shono
Advertisement

সম্পাদকীয়: চিনের একনায়কত্ব ও সভ্যতার সংকট

বিশ্বে ১৭ কোটিরও বেশি মানুষকে সংক্রমিত করেছে করণ ভাইরাস।
Posted: 07:31 PM Jul 01, 2021Updated: 07:31 PM Jul 01, 2021

একুশ শতকের এই জৈব-রাসায়নিক যুদ্ধ মানবতার বিরুদ্ধে নির্লজ্জ এবং প্রকাশ্য চিনা অপরাধের দৃষ্টান্ত। এই অপরাধ একান্তভাবেই সংঘটিত হয়েছে হান-ভূমির শাসক সিপিসি-র দ্বারা এবং তার শিকার হয়েছে বাকি বিশ্ব। প্রতিটি দেশের পরিণতি হয়েছে মর্মান্তিক। শুধু তাই নয়, করোনা ভাইরাস এক দীর্ঘমেয়াদি বিপদ হয়ে দাঁড়িয়েছে জনস্বাস্থ্য এবং মানুষ প্রজাতির শারীরিক অস্তিত্বের কাছে। লিখছেন অভিজিৎ ভট্টাচার্য

Advertisement

আমার মতে, সামগ্রিকভাবে পৃথিবীকে এবং বিশেষত ভারতকে ক্ষতিপূরণ দিতে বাধ্য ‘কমিউনিস্ট পার্টি অফ চায়না’ বা সিপিসি-র নেতৃত্বাধীন চিন। ইউহান-ই চলতি জৈব-রাসায়নিক যুদ্ধের উৎস। বায়ুবাহিত ভাইরাস ‘কোভিড ১৯’ বা করোনা ভাইরাস এখনও পর্যন্ত বিশ্বে ১৭ কোটিরও বেশি মানুষকে সংক্রমিত করেছে, প্রাণ কেড়ে নিয়েছে ৪০ লক্ষের কাছাকাছি মানুষের। এই ভাইরাসে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের তালিকায় ভারতীয়ই রয়েছেন প্রায় তিন কোটি। করোনা-আক্রান্ত এবং প্রায় চার লক্ষ মৃত। এসবের জন্য মাশুল দেবে না চিন? কিন্তু আমার বন্ধুরা আমাকে মনে করিয়ে দিল, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরের পরাজিত জার্মানির সঙ্গে চিনের পার্থক্য আছে। চিন (China) এখনও পর্যন্ত পরাস্ত নয়, আর এই অপরাজিত চিনকে ক্ষতিপূরণ দিতে বাধ্য করা যাবে না। কোনও দেশ তাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর সাহস দেখাবে না।

[আরও পড়ুন: বেদনার আর্তিতে তোমাকে চাই…, কাতারে সিআর-পূর্ণতার অপেক্ষায় থাকল অর্বুদ ‘পুজারি’]

আমার বন্ধুদের এ-কথার উত্তরে আমি চিনের সঙ্গে বিবাদের মূল কারণটুকু তাদের কাছে তুলে ধরতে চাই। আবিশ্বে এই অপ্রত্যাশিত মানবসম্পদের বিপর্যয়, দুর্বিপাক, এই মৃত্যুময়তার নেপথ্যে তথাকথিত ‘দিগ্বিজয়ী’ চিনের যে ভূমিকা, তাই আমি পেশ করছি আমার তর্ককূট হিসাবে। দুর্ভাগ্যবশত, ভারতে একাংশ মানুষ রয়েছে, যারা প্রভাবশালী এবং তাদের চিন-প্রীতি প্রশ্নাতীত। তাদের ব্যবসা-বাণিজ্য নিয়ে বেশি মাথা ব্যথা, এমনকী, তা ভারতের জাতীয় স্বার্থের বিনিময়ে হলেও। চিনা ড্রাগনের অনিয়ন্ত্রিত ত্রাস নিয়ে তাদের ঔদাসীন্য প্রকট হয়ে ওঠে। নয়াদিল্লির প্রতি অপমান নিয়ে তারা নিরুত্তাপ। তারা ক্রমাগত প্রয়াস করে চলেছে চরম ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোকে অপমান করতে, চেষ্টা করছে সেসব দেশকে নির্দয় স্বভাবের, দুর্বল, ভীরু এবং বশ্যতাস্বীকারকারী প্রতিপন্ন করতে।

