shono
Advertisement
Dilip Doshi

'কানহাইয়ের পরামর্শেই দেশের হয়ে খেলার ডাক পেয়েছিল দিলীপ', স্মৃতিচারণ রাজু মুখোপাধ্যায়ের

জাতীয় দলে বেদী থাকার কারণে সময় অনুযায়ী দেশের হয়ে খেলা হয়নি দোশীর।
Published By: Prasenjit DuttaPosted: 02:29 PM Jun 25, 2025Updated: 03:19 PM Jun 25, 2025

রাজু মুখোপাধ্যায়: দিলীপের চলে যাওয়ার খবরটা শোনার পর থেকে মনটা খুবই খারাপ হয়ে রয়েছে। ওর সঙ্গে আমার খুবই ভালো সখ্যতা ছিল। একসঙ্গে বাংলা খেলেছি। আমাদের সম্পর্কও বন্ধুত্বের ছিল। ওকে ওর বাড়ি থেকে গাড়িতে তুলে আমরা একসঙ্গে প্র্যাকটিসে যেতাম। প্রথম বার ইংল্যান্ড যাই যখন, ছ'সপ্তাহ ছিলাম ওর বাড়িতে। সেই দিলীপ এমন হঠাৎ চলে যাবে, বিশ্বাস করে উঠতে পারছি না।

Advertisement

বাংলার হয়ে বহুদিন খেলেছে দিলীপ। তবে ওর জন্ম কিন্তু সৌরাষ্ট্রের রাজকোটে। গোপালের (বসু) সময়বয়সি ছিল দিলীপ। দু'জনের কেরিয়ারের গতিপথও একইসঙ্গে এগিয়েছে বলতে পারেন। কলকাতায় আসার পর স্পোর্টিং ইউনিয়নে খেলা শুরু করে দিলীপ। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় দলেও সুযোগ পেয়েছিল। যেবার কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় প্রথম রোহিংটন বেরিয়া ট্রফি জেতে, সেই দলে গোপাল ছিল, দিলীপ ছিল। টিমের অধিনায়ক ছিল সুবীর গঙ্গোপাধ্যায়। অর্থৎ, দিলীপের কেরিয়ারটা দারুণভাবে শুরু হয়। কলকাতা বিশ্ববিদালয়ের হয়ে রোহিংটন বেরিয়া ট্রফি জিতে।

বাংলা দলে দিলীপ প্রথম সুযোগ পায় উনসত্তরে। চুনীদা (চুনী গোস্বামী)। অম্বরদার (অম্বর রায়) নেতৃত্বে খেলেছে দিলীপ। আবার ঘটনাচক্রে আমার অধিনায়কত্বেও খেলেছে। পরিষ্কার লিখছি, অত ভালো বোলার, অমন বাঁ-হাতি স্পিনার খুব কমই এসেছে দেশে। আমার মনে হয়, বিষেন সিং বেদীর জন্য যে সমস্ত বাঁ হাতি স্পিনার সময় মতো সুযোগ পায়নি, তার একজন দিলীপ। আমরা শিভালকর নিয়ে বলি। কিন্তু দোশীও তাই। জাতীয় দলে বেদী থাকার কারণে যার সময় অনুযায়ী দেশের হয়ে খেলা হয়নি। অথচ দোশী আরও আগে টেস্ট খেলতে পারত।

যাক গে। দিলীপ শেষ পর্যন্ত প্রথম টেস্ট খেলার সুযোগ পায় বত্রিশ বছর বয়সে। আর ওর টেস্ট খেলার নেপথ্য কাহিনিও বেশ অদ্ভুত। গল্পটা সুনীল গাভাসকরের মুখ থেকে শোনা। '৭৯ বিশ্বকাপের কথা বলছি। ভেঙ্কটরাঘবনের নেতৃত্বে ভারত ইংল্যান্ডে গিয়েছে ওয়ানডে বিশ্বকাপ খেলতে। সেই সময় একট অলিখিত দস্তুর ছিল যে, ভারত যেখানেই খেলতে যাক, একটা পার্টি দিত। নামিদামি ক্রিকেট বাক্তিত্বদের নিমন্ত্রণ করা হত। তা, তেমনই পার্টি দেওয়া হয়েছে। রোহন কানহাইয়ের মতো ক্যারিবিয়ান কিংবদন্তি এসেছে পার্টিতে। রাজন বালাও ছিল। তা সেই পার্টিতেই কানহাই ভারত অধিনায়ক ভেঙ্কটরাঘবনকে বলে, 'তোমরা এখনও বেদীকে খেলিয়ে যাচ্ছ কেন? দিলীপকে কেন খেলাচ্ছ না?' ভেঙ্কটরাঘবনের পাশে তখন দাঁড়িয়ে গাভাসকর। কানহাইয়ের কথা মন দিয়ে শুনছিল ও। কানহাইয়ের বিরাট ভক্তও ছিল গাভাসকর। ওয়েস্ট ইন্ডিজ কিংবদন্তির যুক্তি ছিল, বেদী নিঃসন্দেহে বড় বোলার। কিন্তু তাই বলে তার এক্সপায়রি ডেট নেই, এমন নয়। ভেঙ্কট বরং একটু 'কিন্তু-কিন্তু' করছিল দিলীপের বয়স নিয়ে। বলছিল, তিরিশ হয়ে গিয়েছে কানহাই শুনে বলে যে, 'তোমাকে তো দিলীপকে শেখাতে-পড়াতে হবে না কিছু। প্লেয়ার হিসেবে নিজেকে এসটাব্লিশ করে ফেলেছে ও। এত বছর ধরে রনজি খেলেছে। নটিংহ্যামের হয়ে কাউন্টি খেলেছে। সমস্যা হবে না।'

