বিশ্বদীপ দে: ১৯৫৪ সাল। মস্কো বিমানবন্দর লোকে লোকারণ্য। অসংখ্য মানুষের চিৎকার, জয়ধ্বনি, হর্ষোল্লাস কেবল... কেবলই একজনের জন্য। তিনি রাজ কাপুর। তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের ঘরে ঘরে তখন তাঁর নাম। শেষে রাজ ট্যাক্সিতে উঠলে সেই ট্যাক্সিই নাকি কাঁধে তুলে নেন অনুরাগীরা! কাট টু আটের দশক। গোটা সোভিয়েত পাগল একটাই গানে- 'জিমি জিমি জিমি আজা আজা আজা...' মিঠুন চক্রবর্তী নামের এক বঙ্গতনয়ের ডান্স মুভে মেতে উঠেছিল দেশটা। সেই জাদু পরেও ফিকে হয়নি।
শাহরুখ খানের 'পাঠান'-এর অ্যাকশন কিংবা 'পুষ্পা'র 'উ আন্টাভা'র মতো গানে বুঁদ থেকেছে হালফিলের রাশিয়া। সদ্যই দু'দিনের ভারত সফরে এসেছিলেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। ব্যস্ত ও সংক্ষিপ্ত সফরেও পুতিনের মুখে কিন্তু রাজ কাপুরের নাম শোনা গিয়েছে। ভারত-রাশিয়ার দীর্ঘ সময়ের বন্ধুত্বের কথা বলতে গিয়ে বলিউডের কিংবদন্তি তারকার নাম উচ্চারণ করেন তিনি। যা বুঝিয়ে দেয়, মস্কো-নয়াদিল্লি সম্পর্কের ইতিবৃত্তে টিনসেল টাউনের জাদুস্পর্শের সমীকরণকে।
১৯৬২ সালে মস্কো ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে রাজ কাপুর
জনতার কাঁধে ট্যাক্সি সমেত রাজ কাপুর
এই ম্যাজিকের সূচনা, আগেই বলেছি গত শতকের পাঁচের দশকে। রাজের পুত্র ঋষি কাপুর তাঁর আত্মজীবনী 'খুল্লম খুল্লা'-তে লিখেছিলেন বাবার সঙ্গে সোভিয়েত মুলুকে গিয়ে তিনি কীভাবে বিস্মিত হয়েছিলেন। ১৯৭৪, ১৯৭৬, ১৯৭৮ ও ১৯৮০ সালে তসখন্দ ও মস্কোয় হওয়া চলচ্চিত্র উৎসবে যোগ দিয়েছিলেন রাজ কাপুর। সেই সময় ঋষি কাছ থেকে দেখেছিলেন তাঁর বাবাকে প্রায় দেবতুল্য জ্ঞান করা হয় সেই সুদূর বিদেশে। ঋষি লিখেছিলেন, 'বয়স্কা মহিলারা রক্তমাংসের মানুষটাকে চোখের সামনে দেখে বিশ্বাস করতে পারছিল না। কাঁদছিল অঝোরে। ওঁর হাতে চুমু খাচ্ছিল।' ১৯৫৪ সালে প্রথমবার যখন রাজ সেদেশে যান, তাঁর ভিসাও ছিল না! বরাবরের কড়া সোভিয়েত প্রশাসন কিন্তু তাঁকে সেদেশে প্রবেশাধিকার দিতে একবারও ভাবেনি।
১৯৫১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নে মুক্তি পেয়েছিল 'আওয়ারা'। দেশের মাটিতে যা মুক্তি পেয়েছিল বছর তিনেক আগে। জানা যায়, বিদেশ বিভুঁইয়ের একটা ছবির টিকিট বিকিয়েছিল সাড়ে ৬ কোটি! সোভিয়েত ইতিহাসে সবচেয়ে সফল বিদেশি ছবির তালিকায় যা তৃতীয় নাম! 'আওয়ারা' ছবিটি সেদেশে মুক্তি পেয়েছিল ডাবড সংস্করণ হিসেবে। কিন্তু 'আওয়ারা হুঁ' বা অন্য গানের ভাষান্তর করা হয়নি। সেগুলি ছিল হিন্দিতেই। তবে তাতে কোনও অসুবিধা তো হয়নিই, বরং ভাষার প্রতিকূলতাকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়েছিল সুরের জাদু। এবং অবশ্যই পর্দাজুড়ে রাজ কাপুরের অতুলনীয় ক্যারিশমা। মনে রাখতে হবে 'সে বড় সুখের সময় নয়, সে বড়ো আনন্দের সময় নয়'। সদ্যই শেষ হয়েছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। তার ক্ষত তখনও দগদগে। অন্যদিকে ভারত সবে স্বাধীনতা পেয়েছে। সেই সদ্য স্বাধীন দেশের এক অভিনেতার শরীরী ভাষায় রাশিয়ার মানুষ খুঁজে পেল আশা ও ন্যায়বিচারের জয়গান।
