সম্প্রতি সুমন ঘোষ পরিচালিত ‘দ্য স্ক্যাভেনজার অফ ড্রিমস’-এর স্ক্রিনিং হল কলকাতায়। ছবি নিয়ে আলাপচারিতায় সুদীপ্তা চক্রবর্তী। লিখলেন বিদিশা চট্টোপাধ্যায়।
সুমন ঘোষ পরিচালিত ‘দ্য স্ক্যাভেনজার অফ ড্রিমস’ (The Scavenger of Dreams) সম্প্রতি দেখলাম অ্যাক্রোপোলিস মলের সিনেপলিসে। সুদীপ্তা চক্রবর্তী (Sudipta Chakraborty), শার্দূল ভরদ্বাজ অভিনীত এই ছবি যে মানুষের কথা বলে তাঁরা আমাদের অচেনা নয়। আমাদের বাড়ির আবর্জনা সাফ করা তাঁদের জীবিকা। পরিচালক এই সাফাইকর্মীদের জীবন এতটাই কাছ থেকে দেখিয়েছেন যে, সিনেমা আর রুপোলি পর্দার ভেদাভেদ মাঝে মাঝেই ঘোলাটে হয়ে যায়। বিরজু (শার্দূল) এবং সোনার (সুদীপ্তা) সংসার। তাদের অভাব আছে কিন্তু সেটা বোঝাপড়ার বা ভালোবাসার অভাব নয়। মিউনিসিপ্যালিটির তরফ থেকে হাতে ঠেলা গাড়ির বদলে যখন ব্যাটারি চালিত গাড়ি এসে পড়ে তখনই সমস্যার শুরু। পুকুরপাড়ে বস্তিতে তাদের আস্তানা। বাবু বিবিদের ত্যাগ করা খেলনাটা, কেকটা, মোবাইলটা বাড়ি নিয়ে আসে, মেয়েকে গল্প শোনায়। বস্তির অন্যান্য মেয়েদের সঙ্গে সোনার ভালো সম্পর্ক। অন্যদিকে শার্দূলের আড্ডা জমে বাকি সাফাইকর্মীদের সঙ্গে সুখ-দুঃখের কথা বলে। ছবিতে সেই সব মানুষকে দেখে একবারও মনে হয়নি তাঁরা অভিনয় করছেন। আসলে করেননি। সেই গল্প শুনলাম অভিনেতা সুদীপ্তা চক্রবর্তীর কাছ থেকে।
ছবিতে ডেলিভারির কাজ করা আশা, যাকে তার বর মেরে তাড়িয়ে দিয়েছে, সে একার রোজগারে মেয়েকে মানুষ করে, তাকে বিয়ে দিয়ে বুড়ো বাবার দেখাশোনা করে। সে ছিল প্রত্যন্ত গ্রামের ঘোমটা দেওয়া বউ। এখন টি-শার্ট জিনস পরে কাজে বেরোয়। সুদীপ্তার কথায়, "ওর নাম আশা কুমারী সিং। ঝাড়খণ্ডের বাসিন্দা। সুমনদা যখন ‘আধার’ ছবিটা করতে সেখানে যায়, তখন আলাপ। সেখানে আশা লোকেশন কোঅর্ডিনেটর-এর কাজ করত। ওর জীবনের গল্পটা এক রেখে শুধু আমরা ডেলিভারি উওম্যান হিসাবে দেখিয়েছি।"
তাস খেলা এবং বাংলা খাওয়ার আড্ডায় যে যুবক গান গাইতে-গাইতে, দাদার মৃত্যুর কথা বলে কেঁদে ফেলে তার আসল নাম সঞ্জয়। গড়িয়ার দিকে সে সাফাইকর্মীর কাজ করে। শার্দূল ছবিতে অভিনয় করার আগে প্রায় সাত-আট দিন ধরে ওর সঙ্গে সঙ্গে ঘুরেছিলেন। সুদীপ্তা নিজে যোধপুর পার্কের বস্তিতে যেখানে তাঁর পরিচিত কাজের দিদি থাকেন সেখানে যাতায়াত করেছেন। কীভাবে সোনার চরিত্রের বাস্তবতা ফুটিয়ে তুললেন জানতে চাইলে সুদীপ্তা বলেন, "আমার কাছে খুব কঠিন ছিল না। এটা আমার চেনা পাড়া, চেনা বস্তি। আমার পরিচিত রানিদিদি সেখানেই থাকেন। রানিদিদি ছবিতেও আছেন। আমার সুইপার মঞ্জুর থেকে লুকটা নিয়েছি। ওর শাল জড়িয়ে, ওর পার্স হাতে নিয়ে শট দিয়েছি। আর হিন্দিটা আমার বাইশ বছরের ড্রাইভার দাদার সঙ্গে কথা বলার অভ্যাস।"
