পৌলোমী বর্মন, টোকিও: কাজের সূত্রে এদেশে এসেছি মাসখানেক হল। টোকিও অদ্ভুত সুন্দর জায়গা। খুব ডিসিপ্লিনড মানুষজন। প্রাকৃতিক শোভাও দারুণ। টোকিওকে ভারতের বাণিজ্যনগরীর সঙ্গে তুলনা করা যায়। কারণ, মুম্বইয়ের মতো জাপানের রাজধানী ঘুমায় না। সবসময় লোকজনের চলাচল দেখতে পাবেন এই শহরে। কিন্তু নোভেল করোনা ভাইরাস থাবা বসানোর পর সেই প্রাণচঞ্চল টোকিও শহরও যেন ঝিমোচ্ছে। মানুষ চলাচল কম। দর্শনীয় স্থানগুলো বন্ধ। স্কুল-কলেজে স্টাডি ফ্রম হোম। রাতের দিকে আগে কত লোকজন থাকত। এখন অনেক ফাঁকা।
আপনারা এতদিনে নিশ্চয়ই জেনে গিয়েছেন, চিনের হুবেই প্রদেশে কোভিড-১৯-র সূত্রপাত। আর চিন-জাপান পাশাপাশি দেশ। ব্যবসায়িক কারণে এই দুই দেশের বৈদেশিক সম্পর্কও ভাল। গত জানুয়ারি মাসে চাইনিজ নিউ ইয়ার ছিল। প্রতি বছর এই নববর্ষ উপলক্ষে বেজিং বা চিনের নানা প্রান্ত থেকে বহু মানুষ আসেন জাপানে। এবছর সেটা হয়নি। নেপথ্যে নোভেল করোনা ভাইরাস। আসলে এই মারণ ভাইরাস এদেশে ছড়িয়ে পড়তে পারে জেনে আগেভাগেই শিনজো আবের প্রশাসন তৈরি ছিল। ইউরোপের দেশগুলো না-পারলেও করোনাকে কিন্তু একটু ভয় দেখাতে পেরেছে জাপান। কারণ, ইতালি-ইরানের তুলনায় সংক্রমণের গ্রাফ এখানে নিম্নমুখী।
[আরও পড়ুন: করোনার কামড়ে বিধ্বস্ত ইতালি ও স্পেন, বিশ্বজুড়ে একদিনে মৃত ১৬০০’র বেশি]
এর দুটো অন্য কারণও রয়েছে। আগেই লিখেছি, এখানকার মানুষ ডিসিপ্লিনড জীবনযাপন করেন। সামান্য হাঁচি-কাশি হলেই মাস্ক ব্যবহার করেন। যাতে অন্য কাউকে তাঁর রোগ কোনওভাবেই প্রভাবিত করতে না পারে। করোনা ভাইরাসের মতো মারণ রোগের জন্য জাপানিরা তাহলে কতটা সাবধানী হতে পারে, একবার ভাবুন! দ্বিতীয় কারণ, জাপানিরা সোশ্যালি আইসোলেটেড থাকতে পছন্দ করেন। সেটা কেমন? ধরুন, সামনে একটা ভীষণ মিষ্টি বাচ্চা। বেশিরভাগ ভারতীয়ই তাকে কোলে নেবে। বা একটু আদর করবেন। জাপানে সে সব নৈব নৈব চ। রাষ্ট্রনেতারা করোনা থেকে বাঁচতে করমর্দনের জায়গায় ‘নমস্তে’ করতে বলেছেন। জাপানিরা কিন্তু করমর্দনের ধারেকাছে নেই। কারণ, এখানে একে অপরকে দেখলেই ‘বাও ডাউন’। তাই করোনা কেন, অন্য যে কোনও ফ্লু জাপানিদের স্পর্শ করতে ভয় পাবে।
তবে কলকাতা এবং টোকিওর মধ্যে একটা মিলও রয়েছে। দুটো শহরের জনঘনত্ব বেশি। বাসে-ট্রেনে ভিড়। আপনি না দেখলে বিশ্বাস করবেন না। কিন্তু এটাই সত্যি। নিজের গাড়ি ব্যবহার করার থেকে পাবলিক ট্রান্সপোর্টেই ভরসা করেন টোকিওবাসী। যে কারণে বাসে-ট্রামে ভিড় হবে সেটাই স্বাভাবিক। জাপানের পাবলিক ট্রান্সপোর্ট কিন্তু খুব পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। পাশের মানুষটিও মাস্কধারী। কারও হাতে গ্লাভস। বলা ভাল, ওয়েল স্যানিটাইজড। যদিও আপাতত তথ্যপ্রযুক্তি কর্মীদের ওয়ার্ক ফ্রম হোম করে দিয়েছে। তার মধ্যেও যাঁদের এই পরিস্থিতিতে অফিসে যেতেই হবে, তাঁদের জন্য ট্রেন চলাচলের সময় বদল করা হয়েছে।
[আরও পড়ুন: সেরে উঠেছেন প্রায় ১ লক্ষ মানুষ! করোনার আতঙ্ক কাটিয়ে ঘুরে দাঁড়াচ্ছে বিশ্ব]
টোকিওতে এখন ‘শাকুরা সিজন’। অর্থাৎ চেরিব্লসম ফোটার সময়। এই সময়টায় এখানে এই চেরিব্লসম পার্কগুলোই মুখ্য আর্কষণের বস্তু। বিদেশ থেকে তো বটেই, জাপানিরাও এই মার্চ-এপ্রিলে টোকিও বেড়াতে আসেন। করোনা আতঙ্কে, সেই ঘোরাফেরায় লাগাম দিয়েছে প্রশাসন। পার্কগুলোতে ভিড় তেমন জমছে না। যে কারণে মার খাচ্ছে দেশের পর্যটনের ব্যবসা। করোনা-পরিস্থিতি কাটিয়ে ওঠার পর কোনদিকে যাবে বিশ্ব-অর্থনীতি, সেটাও চিন্তার বিষয়।
(লেখক : ইন্ডিপেন্ডেন্ট জার্নালিস্ট)
The post সংক্রমণ এড়াতে সামাজিক বিচ্ছিন্নতাই হাতিয়ার, করোনা রুখছেন জাপানিরা appeared first on Sangbad Pratidin.