সুতরাং, একথা নিঃসংশয়ে বলা যায়, করোনায় ‘পরাজিত’ সব দেশের ন্যায়বিচার প্রাপ্য। তারা সমষ্টিগতভাবে একটিই প্রতিপক্ষের মুখোমুখি হয়েছে। সেই প্রতিপক্ষ বেপরোয়া, হিংস্র, জোচ্চোর, যুদ্ধের দামামা বাজানো পেশি-ফোলানো দুর্বৃত্ত। সেই প্রতিপক্ষ ‘বিজয়ী’ সিপিসি­-শাসিত রাষ্ট্র। প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর নথি পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে যে, বিশ শতকের এই দু’টি মহাযুদ্ধের মূল কুশলী ছিল তিনটি বা চারটি ইউরোপীয় রাষ্ট্র। তারা-ই এই যুদ্ধ দু’টি শুরু করেছিল এবং লড়েছিল বৃহত্তর রাষ্ট্রদের বিরুদ্ধে। কিন্তু দু’টি যুদ্ধের শেষেই তারা পরাস্ত এবং বিপর্যস্ত হয়েছিল বিজয়ী রাষ্ট্রগুলোর দ্বারা। একুশ শতকের এই জৈব-রাসায়নিক যুদ্ধ মানবতার বিরুদ্ধে নির্লজ্জ এবং প্রকাশ্য চিনা অপরাধের দৃষ্টান্ত। এই অপরাধ একান্তভাবেই সংঘটিত হয়েছে হান-ভূমির শাসক সিপিসি-র (CPC) দ্বারা এবং তার শিকার হয়েছে বাকি বিশ্ব। প্রতিটি দেশের পরিণতি হয়েছে মর্মান্তিক। শুধু তা-ই নয়, করোনা ভাইরাস (Corona Virus) এক দীর্ঘমেয়াদি বিপদ হয়ে দাঁড়িয়েছে জনস্বাস্থ্য এবং মানুষ প্রজাতির শারীরিক অস্তিত্বের কাছে।

সত্যি বলতে কী, বিশ শতকের দু’টি ছকে বাঁধা মহাযুদ্ধেও যা ঘটেনি, সিপিসি-র এই আক্রমণে সেটাই ঘটেছে। এ এক নির্বিচার গণহত্যা, বিশ্ব-অর্থনীতিতেও এক চূড়ান্ত আঘাত। স্বাস্থ্য, অর্থনীতি, সমাজ, পরিবেশ, নৈতিকতা, শিক্ষা, ব্যবসা-বাণিজ্য, প্রযুক্তি- এই সবকিছুর সর্বনাশ ইতিমধ্যেই ঘটেছে এর ফলে। জাতিরাষ্ট্রের ধারণা এবং বিশ্বব্যবস্থা ঘেঁটে গিয়েছে। পাশাপাশি, আরও একটা বিষয়ে সাফল্য অর্জন করেছে সিপিসি। তারা এশিয়া, ইউরোপ এবং আফ্রিকার দেশনেতাদের ঘুষ দিয়ে কিনে নেওয়ার সহজতম পথ চিনে নিয়েছে। আর এভাবেই তারা দেশগুলির সম্পদ লুঠ শুরু করেছে। জবরদখল করেছে বন্দর, দ্বীপ, উপকূলবিহীন দেশ। হান নেতৃত্বাধীন সিপিসি এই যে যুদ্ধক্ষেত্র উন্মোচন করল, তা বহুদেশব্যাপী, বহুমুখী। যুদ্ধের মাধ্যমে যাবতীয় যা যা অপরাধ করা জায়েজ, তার সবই এই যুদ্ধের অন্তর্ভুক্ত। শতবর্ষপ্রাচীন সিপিসি “যুদ্ধ, অনিয়মিত যুদ্ধ, শুধুই যুদ্ধ (‘বেলাম জাস্টাম’), মিশ্র যুদ্ধ, নিখুঁত যুদ্ধ, গোপন যুদ্ধ, নিয়মিত যুদ্ধ, বিপ্লবী যুদ্ধ, বৃহৎ যুদ্ধ”- এই ধরনের নানা যুদ্ধকৌশলের মধ্য দিয়ে বিজয়লাভের শিল্প এবং সৃজনকে প্রশস্ত ও পুনঃসংজ্ঞায়িত করেছে। হানদের ‘মিডল কিংডম’-এর রাজত্বে বাকি সকলের ক্ষতি করাই একমাত্র ধর্ম।

