শম্পালী মৌলিক: বদলের বাংলাদেশে সংস্কৃতির উপর আঘাত। কট্টরপন্থীদের তাণ্ডবে গুঁড়িয়ে গিয়েছে ছায়ানট! ভেঙে ফেলা হয়েছে, পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে শয়ে শয়ে বাদ্যযন্ত্র। দ্বেষের বাংলাদেশে কনসার্ট চলাকালীন শুক্রবার রাতে হামলার মুখে পড়তে হয় জেমসকেও। জেমস, সেই শিল্পী যিনি বাংলাদেশকে বিশ্বের সাংস্কৃতিক মানচিত্রে উল্লেখযোগ্য জায়গায় পৌঁছে দিয়েছেন। তাঁর অনুষ্ঠানেই কিনা কট্টরপন্থীদের ইটবৃষ্টি! এহেন বিশৃঙ্খল পরিস্থিতিতে নিরাপত্তার কথা মাথায় রেখে শেষমেশ মঞ্চ ছাড়তে বাধ্য হন জেমস। সাম্প্রতিককালে এহেন অনভিপ্রেত অভিজ্ঞতার শিকার হয়েছেন ভারতীয় শিল্পীমহলের একাংশও। গোয়ালিয়রে কনসার্ট করতে গিয়ে শ্রোতা-অনুরাগীদের 'পাশবিক আচরণে' ক্ষুব্ধ হয়ে শো বন্ধ করে দেন কৈলাস খের। এপারে লগ্নজিতা চক্রবর্তী, মধুমন্তী মুখোপাধ্যায়রাও এহেন পরিস্থিতির শিকার। সেখান থেকেই প্রশ্ন উঠছে, কনসার্ট কিংবা অনুষ্ঠানে শিল্পীদের হেনস্তা করাই কি নতুন ট্রেন্ড হয়ে দাঁড়িয়েছে 'দায়িত্বজ্ঞানহীন' নাগরিকদের?
সংবাদ প্রতিদিন ডট ইন-এর তরফে যোগাযোগ করা হয়েছিল বাংলার সঙ্গীতজগতের প্রতিনিধিদের সঙ্গে। দেবজ্যোতি মিশ্রর মন্তব্য, "বাংলাদেশে এখন যে পরিস্থিতি দাঁড়িয়েছে, সেখানে জেমসের মতো শিল্পীকে যেরকমভাবে হেনস্তা করা হয়েছে, তাতে আমি স্তম্ভিত! ঘটনাটা জেনে অত্যন্ত খারাপ লাগছে। ভীষণ বেদনাময়। ব্যক্তিগতভাবে জেমসের সঙ্গে আমার ভীষণ গভীর সম্পর্ক। বিশ্বের সাংস্কৃতিক মানচিত্রে জেমস বাংলাদেশকে একটা অন্যতম জায়গায় নিয়ে গিয়েছেন। কলকাতা এবং বাংলাদেশ মিলিয়ে আমরা একসঙ্গে বহু কাজ করেছি। একে-অপরের স্টুডিওতে কাজ করেছি। ওঁর বাড়িতেও গিয়েছি। আমি যখন বাংলাদেশে কনসার্ট করতে গিয়েছি, জেমস এসেছেন। বাংলাদেশের ধৈর্যশীল মানুষকে আমি দেখেছি। ১ লক্ষ শ্রোতা জড়ো হয়েছিলেন আমার অনুষ্ঠানে। সেই বাংলাদেশ আজকে জেমসের মতো বড়মাপের শিল্পীকে অসম্মান করেছে, সেখান থেকেই আমার মনে হয়েছে বাংলাদেশ বহুবছর পিছিয়ে গিয়েছে।"
জেমসের কনসার্টে হামলার প্রতিবাদে সোচ্চার হয়েছেন অনিন্দ্য চট্টোপাধ্যায়ও। 'চন্দ্রবিন্দু'র অন্যতম মুখ্য শিল্পী জানালেন, "পশ্চিমবঙ্গে যখন ব্যান্ড নিয়ে এত হইচই শুরু হল, সেসময়ে দুই বাংলায় প্রচুর অনুষ্ঠান আমরা করেছি। জেমসের সঙ্গেও বহু অনুষ্ঠান করেছি। এই ধরনের অনুষ্ঠানে জেমস একজন অপরিহার্য শিল্পী। 'নগর বাউল' জেমসের জনপ্রিয়তার যে গল্প আমি শুনেছি, এরকম গল্প সত্যিই অন্য কোনও ব্যান্ডের শিল্পীকে নিয়ে শোনাই যায় না। এত মারাত্মক জনপ্রিয়তা ওঁর। শুক্রবারের ঘটনাটা আমি সোশাল মিডিয়া থেকে জানতে পারি। খুবই আতঙ্কিত হলাম দেখে। কারণ জেমসের মতো একজন সর্বজনগ্রাহ্য শিল্পীকে কোনও অনুষ্ঠানে যদি শুধুমাত্র গান গাওয়া নিয়ে এহেন অনভিপ্রেত ঘটনার সম্মুখীন হতে হয়, তাহলে সেই অন্যায় আমাদের শিল্পীদের মনেও আঘাত করে।"
শিল্পীদের উপর এহেন আঘাত হানার 'অপ-সংস্কৃতি'তে আতঙ্কিত শ্রাবণী সেন। গায়িকা জানালেন, "এই যে ধারা শুরু হয়েছে, সেটা দেখে আমি খুব ভেঙে পড়েছি! কীভাবে গানবাজনা করব জানি না। আর জেমস এত খ্যাতনামা শিল্পী। বাংলাদেশের প্রথমসারির শিল্পী। তাঁকে এভাবে আক্রমণ করা খুব অন্যায়।" জোজোর মন্তব্য, "আমরা যারা শিল্পী তারা তো মানুষকে আনন্দ দেওয়ার জন্যই সবসময়ে প্রস্তুত থাকি, কিন্তু গান বা নাচের মঞ্চে এইভাবে আক্রমণ করার বিষয়টা একেবারেই মেনে নেওয়া যায় না। কিছুদিন আগেই বাংলাদেশে যেভাবে হারমোনিয়াম তবলা ভেঙে দেওয়া হয়েছে, দেখে খুব কষ্ট হয়েছে। তারপর আবার জেমসের ঘটনা! ভীষণ কষ্ট হচ্ছে।" নচিকেতার প্রতিক্রিয়া, "শিল্পীরা বরাবর সফট টার্গেট। কনসার্টে গিয়ে ঝামেলা করে দুষ্কৃতীরা পেশী শক্তির প্রদর্শন করতে চায়।"
