রাষ্ট্রসংঘে যখন জর্ডনের নেতৃত্বে আরব দেশগুলি মানবিক কারণে গাজায় যুদ্ধবিরতির পক্ষে প্রস্তাব আনল, ভোটদানে বিরত থাকল ভারত। রাজনৈতিক মহলের ব্যাখ্যা, আসন্ন লোকসভা ভোটকে সামনে রেখে অভ্যন্তরীণ রাজনীতির স্বার্থেই প্রধানমন্ত্রীর এই অবস্থান। কলমে সুতীর্থ চক্রবর্তী
ইজরায়েল-হামাস সংঘর্ষে নরেন্দ্র মোদি সরকারের দোদুল্যমান অবস্থানে মুখ পুড়ছে ভারতের। রাজনৈতিক মহলের ব্যাখ্যা, লোকসভা ভোটকে সামনে রেখে অভ্যন্তরীণ রাজনীতির স্বার্থেই মোদির এই দোলাচল। কোনও কোনও মহল থেকে প্রশ্ন তোলা হচ্ছে- আদানি গোষ্ঠীর বাণিজ্যিক স্বার্থ নিয়েও। সেই স্বার্থ দেখতে গিয়েই নাকি ভারতকে মাঝে মাঝে নগ্নভাবে ইজরায়েলের পক্ষ নিতে হচ্ছে। রাষ্ট্র সংঘর সাধারণ সভায় যুদ্ধবিরতির পক্ষে আনা প্রস্তাবে ভারতের ভোটদানে বিরত থাকার ঘটনা ঘরে-বাইরে তীব্র বিতর্কের জন্ম দিয়েছে।
৭ অক্টোবর হামাস জঙ্গির হামলার পর প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ইজরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুকে দৃঢ়ভাবে পাশে দাঁড়ানোর আশ্বাস দেন। ভারতের এই অবস্থান নিয়ে সঙ্গে সঙ্গে শোরগোল পড়ে দেশে। বরাবর প্যালেস্টাইন রাষ্ট্রের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের পক্ষে সরব ভারত কেন ইজরায়েলের পক্ষে সওয়াল করছে, প্রশ্ন ওঠে তা নিয়ে। ক্ষোভ দেখা দেয় আরব দুনিয়ায়। পরিস্থিতি বেগতিক দেখে বিদেশমন্ত্রক সাফাই দিতে নামে। বলা হয়, ইজরায়েল-প্যালেস্টাইন সমস্যার সমধানে ভারত দুই রাষ্ট্রের তত্ত্বেই অনড় রয়েছে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বিতর্কে প্রলেপ দিতে ফোনে কথা বলেন ‘প্যালেস্টাইন অথরিটি’-র প্রেসিডেন্ট মহম্মদ আব্বাসের সঙ্গে। রাফা সীমান্ত দিয়ে গাজায় ত্রাণসামগ্রীও পাঠায় ভারত। কিন্তু ফের অবস্থানের ১৮০ ডিগ্রি পরিবর্তন। রাষ্ট্রসংঘে যখন জর্ডনের নেতৃত্বে আরব দেশগুলি মানবিক কারণে গাজায় যুদ্ধবিরতির পক্ষে প্রস্তাব আনল, ভোটদানে বিরত থাকল ভারত।
রাষ্ট্রসংঘর মহাসচিব অ্যান্টোনিও গুতেরেসের মন্তব্যে বেজায় চটেছে ইজরায়েল। ক্ষোভ আমেরিকার জায়নবাদীর সমর্থকদের মধ্যেও। গুতেরেস রাষ্ট্র সংঘে দাঁড়িয়ে কার্যত ঘোষণা করেছেন, হামাস বিনা কারণে হামলা চালায়নি। গুতেরেস বলেন, ‘শূন্যতার উপর দাঁড়িয়ে হামাস হামলা চালায়নি। ৫৬ বছর ধরে অবরুদ্ধ গাজা ও প্যালেস্টাইনের ভূখণ্ড। তাদের এলাকায় লাগাতার বসতি করছে ইজরায়েল। তাদের অর্থনীতি স্তব্ধ।’ ফলে হামাসের প্রতিক্রিয়া সেই নিরিখেই দেখতে হবে।