তা সত্ত্বেও, সিপিসি-র এই ছদ্ম আক্রমণের চেহারা পরিষ্কার হয়ে গিয়েছে। তাদের বিদ্বেষমূলক অপরাধপ্রবণতা গোপন নেই আর, তাদের মানবহত্যার প্রবণতা প্রকাশ্য বাকি জাতিরাষ্ট্রর কাছে। ধীরে-সুস্থে এই উপলব্ধি থেকে এক অন্য পর্যায়ে উন্নীত হচ্ছে বিভিন্ন মহাদেশে। সকলে প্রস্তুত হচ্ছে সিপিসি-কে একহাত নেওয়ার জন্য। তার এই লজ্জাহীন ভয়ংকর অপরাধের জন্য তাকে দায়ী করতে চাইছে। বিশ্বের ইতিহাসে এমনটা আগে দেখা যায়নি। পরোক্ষ উপায়ে মানবতার ধ্বংসলীলায়, বিশ্বশান্তির বিরুদ্ধে, বিশ্বের প্রতিটি কোণে আন্তর্জাতিক আইনের বিরুদ্ধে গিয়ে সিপিসি-র যে ঘৃণ্য ভূমিকা- তাতে তাকে দুই বিশ্বযুদ্ধের অপরাধীদের থেকে অনেক নিঘিন্নে বলে গণ্য করা যায়। বলা যেতে পারে, চিন অবিসংবাদী অপরাধী এক্ষেত্রে, এবং এই অপরাধে তাদের জুড়ি মেলা ভার।

যে দেশগুলি ক্ষতিগ্রস্ত, তারা সমষ্টিগতভাবে চিনকে এক বিশেষ কারণে নির্মিত আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে পারে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর ন্যুরেমবার্গে যেমন হয়েছিল, অথবা টোকিও ওয়্যার ট্রাইবুনালের কথাও মনে করা যেতে পারে। সমস্যা অন্যত্র। রাষ্ট্রসংঘের এখন যা অবস্থান, তাতে সিপিসি-কে শায়েস্তা করা তাদের পক্ষে অসম্ভব। যে কোনও আন্তর্জাতিক আইনি ব্যবস্থার বিরুদ্ধে চিনের ‘ভেটো’ দেওয়ার ক্ষমতা আছে। সেভাবেই তারা তাদের যাবতীয় মানবতা-বিরোধী কাজের হয়ে সাফাই গাইতে পারে। এই ধরনের ঘটনা তারা ঘটায় সর্পিল, পরোক্ষ উপায়ে। তারা গুলি না খরচ করেও মানুষ মারে, তারা মানুষ মারে বায়ুবাহিত ভাইরাস মারফত। কেন? না, যাতে তাদের একাধিপত্য থাকে, কেবল তাদেরই সমৃদ্ধি হয়। তাদের মনস্তত্ত্ব অনেকটাই মহাভারতের যুদ্ধবাজ কৌরবদের মতো। সিপিসি যেন এক হত্যার প্রকল্প নিয়ে নেমেছে। এর ভবিষ্যৎ পরিণতি সম্পর্কে তারা এখনও অন্ধ। নির্বিচারে শত্রুনিধন করে শ্মশানের নীরবতা ও শাশ্বত আঁধারের মধ্যে বসে কোনও ‘বিজয়ী’ তার বিজয়ের সুফল ভোগ করতে পারে না- এ-কথা তারা ভুলে গিয়েছে।

আসল বিপদ হল, চিনাদের প্রতিশোধস্পৃহা ও মিথ্যাচার। হেগ-এ অবস্থিত আন্তর্জাতিক আদালত ২০১৬ সালের জুলাইতে রায় দিল চিনের বিরুদ্ধে। তারা আন্তর্জাতিক আইন ভাঙার অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হল। দক্ষিণ চিন সাগর সংকট নিয়ে সেই রায় গেল ফিলিপিন্সের অনুকূলে। কিন্তু হানসুলভ ঔদ্ধত্যে চিন স্পর্ধিতভাবে উপহাস করল এই রায়কে। তার কারণ, আন্তর্জাতিক আদালত এই রায় দিলেও তাদের নিজেদের রায় কার্যকর করার ক্ষমতাই নেই। ফলে পৃথিবীকে ‘জোর যার মুলুক তার’ নীতির প্রয়োগ দেখতে হল। বিশ্ব-ইতিহাসে ‘জঙ্গল রাজ’-এর নিকৃষ্টতম দৃষ্টান্ত এটি। তাই হান একনায়কের অধীন সিপিসি যতই ক্ষতি করুক, আঘাত করুক, হেনস্তা করুক- পৃথিবীকে কেবল দেখে যেতে হবে, মুখ বুজে সয়ে যেতে হবে।

