সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে আমাদের মানসিকতা, আমাদের কর্মপদ্ধতিকে যদি পরিবর্তন করতে পারি তাহলে হয়তো আমরা কৃষিক্ষেত্রে আমাদের অবস্থান উন্নত করতে সক্ষম হব এবং আমাদের খামারের মান উন্নয়ন করতে পারব। এই পরিবর্তনে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখতে পারে কৃষিক্ষেত্রে ইন্টারনেটের বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধাগুলির সঠিক ও পর্যাপ্ত ব্যবহার। লিখেছেন পশ্চিমবঙ্গ রাষ্ট্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের রুরাল স্টাডিজ বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ড. বিশ্বজিৎ পাল।
আমাদের দেশে বিপুল সংখ্যক পরিবার কৃষিকাজ ও কৃষিজাত দ্রব্য উৎপাদন ও প্রক্রিয়াকরণের সঙ্গে যুক্ত, প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িত। হাজার হাজার বছরের এই পুরনো জীবিকার সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তার চাষপদ্ধতি, তার চাহিদা ও তার আনুষঙ্গিক বিষয়েরও পরিবর্তন ঘটেছে। আমাদের দেশের কথা ধরলে স্বাধীনতা পূর্ববর্তী পর্যায়ে যে ধরনের চাষ করা হত বা যে যে ফসলের চাষ করা হত, স্বাধীনতার পরবর্তী পর্যায়ে সেই পদ্ধতির বিপুল পরিবর্তন হয়েছে, আধুনিক প্রযুক্তির সাহায্যে। পূর্বে মূলত দেশীয় বীজ ব্যবহার করা হত এবং তার ফলস্বরূপ একটি নির্দিষ্ট সময়ের পর খাদ্যের চাহিদা অনুযায়ী আমরা ফসল ফলাতে সক্ষম হইনি।
[আরও পড়ুন: সাহেব রোগ সারলেই ঢেঁড়শে লক্ষ্মীলাভ, জেনে নিন সঠিক পদ্ধতিতে চাষের কৌশল]
ভারত সরকারের প্রযুক্তি নির্ভর কৃষি পরিকল্পনার সঙ্গে সঙ্গে উচ্চ ফলনশীল বীজ ও আধুনিক কৃষি সরঞ্জাম ব্যবহারের মাধ্যমে শুধু খাদ্যের চাহিদা মিটেছে তাই নয়, উপরন্তু আমরা খাদ্যসুরক্ষা ও কৃষিক্ষেত্রে স্বনির্ভর হয়েছি। যদিও এই পরিবর্তনের ভাল-মন্দ দুটি দিকই আছে। কিন্তু অর্থনৈতিক ও খাদ্যসুরক্ষার বিচারে এই পরিবর্তন গ্রহণযোগ্য। কিছু চাষি বন্ধু এই পরিবর্তিত চাষ পদ্ধতির পথিকৃৎ। অনেকে এই চাষ পদ্ধতিগুলি পরবর্তী পর্যায়ে ব্যবহার করেছেন আবার কেউ কেউ এখনও এই পরিবর্তিত চাষপদ্ধতিতে বিশ্বাস রাখেন না। যে কোনও পরিবর্তনের ক্ষেত্রে এই প্রবণতা খুবই স্বাভাবিক।
বর্তমান পরিস্থিতিতে চাষিকে শুধু ফসল ফলানো বা ফসল বাড়ানোর দিকে নজর দিলেই হবে না, প্রয়োজন খামারের মান উন্নয়ন। এই মান উন্নত করা তখনই সম্ভব, যখন আমরা আমাদের কাছে উপলব্ধ সুবিধাগুলি সর্বপ্রকারে এবং প্রয়োজন মতো ব্যবহার করতে পারব। আজ এখানে আমরা এই কৃষিক্ষেত্রে অন্যতম প্রযুক্তি নির্ভর সুবিধা আন্তর্জাতিক কৃষিক্ষেত্র নিয়ে আলোচনা করব। বর্তমানে ইন্টারনেটের বা আন্তর্জালের বহুল ব্যবহার লক্ষ করা যায় এবং প্রচুর সংখ্যক কৃষকের উপভোক্তা।
e-agriculture কী?