আরব দুনিয়ার ২২টি দেশ রাষ্ট্রসংঘে যে-প্রস্তাব নিয়ে এসেছিল, তাতে হামাসের হামলার প্রসঙ্গ রাখা হয়নি। সেটাকেই অজুহাত করে ভারত ভোটদানে বিরত থেকেছে। যুদ্ধবিরতির পক্ষে আনা প্রস্তাবকে সমর্থন জানিয়েছে ১২০টি দেশ। ইজরায়েল ছাড়া প্রস্তাবের বিরুদ্ধে ভোট দিয়েছে আমেরিকা-সহ ১৪টি দেশ। বাকি দেশগুলো অধিকাংশই প্রশান্ত মহাসাগরের উপর অবস্থিত দ্বীপরাষ্ট্র। এই দেশগুলো বস্তুত আমেরিকার ছোট ছোট স্যাটেলাইট। ৪৫টি দেশ ভোটদানে বিরত ছিল। এই ৪৫টি দেশের মধ্যে কানাডা, অস্ট্রেলিয়া-সহ আমেরিকা ও ইজরায়েলের মিত্র দেশগুলি রয়েছে। সেই খাতায় নাম লেখাল ভারত।
সদ্য জি-২০ সম্মেলনে ভারত নিজেকে ‘গ্লোবাল সাউথ’-এর নেতা হিসাবে তুলে ধরার চেষ্টা করেছে। একদিকে নিজেকে ‘গ্লোবাল সাউথ’-এর নেতা হিসাবে তুলে ধরার চেষ্টা, অন্যদিকে রাষ্ট্রসংঘে আরব ও আফ্রিকার দেশগুলির অবস্থানের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো, রাজনৈতিক মহলের মতে এটা প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সরকারের দ্বিচারিতা ছাড়া আর কিছুই নয়। ভারত কেন ইজরায়েলের পক্ষে দাঁড়াল, তার নানাবিধ ব্যাখ্যা সামনে আসছে। প্রথমত, আমেরিকাকে খুশি রাখার বিষয়টি রয়েছে। আমেরিকাকে খুশি করতে গিয়ে ভারত কি ফের আরব দুনিয়াকে ক্ষুব্ধ করে তুলল না? অশোধিত জ্বালানি তেলের জন্য ভারতকে আরব দুনিয়ার উপর নির্ভর করতে হয়। দ্বিতীয়ত, ইজরায়েলের সঙ্গে সম্পর্কের বিষয়টি গুরুত্ব পাচ্ছে। ইজরায়েল থেকে ভারত যুদ্ধাস্ত্র ছাড়াও নানা ধরনের প্রযুক্তি আমদানি করে থাকে।
সম্প্রতি, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ঘনিষ্ঠ আদানি গোষ্ঠী ইজরায়েলের হাইফা বন্দর অধিগ্রহণ করেছে। হাইফা বন্দরের ৭০ শতাংশ অংশ আদানিদের হাতে। আদানিরা হাইফা বন্দর অধিগ্রহণের পর ভারত আরব আমিরশাহী, সৌদি আরব, জর্ডন ও ইজরায়েলের মধ্যে দিয়ে সরাসরি ইউরোপে পণ্য পাঠানোর জন্য করিডর নির্মাণে আগ্রহী। চিনের ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড’ উদ্যোগের পালটা। এই করিডর তৈরি হলে আদানিরা হাইফা বন্দর দিয়ে দ্রুত ইউরোপে পণ্য পাঠাতে পারবে। এই করিডরকে সামনে রেখে আদানি গোষ্ঠী গ্রিসে একটি বন্দর অধিগ্রহণের বিষয়ে উদ্যোগী হয়েছে।
[আরও পড়ুন: গাজার টান, সুর বদলাতে বাধ্য হচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র]