২০২০ সালে নিউ ইয়র্ক টাইমসে একটা খবর বের হয়। এক সাফাইকর্মী উচ্চবিত্তদের ফেলে দেওয়া নানান জিনিস দিয়ে নিজের ঘর সাজিয়ে খুব সুখে থাকেন। সেখান থেকেই শুরু। "সুমনদা আমাকে খবরটা পাঠান। তারপর এখানে রিসার্চ শুরু হয়। সুমনদা যখনই কলকাতা আসতেন আমরা সবাই মিলে বিভিন্ন লোকেশনে গিয়ে সময় কাটাতাম। ধাপার মাঠে গিয়েও বসে থেকেছি। বিভিন্ন সাফাই কর্মীর সঙ্গে কথা বলে তাদের গল্প বের করতাম। তারপর শুটের সময় এক একটা দৈনন্দিন ঘটনা ধরে ধরে শুট হত। কোনও স্ক্রিপ্ট ছিল না", বলছিলেন সুদীপ্তা।
ছবিটা এমন এক তারে বাঁধা যে দর্শক হিসাবে সাফাইকর্মীদের জীবন নিয়ে দুঃখ করার সুযোগ নেই। পরিচালক খুব সতর্ক থেকেছেন যাতে কোনওভাবেই দর্শক তাঁদের করুণা না করে, কারণ নিম্ন মধ্যবিত্ত এই পরিবার নিজেদের অবস্থা নিয়ে করুণা কিংবা হা-হুতাশ করে না। তার চেয়েও বেশি আছে এই শহুরে মধ্যবিত্তের নানান দ্বিচারিতার দিকে আলতো অঙ্গুলি নির্দেশ করা। আয়না দেখা সবসময় সুখকর হয় না। কিন্তু কখনই কারও প্রতি পক্ষপাত করা হয় না বা কোনও ইস্যুকেই দাগিয়ে দেওয়া হয় না। সেটা খুব স্বস্তির। আসলে জীবনে এভাবে ঠিক ভুল বলে দেওয়া যায় না। জীবন তো সাদা-কালো নয়। একটা দৃশ্যে স্ত্রী সোনার কথা শুনে বিরজু নিজের ইগো এবং পৌরুষের অহংকার জলাঞ্জলি দিয়ে আশার কাছে যায় স্কুটি শিখতে।
পুকুরপাড়ে কাপড় কাচতে কাচতে দূর থেকে সোনা ওদের দুজনকে দেখে। কী ভাবে সোনা, যখন ওদের এত কাছাকাছি দেখে? সোনা খুশি হয়? মজা পায়? ঈর্ষা বোধ করে? এটা কি মানুষের মুখ দেখে বোঝা যায় সব সময়? সোনাও দর্শককে বুঝতে দেয় না। সুদীপ্তা চক্রবর্তীকে এই দৃশ্যে মনে থাকবে অনেকদিন। এই একটা দৃশ্যে নানা স্টিরিওটাইপ ভাঙতে সক্ষম হয়েছেন সুমন ঘোষ। এই একটা দৃশ্য অনেক কিছুর ক্রস সেকশন তৈরি করেছে যেমন ইন্টারপার্সোনাল, সোশাল, ইকোনমিকাল, জেন্ডার ডায়নামিকস। এটাই এই ছবির ম্যাজিক। যাঁরা ছবিটা দেখেননি, আগামী মঙ্গলবারের জন্য বুকমাইশো খেয়াল রাখুন। অ্যাক্রোপলিস-এ আবার একটি শো হতে চলেছে।