ভেঙ্কট তখন জানতও না, ভারতীয় দলে তার পর দিলীপ আসবে। কিন্তু ও নিজেই আর অধিনায়ক থাকবে না! ভেঙ্কটরা হিথরো থেকে ভারতের ফ্লাইট ধরার পর দেশের ক্রিকেট ইতিহাসের অন্যতম নাটকীয় অধ্যায়টি লেখা হয়। ফ্লাইট ক্যাপ্টেন আকাশে ঘোষণা করেন যে, ভেঙ্কটরাঘবনকে ড্রপ করা হয়েছে। ভারতের নতুন অধিনায়কের নাম সুনীল গাভাসকর। ঘটনা যে সম্পূর্ণ‌ বিহ্বল করে দেওয়ার মতো, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। যা-ই হোক। দেশে ফিরেই গাভাসরকে যেতে হল জাতীয় নির্বাচকদের সঙ্গে দেখা করতে। নির্বচকরা গাভাসকরকে জিজ্ঞাসা করলেন, বাঁ-হাতি স্পিনার হিসেবে তুমি কাকে চাও। গাভাসকর সরাসরি দোশীর নাম করল। নির্বাচকরা অবাক হয়ে গিয়েছিল শুনে। কিন্তু সানি সেই যুক্তিটাই দিল, যা ভেঙ্কটরাঘবনকে দিয়েছিল কানহাই। জাতীয় দলে ঢুকতে দিলীপের এরপর আর সমস্যা হয়নি। চেন্নাইয়ের প্রথম টেস্ট খেলে দোশী। ১৯৭৯-তে। কিম হিউজের অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে। দু'ইনিংসেই দুর্দান্ত বোলিং করল। ম্যাচে আট উইকেট নিল। দিলীপকে দেখে মনেই হয়নি, ও টেস্ট অভিষেক করছে। এত সলিড, এত ম্যাচিওর্ড দেখাচ্ছিল। এরপর বছর দুই-তিন দেশের হয়ে খেলল দিলীপ। কিন্তু তার পর দুর্ভাগ্যজনকভাবে চোটের কবলে পড়ে গেল। অস্ট্রেলিয়া সফর থেকে ফিরে আসতে হল। খুব সম্ভবত একাশিতে। সেই সিরিজে কপিল আর দোশী মিলে মেলবোর্ন টেস্ট জেতাল ভারতকে। কিন্তু তার পর সেই চোট আর দিলীপের দেশে ফিরে আসা। ওর বদলে দলের সঙ্গে যোগ দিল রবি শাস্ত্রী। পরে পাকিস্তান সফরে ডাক পেল দিলীপ। কিন্তু সেই সফরটা ভারতীয় বোলারদের জন্য একেবারেই ভালো ফায়নি। দিলীপেরও যায়নি। তা ছাড়া সেই সময় ওর বোলিংয়ের ধারও কমে এসেছিল অনেকটা।

পাকিস্তান সফরের পর দিলীপ আর ভারতের হয়ে খেলার সুযোগ পায়নি। মাঝে বাংলার হয়ে খেলল এক বছর। তার পর সৌরাষ্ট্র চলে গেল। সেখানে এক বছর কাটিয়ে আবার বাংলায় ফিরে এল। তার পর বাংলা পর্বও শেষ হল একদিন। খেলা ছাড়ার পর ক্রিকেটের সঙ্গে আর যোগাযোগ তেমন রাখেননি দিলীপ। ধারাভাষ্যে আসেনি। কোচিং করেনি। বড় ব্যবসা ছিল ওদের। তাই নিয়েই থাকত। কিন্তু আমি দিলীপকে ভুলতে পারিনি।

কখনও পারবও না। কী করবে ভুলব সেই লোককে, যে আমি বাংলা অধিনায়ক হওয়ার পরেও আমাকে বন্ধুত্বপূর্ণ বকাঝকা করত। আমার চিরকালই নবাব মনসুর আলি খান পতৌদির রিল্যাক্সড ক্যাপ্টেসি স্টাইল পছন্দ ছিল। অতশত ভাবতাম না আমি। কিন্তু দিলীপ বলত, 'তুই টিমকে আরও বেশি ইন্সপায়ার কর, মোটিভেট কর।' শুনে হাসতাম। ওকে বোঝাতে পারতাম না, বাংলার টুপি পরে কেউ মেটিভেটেড না হলে, কিছু করার থাকে না। দিলীপের মতো 'ওয়েল ড্রেসড' লোক আমি কম দেখেছি। সব সময় ফিটফাট-সুটেড-বুটেড। টাই পরা। আমি সেখানে হাওয়াই শার্ট পরতে পছন্দ করতাম। প্রায়ই আমাকে বলত, 'তুই হাওয়াই শার্ট পরছিস কেন? জামা 'টাক ইন' করে পর। দাড়িটা কাট।'

ক্রিকেটকে 'জেন্টেলমেন্স গেম' বলে। দিলীপ পৃথিবী ছেড়ে চলে যাওয়ায়, সেই 'জেন্টেলমেন্স গেম'-এর একজন জেন্টেলমেন ক্রিকেটার কমে গেল।

(অনুলিখন: রাজর্ষি গঙ্গোপাধ্যায়)

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

হাইলাইটস

Highlights Heading
  • দিলীপের চলে যাওয়ার খবরটা শোনার পর থেকে মনটা খুবই খারাপ হয়ে রয়েছে। ওর সঙ্গে আমার খুবই ভালো সখ্যতা ছিল।
  • একসঙ্গে বাংলা খেলেছি। আমাদের সম্পর্কও বন্ধুত্বের ছিল।
  • সেই দিলীপ এমন হঠাৎ চলে যাবে, বিশ্বাস করে উঠতে পারছি না।
Advertisement