e-agriculture হল আন্তর্জালিক সুবিধাকে কাজে লাগিয়ে কৃষির উৎপাদন বৃদ্ধি, সঠিক মূল্যে বাজারজাত করা এবং কৃষিক্ষেত্রে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কমানো। e-agriculture -কে সঠিকভাবে বুঝতে হলে কৃষিক্ষেত্রে তার বহুমুখী দিকগুলি আলোচনা করতে হয়।
ক) আবহাওয়া সম্পর্কিত তথ্য: কৃষিক্ষেত্রে চাষিদের বড় ঝুঁকি নিতে হয় এবং তার অন্যতম কারণ আবহাওয়ার আকস্মিক পরিবর্তন। এখন ইন্টারনেটের সুবিধাতে খুব অল্প সময়ের মধ্যেই আবহাওয়া সম্পর্কে সতর্কবার্তা চাষিদের কাছে পৌঁছয়। চাষিরা ইচ্ছা করলেই তাঁদের অঞ্চল ভিত্তিক আবহাওয়ার পূর্বাভাসও পেতে পারেন।
খ) অনলাইন মার্কেট: ইন্টারনেট আমাদের পৃথিবীর সঙ্গে যুক্ত করে এবং চাষিরা তার অঞ্চলের তথা ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রান্তে ফসলের ক্রয়মূল্য, বিক্রয়মূল্য সম্পর্কে অবগত হতে পারেন। এইরকম সরকার পরিচালিত কিছু মোবাইল অ্যাপ্লিকেশন, ওয়েবসাইটও আছে যেখানে চাষিরা এই ধরনের পরিষেবাগুলি নিতে পারেন।
গ) চাষ পদ্ধতি সম্বন্ধে তথ্য: চাষপদ্ধতি জানার জন্য ইন্টারনেট একটি তথ্যভাণ্ডার, অঞ্চলভিত্তিক, আবহাওয়া অনুযায়ী ফসল নির্বাচন, চাষের উপকরণের তথ্য, চাষ পদ্ধতি, সেচ পদ্ধতি, সব কিছুই ইন্টারনেট থেকে জানা যায়। অনভিজ্ঞ চাষির পাশাপাশি অভিজ্ঞ চাষিরাও ফসল অনুযায়ী, মাটি অনুযায়ী সারের পরিমাণ, সারের ধরন, রোগপোকার শনাক্তকরণ ও ব্যবস্থাপনা ইত্যাদি সম্পর্কে বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহ করতে পারেন।
ঘ) উন্নত প্রযুক্তির ব্যবস্থাপনা: বিভিন্ন উন্নত চাষ পদ্ধতি যেমন উচ্চফলনশীল বীজ, ফসল কাটার যন্ত্র, বীজ বপণের যন্ত্র, অত্যাধুনিক ট্রাক্টর প্রভৃতির উপযোগিতা, ব্যবহার পদ্ধতি, মূল্য, ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে সহজেই জানতে পারা যায় বিভিন্ন আন্তর্জালিক মাধ্যম থেকে। ইউটিউবে বিভিন্ন প্রযুক্তি সম্পর্কিত ভিডিও এখন সহজলভ্য এবং বিনামূলে্য উপলব্ধ।
ঙ) ফসলের বিমা: ফসলের বিমা নথিভুক্ত করা, ক্ষতিপূরণ দাবি সহজেই ইন্টারনেটকে ব্যবহার করে করা যায়। যেমন– পশ্চিমবঙ্গ সরকারের বাংলা শস্য বিমা। সহজেই এই ওয়েবসাইট www.banglashasyabima.net নিয়ে চাষি নিজেই বিমা নথিভুক্ত করতে পারেন। শসে্যর ক্ষতি হলে তার বিস্তারিত সেখানে জানানো যায় এবং বিমা অনুযায়ী ক্ষতিপূরণ দাবি করা যায়।