যদিও, এখনও সম্পূর্ণ হেরে যাইনি আমরা। সিপিসি­-কে ‘ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অফ জাস্টিস’-এর কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর সময় এখনও চলে যায়নি। হান একনায়কদের ‘মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ’, ‘হিংসা’ (কূটনৈতিক হুমকি, আক্রমণ, হেনস্থা, রাজনৈতিক ব্ল্যাকমেলিং), অর্থনীতি, ভূখণ্ডগত ভারসাম্য, বিশ্বজুড়ে জাতিরাষ্ট্রগুলির রাজনৈতিক সার্বভৌমত্বে আঘাত হানা- এসব অপরাধের বিচার করার জন্য একটি বিশেষ বিচারালয় গঠন করা উচিত। রাষ্ট্রসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ ‘ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অফ জাস্টিস’-এর রায় কার্যকর করার ক্ষমতা রাখে। অতএব, এবার সিপিসি-র প্রত্যাঘাতের ভয়ে তাদের তোষণের নীতি থেকে সরে এসে তাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর সময় এসে গিয়েছে। ‘ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অফ জাস্টিস’-এর পাশাপাশি ‘ইন্টারন্যাশনাল ল কমিশন’-ও এক্ষেত্রে জরুরি ভূমিকা নিতে পারে। ‘আন্তর্জাতিক আইনের প্রগতি ও সারসংগ্রহ’-এর জন্য ১৯৪৭ সালে তৈরি হওয়া এই সংস্থায় আন্তর্জাতিক আইনের বিশেষজ্ঞরা রয়েছেন। ‘ভিয়েনা চুক্তি’-র মতো গুরুত্বপূর্ণ চুক্তি আইনের খসড়া প্রস্তুত করেছে এই কমিশন।

এই মুহূর্তে যা আশু প্রয়োজন, সিপিসি-কে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার মদতে মোকাবিলা করা। মানুষের জীবন, মূল্যবোধ এবং সম্মানের প্রতি চূড়ান্ত অসহিষ্ণু এবং উদাসীন একটি রাষ্ট্রের শাসক, নির্মম এবং অসভ্য কমিউনিস্ট পার্টির মাথায় বসে থাকা একনায়ক মানুষের অস্তিত্বকে যে বিপন্নতার মুখে দাঁড় করিয়েছে- তাকে সমূলে বিনাশ করার সময় এসে গিয়েছে। বিশ্ব-মানবতার সামনে বিপদ হয়ে দাঁড়িয়েছে যারা, তাদের অভাবনীয় সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে ক্ষুদ্র-বৃহৎ, দুর্বল-শক্তিশালী- সবাইকে একজোট হতে হবে, যেমনটা ঘটেছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর।
কাজেই যাঁরা বলছেন, ‘বিশ শতকে পরাস্ত শক্তির সঙ্গে যে আচরণ করা গিয়েছে, একুশ শতকে চিনকে সেভাবে শায়েস্তা করা যাবে না’- তাঁর খুব প্রজ্ঞার পরিচয় দিচ্ছেন না। ভেবে দেখতে হবে, মানবজাতির এটা অস্তিত্ব সংকটের প্রশ্ন। সে ‘বিজয়ী’ না ‘পরাজিত’, তা জরুরি নয়। যা উল্লেখ্য এবং প্রাসঙ্গিক, তা হল মানবতার কাছে যেই-ই বিপজ্জনক হয়ে উঠবে, তাকে শাস্তি পেতেই হবে। ২০২১-এ দাঁড়িয়ে মানবসভ্যতার কাছে সবচেয়ে বড় শত্রু সিপিসি-র একনায়কত্ব।

[আরও পড়ুন: প্রযুক্তির অগ্রগতির সঙ্গে বাড়ছে সাইবার আক্রমণ, মুক্তির উপায় কী?]

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

Advertisement