার ভাষাকে অস্বীকার করি, সেটার মানে আমার মাকে আমি অস্বীকার করছি। সেটা অসম্ভব। আমার কোনও কথায় তোমরা আঘাত পেয়ে থাকলে, আমি দুঃখিত। আঘাত দেওয়ার মতো কথা বা তেমন আচরণ আমার নেই। কষ্টটা কোথায় জানো? আমার মতো বা আমাদের সময়ের এমন অনেকে আছেন, মানুষ তাঁদের চেনেন, তাঁদের এত বছরের অবদান – সেক্ষেত্রে সোশাল মিডিয়ায় মানুষটাকে জাজ না করে প্রশ্ন করতে পারত। আগে যেটা প্রিন্ট মিডিয়া প্রশ্ন করত। রিকোয়েস্ট করব সোশাল মিডিয়ায় জাজমেন্টাল না হয়ে প্রশ্ন করতে।