'শোম্যান' রাজ কাপুর
পরবর্তী সময়ে 'শ্রী ৪২০' কিংবা 'সঙ্গম'-এর মতো ছবিও ঝড় তুলেছিল সোভিয়েত মুলুকে। 'মেরা জুতা হ্যায় জাপানি' কিংবা 'জিনা ইঁহা মরনা ইঁহা'র মতো গান লোকের মুখে মুখে ঘুরেছিল। এক ফিল্ম গবেষক ১৯৮৫ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নে পৌঁছে বলেছিলেন, ''তিনজন ভারতীয় এই দেশে নায়ক। একজন জওহরলাল নেহরু, অন্যজন ইন্দিরা গান্ধী। আর তৃতীয় জন অবশ্যই রাজ কাপুর।'' রাজ কাপুরের মৃত্যুর বহু পরে ২০১১ সালে রাশিয়া সফরে যান তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং। তাঁর সামনে ক্রেমলিনের প্রেসিডেন্সিয়াল অর্কেস্ট্রায় বেজে উঠেছিল 'আওয়ারা হুঁ'! এটাই রাজ কাপুরের ম্যাজিক। এটাই বলিউডের জাদু।
জিমি জিমি জিমি
গত শতকের আটের দশকে 'ডিস্কো ডান্সার' মুক্তি পেতেই ঝড় তুলে দিয়েছিল। এক বঙ্গসন্তান পায়ের তলায় জমি খুঁজে পেলেন। কেবল জমি খুঁজে পাওয়াই নয়, রাতারাতি অমিতাভ বচ্চন নামের মহাজ্যোতিষ্কর আলোকেও টক্কর দিতে শুরু করেন মিঠুন চক্রবর্তী... কিছুটা সময় আগেও যিনি ছিলেন একজন স্ট্রাগলার। সেটা ১৯৮২ সাল। বছর দুয়েক পরে ১৯৮৪ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নে মুক্তি পায় ছবিটি। পশ্চিমি পৃথিবীর প্রতি সন্দিগ্ধ সোভিয়েত রাশিয়ায় এমনিতে ডিস্কো খুব যে জনপ্রিয় তা নয়। কিন্তু মিঠুনের ছবিটা তো ভারতীয় ছবি। সেখানে একদিকে নাচ, অন্যদিকে অভিনয়, আবেগ ও সর্বোপরি বলিউডি মশলার দুরন্ত মিশ্রণ।
রাতারাতি রুশ কন্যাদের হার্টথ্রব হয়ে ওঠেন মিঠুন
সোভিয়েতের সর্বকালের সবচেয়ে সফল ২৫টি ছবির মধ্যে ঢুকে পড়েছিল 'ডিস্কো ডান্সার'। সেই দশকের সবচেয়ে বাণিজ্যসফল চতুর্থ ছবি। 'জিমি জিমি' রাতারাতি 'সেনসেশন' হয়ে উঠেছিল। শোনা যায় সেই সময় রেডিও থেকে শুরু করে বিয়েবাড়ি, সোভিয়েত ইউনিয়নের পাড়ায় পাড়ায় বাজত বাপ্পী লাহিড়ির সুপারহিট গান। এমনকী, বহু রুশ তাঁদের পুত্রসন্তানের নামও রাখলেন এই নামেই। ঠিক কেন যে ওই গান রুশদের মনের ভিতরে সেঁধিয়ে গিয়েছিল এর কোনও সঠিক ব্যাখ্যা বিশেষজ্ঞরা দিতে পারেননি। হয়তো কোনও একটি কারণ নেই বলেই। হতে পারে মিঠুনের ক্যারিশমা বা বাপ্পীর 'ক্যাচি' টিউন কিংবা গানটির দৃশ্যায়নের নাটকীয়তা- কিংবা এগুলি সব মিলিয়েই তৈরি করেছিল অসামান্য জাদু। যে জাদুর ঘোর কেটে আজও বেরতে পারেনি রাশিয়া। পুতিনের আমলেও গানটির জনপ্রিয়তা বিদ্যমান।
'ডিস্কো ডান্সার'
নোরা ফতেহির লাস্য এবং...
'অশোকা' ছবির 'সান সানানা সান' গানটি নতুন সহস্রাব্দে অসম্ভব জনপ্রিয় হয়েছিল। পরবর্তী সময়ে নোরা ফতেহির কোমরের বাঁকে বাঁকে ধরা পড়েছে বহু রুশ তরুণের হৃদয়। নোরা এখানে দারুণ জনপ্রিয়। শাহরুখ খানের 'পাঠান'-এর অ্যাকশন কিংবা 'পুষ্পা'র সুপারহিট গান 'উ আন্টাভা'-ও তাঁদের আনন্দ দেয়। ভাষার প্রতিবন্ধকতা এখানে একেবারেই কার্যকর হতে পারে না। রাজ কাপুরের সেই সোভিয়েত সফরের পর সাত দশক কেটে গিয়েছে। গোটা পৃথিবী বদলে গিয়েছে। সোভিয়েত থেকে রাশিয়া জন্ম নিয়েছে। ভারতেও বহু পরিবর্তন হয়েছে। কিন্তু বলিউড ও রাশিয়ার এই ম্যাজিকে কোনও পরিবর্তন ঘটেনি।