ইজরায়েলকে সমর্থনের পিছনে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির অভ্যন্তরীণ রাজনীতির স্বার্থের কথা বলা হচ্ছে। ২০২৪-এর আগে বিজেপি দেশে মেরুকরণ তীব্র করার কোনও প্রক্রিয়াই হাতছাড়া করতে চায় না। সাত তাড়াতাড়ি হামাসের হামলার বিরোধিতা ও ইজরায়েলের পক্ষে দৃঢ়ভাবে দাঁড়ানোর অঙ্গীকার করে মোদি তাঁর অভীষ্ট মেরুকরণে পৌঁছনোর চেষ্টা করছেন কি না, সেই প্রশ্নও গত কয়েক দিন ধরে বারবার উঠেছে। কেন্দ্রীয় সরকারের তরফে বারবার বোঝানোর চেষ্টা হচ্ছে, যেহেতু ভারত দীর্ঘদিন ধরে সন্ত্রাসবাদী হামলার ভুক্তভোগী, তাই হামাসের বিরোধিতা করতে এতটা তৎপর। কিন্তু, সরকারিভাবে এখনও হামাসকে ভারত ‘সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠী’ বলে ঘোষণা করেনি।
লস্কর-ই-তইবা, আল কায়দা বা আইএস জঙ্গিদের সঙ্গে হামাস তুলনীয় কি না, সেই প্রশ্ন করাই যেতে পারে। জায়নবাদের বিরুদ্ধে প্যালেস্টাইনের মানুষ দীর্ঘদিন ধরে লড়াই করছে। হামাসের লড়াই কি আদৌ তার থেকে বিচ্ছিন্ন? জায়নবাদীরা প্যালেস্টাইনের ভূখণ্ডে যে দমনপীড়ন দীর্ঘদিন ধরে চালিয়ে আসছে, তার বিরোধিতা ভারত বরাবর করেছে। হামাসের কার্যকলাপ প্যালেস্টাইনের সেই মুক্তিকামী মানুষের আন্দোলনেরই একটা বহিঃপ্রকাশ, এই মতের কতটা বিরোধী ভারত? সে-ব্যাপারে সুস্পষ্ট কোনও ধারণা ভারতবাসীর কোনওকালেই নেই।
গুতেরেস যেভাবে হামাসের দাবির পক্ষে দাঁড়িয়েছেন, তাতে রাতারাতি হামাসকে ‘সন্ত্রাসবাদী’ বলে দাগিয়ে দেওয়া বহু দেশের কাছেই কঠিন হয়ে দাঁড়াচ্ছে। অভ্যন্তরীণ রাজনীতির স্বার্থে হামাসের নিন্দা করা যদি একান্তই বিজেপির পক্ষে জরুরি হয়ে থাকে, তাহলেও প্রশ্ন ওঠে তার কার্যকারিতা নিয়ে। হামাসের বিরোধিতা করলে দেশের সাধারণ মানুষ যে জায়নবাদীদের পক্ষ নেবে এবং ইজরায়েলের এই নির্বিচারে মানবহত্যার পাশে দাঁড়াবে, তা মোটেও জোর দিয়ে বলা যায় না। প্যালেস্টাইন-সহ যে কোনও মুক্তিকামী আন্দোলনের পাশে দাঁড়ানোর একটা দীর্ঘ ঐতিহ্য ভারতবাসীর রয়েছে। স্বাধীনতা সংগ্রামের মধ্য দিয়ে ভারতবাসী এই মূল্যবোধকে অর্জন করেছে। আজকে হঠাৎ করে সাধারণ ভারতবাসী তথা সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের বড় অংশ তার বিপরীত অবস্থান গ্রহণ করবে, এমনটা ভাবা ভুল। যুদ্ধবিরতির প্রস্তাবের পক্ষে ভোট না-দেওয়া দেশবাসীর ভাবাবেগে আঘাত করল কি না, সেটাও সরকারের ভেবে দেখা উচিত।