চ) কৃষিঋণ: কৃষিঋণ কৃষকের কাছে একটি বড় পরিষেবা এবং সম্বলকে কাজে লাগিয়ে বহু কৃষক তাঁর চাষাবাদ করে থাকেন। আমাদের দেশে বিভিন্ন অঞ্চলে দুটি ফসলের মধ্যবর্তী সময়টা অনেক দীর্ঘ। সেখানে কৃষিঋণ পরবর্তী মরশুমের চাষের মূলধনের অন্যতম উৎস। সরকার কৃষি ঋণের জন্য বিভিন্ন ব্যাঙ্কের মাধ্যমে চাষিদের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করেছে। তার অন্যতম হল কিষান ক্রেডিট কার্ড (KCC)। চাষি খুব কম সুদে KCC-র মাধ্যমে কৃষিঋণ নিতে পারেন। ব্যাঙ্কে সশরীরে যাওয়ার পাশাপাশি ইন্টারনেটের মাধ্যমেও অনলাইনে KCC-র জন্য আবেদন করা যায় বিভিন্ন ব্যাঙ্কে।
ছ) কৃষি সম্প্রসারণ: কৃষি দপ্তরের সম্প্রসারণের কাজ যেমন চাষ সম্পর্কিত তথ্যপ্রদান, কৃষি কর্মশালা, কল সেন্টারের মতো কাজ অনেকাংশে ইন্টারনেট ব্যবহার করা হয়ে থাকে। কোভিড-এ এই দু’বছর তার প্রয়োগ আরও কয়েকগুণ বেড়েছে। কৃষি সম্প্রসারণের কিছু পর্যায় আন্তর্জালিক করে যেমন একই সময়ে অনেক তথ্য সম্প্রচার করা যায়। তেমনি অন্যদিকে এইক্ষেত্রে কোন অঞ্চলগত গণ্ডি না থাকার দরুণ সহজেই বিভিন্ন অঞ্চলের চাষিদের এই ব্যবস্থাপনার অন্তর্ভুক্ত করানো সম্ভব হয়। তাতে সময়ও কম লাগে ও ব্যয়ভারও কমে।
কৃষিক্ষেত্রে বিভিন্ন মোবাইল অ্যাপ্লিকেশন ও ওয়েবসাইটের তথ্য–
Enam: ENAM হল আন্তর্জাতিক জাতীয় কৃষিবাজার। সেখানে এ.জি.এম.সি মান্ডিগুলির ফসলের দর, তার দূরত্ব, আবহাওয়া ইত্যাদি সম্পর্কে তথ্য জানা যায়।
সুফল বাংলা: এই অ্যাপ্লিকেশন-এর মাধ্যমে চাষিরা তাঁদের ফসল অনুযায়ী জেলাভিত্তিক সংগ্রহ কেন্দ্র, বিক্রয়কেন্দ্র, ফসলের ক্রয়মূল্য, বিক্রয়মূল্য ইত্যাদির তথ্য জানতে পারেন।
মেঘদূত (Meghdoot) : ভারত সরকারের আবহাওয়া দপ্তরের এই বিশেষ অ্যাপ্লিকেশন ব্যবহার করে চাষিরা তাঁদের গ্রাম ভিত্তিক আবহাওয়ার পূর্বাভাস পেতে পারেন এবং তার সঙ্গে আবহাওয়া অনুযায়ী ফসল সম্পর্কে পরামর্শও নিতে পারেন।
কিষাণ সারথী (www.kisansarathi.in): ভারতীয় কৃষি অনুসন্ধান পরিষদ (ICAR) কর্তৃক পরিচালিত এই ওয়েবসাইটে গিয়ে চাষিরা তাদের খামার অনুযায়ী তথ্য সহযোগিতা নিতে পারেন। সরাসরি কৃষি বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে যোগাযোগ করে পরামর্শ নেওয়াও সম্ভব।
বাংলা শস্যবিমা (www.banglashasyabima.net) : পশ্চিমবঙ্গ সরকারের কৃষি দপ্তরের এই ওয়েবসাইট বাংলার কৃষকদের অর্থনৈতিক সুরক্ষার অন্যতম রক্ষাকবচ। এখানে চাষিরা তাদের ফসলের বিমার নথিভুক্ত করতে পারেন। কোন ফসলের ক্ষতি হলে তার তথ্য প্রদান ও বিমা অনুযায়ী ক্ষতিপূরণের দাবিও অনলাইনে করা সম্ভব হয়। তার সাথে তাদের ক্ষতিপূরণের প্রক্রিয়া ও অবস্থান সম্পর্কে সঠিক তথ্য সহজেই পেতে পারেন।